নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ - পর্ব: ১
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৭:০৪:৪৮ সকাল
"শপথ নফসের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর, অতঃপর তাকে (নফসকে) তার জন্য কোনটি মন্দ ও কোনটি ভাল তা বোঝার জ্ঞান দান করেছেন, প্রকৃতপক্ষে সেই সফলকাম হয় যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নেয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ হয়” (৯১: ৭-১০)।
জিহাদ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। সাধারণ অর্থে একে ধর্মীয় লড়াই বা যুদ্ধ বলা হয়। বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং ফেতনা-ফ্যাসাদ দূরীভূত করার জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত যুদ্ধই জিহাদ নামে পরিচিত। অন্যায়, অবিচার, জলুম ও অত্যাচার প্রতিহত করে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত করাই জিহাদের লক্ষ্য। প্রকৃত অর্থে আল্লাহর পথে সব চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রামকেও জিহাদ বলা হয়। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদও এর অন্তর্ভূক্ত। নফস একটি ব্যক্তিসত্তা বা প্রবৃত্তি যা মানুষের প্রাণ সত্তার সাথে অঙ্গীভূত থাকে। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ মানুষকে শুধুমাত্র সাধারণ প্রাণী হিসেবেই সৃষ্টি করেননি। তিনি তাকে সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা দিয়েছেন, করেছেন বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। তাকে আরো দিয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা ও বোঝার মত জ্ঞান যাতে সে সত্য-মিথ্যা ও ভাল-মন্দ যাচাই বাছাই করে সঠিক পথে চলতে পারে। তিনি মানুষের মধ্যে বিরাজমান ব্যক্তিসত্তা বা নফসকে কিছুটা স্বাধীনতা দিয়েছেন, সে ইচ্ছে করলে নিজেকে সঠিক পথেও চালাতে পারে অথবা ভুল পথেও পরিচালিত করতে পারে। প্রতিটি মানুষের নফসে পরস্পর বিরোধী দু’টি প্রেরণা কাজ করে। এর একটি তাকে সৎ কাজ ও চিন্তা-ভাবনার প্রেরণা জোগায়, অপরটি তাকে মন্দ বা অসৎ কর্ম ও চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। ঐশী বা সৎ প্রেরণার দ্বারা মানবিক সত্তার উন্মেষ ঘটে, বিবেকবোধের সৃষ্টি হয়, - যা তাকে তার জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, দায়িত্ব, কর্তব্য ও শেষ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এ ধরনের সচেতন মানুষ তাদের স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং নিজেকে সৎ কাজ ও চিন্তায় নিয়োজিত করে। আর কিছু বেপরোয়া মানুষ আছে তারা মন্দ প্রেরণা দ্বারা ষড়রিপুর বশীভূত হয়ে তার পাশবিক সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। এরা তখন কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় বিবেকবোধ হারিয়ে নিজেকে পাপ-পঙ্কিলতায় জড়িয়ে ফেলে। যারা কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে সৎ চিন্তা ও কর্মের চেষ্টা সাধনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, "তারা আল্লাহর প্রতি ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়; অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে" (৩: ১১৪)।
নিজ ব্যক্তিসত্তাকে অর্থাৎ নফসকে নিয়ন্ত্রণ, পরিশুদ্ধ ও কলুষমুক্ত রাখার জন্য মু’মিনের অন্তরে নিরন্তর সংগ্রাম ও চেষ্টা-সাধনা চলতে থাকে। অন্তঃকরণের এই সংগ্রাম ও চেষ্টা-সাধনাকেই নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ বলা হয়। তিরমিজী ও ইবনে মাজা হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত এক হাদীসে আল্লাহর রসুল (সাঃ) বলেন, 'মুজাহিদ সেই ব্যক্তি যে সর্ব শক্তিমান মহামহিম আল্লাহর আনুগত্য পালনে নিজ নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে’। তিরমিজী শরীফে বর্ণিত অপর এক হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নফস প্রসঙ্গে বলেন, 'মানব সত্তার মধ্যে দু'টি অনুপ্রেরণা কাজ করে, একটি আসে একজন ফেরেশতার কাছ থেকে যে কল্যাণের দিকে আহ্বান করে এবং সত্যকে সমর্থন দেয়। যে