সোনার বাংলা শ্মশান হওয়ার উপাখ্যান - পর্ব: ৬
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৬ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:০৫:১১ সকাল
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয় আরেক কঠিন কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, অসংখ্য মা-বোনের শ্লীলতাহানি, অগণিত মানুষের উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া, শত শত বুদ্ধিজীবির প্রাণহাণি ছিল যুদ্ধের পরিণতি। আমেরিকার 'টাইম’ ম্যাগাজিন এর একটি প্রতিবেদনে এ বিধ্বংসী চিত্রটি এভাবে তোলে ধরে: 'গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগ্রাসী হামলার পর বিশ্বব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শক দলের নিকট কয়েকটি শহরের অবস্থা 'আনবিক হামলার পরবর্তী সকালের মতো’ মনে হয়েছে। তখন থেকেই এ ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা ধরা পড়ে। প্রায় ৬০ লাখ বাড়ি-ঘর ধ্বংস হয়েছে, ১৪ লাখ চাষী পরিবার তাদের কৃষি উপকরণ অথবা হালের গরু হারিয়েছে। পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। সড়ক ও সেতু বিধ্বস্ত এবং নৌচলাচল অবরুদ্ধ হয়েছে। একমাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পনের পূর্ব পর্যন্ত দেশটি ধর্ষিত হয়েছে। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পশ্চিম পাকিস্তানী মালিকানাধীন সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহের সমুদয় অর্থ-বিত্ত পশ্চিমে পাচার করে দেওয়া হয়। দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় প্রতিটির মালিকও ছিল তারা। পাকিস্তান ইন্টারন্যামনাল এয়ারলাইনস্ এর চট্টগ্রাম শহরের ব্যাংক একাউন্টে মাত্র ১১৭ টাকা (১৬ ডলার সমতুল্য) পাওয়া যায়। পাকসেনারা ব্যাংক নোট ও ধাতব মুদ্রা ধ্বংস করে ফেলে, যে কারণে অনেক এলাকাই এখন নগদ অর্থের তীব্র ঘাটতির মধ্যে পড়েছে। রাস্তা থেকে অথবা ডিলারদের কাছ থেকে প্রাইভেট কারসমূহ জবরদখলে নিয়ে তা চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ হওয়ার পুর্বেই পশ্চিম-পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়’ (Time Magazine USA, Jan. 17, 1972, BANGLADESH: Mujib's Road from Prison to Power) । বিশ্বের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়কে সুনজরে দেখেনি। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সংশয়পূর্ণ মন্তব্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, তাতে যে হতাশব্যঞ্জক কথাটি ছিল তা হলো: "পরিস্থিতি যদি খুব ভালোও হয় তবুও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হবে। দেশের জনগণ গরীব। মাথাপিছু আয় ৫০-৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বৃদ্ধি পায়নি। একটি অতি জনবহুল দেশ (ঘনত্বের হার প্রতি বর্গমাইলে প্রায় ১,৪০০), এর জনসংখ্যা (বছরে ৩% হারে) বেড়ে চলেছে। দেশটির অধিকাংশ মানুষই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০% এর নীচে")।
১৯৭২ এর জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সরকার গঠনের পরিবর্তে নিজ দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত সব সদস্যদের সমন্বয়ে একটি 'গণপরিষদ’ গঠন করা হলো। এ গণপরিষদ স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই দেশকে একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক, ধর্মরিপেক্ষ ও সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান উপহার দেয় । আওয়ামী লীগের দলীয় চার মৌলনীতি গণতন্ত্র, ধর্মনিরেপক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রকে জাতীয় আদর্শ হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধানটি অনুমোদিত ও গৃহীত হওয়ার পর ১৯