তা পেয়েছে সে যেন জানে এটা এসেছে আল্লাহর তরফ থেকে এবং তাঁর প্রশংসা করে; অন্য অনুপ্রেরণাটি আসে শত্রুর (শয়তান) কাছ থেকে যা তাকে সন্দেহে পতিত করে এবং যা সত্যকে অস্বীকার করে ও কল্যাণকে বাধা দেয়; যে তা পেয়েছে সে যেন অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে’। এরপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন: "শয়তান তোমাদেরকে অভাব অনটনের ভীতি প্রদর্শন করে এবং অশ্লীলতার আদেশ দেয়" (২: ২৬৮)। মানুষের অন্তরের উপরোক্ত দু’টি পরস্পর বিরোধী শক্তির ব্যাখ্যায় অপর এক হাদীসে রসুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, 'মু'মিনের অন্তর দয়াময় আল্লাহর দু'টি আঙুলের মাঝখানে বিরাজ করে’ (মুসলিম, আহমদ, তিরমিজী, ইবনে মাজা)। এখানে আঙুল দু'টিকে অন্তরের সংঘাত ও দ্বিধা-দ্বন্দের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। রাগ-প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ও অশ্লীলতার মত কুপ্রবৃত্তিগুলোকে অনুসরণ করলে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান আসন গেড়ে বসে। তখন শয়তানী শক্তি নিরর্থক কামনা-বাসনার দ্বারা তাকে বশীভূত করে ফেলে। যদি সে নিজ কুপ্রবৃত্তির বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে এবং এগুলোকে তার বিবেকের ওপর আধিপত্য করতে না দেয়, ফেরশেতাদের চরিত্রকে অনুকরণ করে, তা হলে তার অন্তর ফেরেশতাদের বিশ্রাগারে পরিণত হয় এবং তারা একে আলোয় উদ্ভাসিত করে দেয়।
মুসলিম শরীফের এক হাদীসে আল্লাহর রসুল (সাঃ) সাহাবাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'এমন কেউ নেই যার মধ্যে একজন শয়তান বাস করে না’। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, 'ও আল্লাহর রসুল, এমনকি আপনার মধ্যেও’ । তিনি বললেন, 'এমনকি আমার মধ্যেও, কিন্তু তার থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহ্ আমাকে সাহায্য করেছেন এবং সে আমার নিকট পরাভূত হয়েছে, সুতরাং সে আমার ভাল ছাড়া অন্য কিছু করতে পারে না’। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। সে মানুষের অন্তর এবং প্রতিটি ইন্দ্রিয় ও রিপুকে চতুর্মুখী আক্রমণের দ্বারা প্ররোচিত করে, মন্দ কাজের অনুপ্রেরণা দেয়, অসৎ ও অশ্লীল কাজে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। এর কুপ্রভাবে মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয়। মানব জাতির আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া এই শয়তানের প্ররোচনায় ভুল করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে বসেন। তারা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলে পরম করুণাময় আল্লাহ্ তাঁদরেকে ক্ষমা করে দেন, তবে তাঁদেরকে বেহেশত থেকে পৃথিবীর বুকে পাঠিয়ে দেন। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ ভুল প্রবণ। সে হাজারো ধরনের ভুল করে থাকে এবং ভুল পথে পরিচালিত হয়। শয়তান সব সময় তার অন্তরে কুপ্ররোচনা দিতে থাকে। সে মানুষকে বিভ্রান্তি ও দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে ফেলে দেয়। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ অতীব দয়াময় ও ক্ষমাশীল। তিনি তাঁর অনুতপ্ত বান্দাদেরকে দয়া ও ক্ষমা করেন। আর ভুলপ্রবণ মানুষের হেদায়েতের জন্য তিনি নাযিল করেছেন ঐশী গ্রন্থসমূহ, যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী ও রাসুল। ঐশী জ্ঞান মানুষকে সৎ পথের সন্ধান দেয় এবং যাবতীয় অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে তাকে বিরত রাখতে সাহায্য করে। যখন মানুষ মহান আল্লাহর নিকট পুরোপুরি আত্ম-সমর্পিত হয় তখন নফসের বিরূদ্ধে জিহাদে সে কামিয়াবী লাভ করে। এসব সফল মানুষ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, "হ্যাঁ, যে ব্যক্তি নিজের ব্যক্তি সত্তাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও বটে, তার জন্য তার পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না (২: ১১২)"। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৭৫০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন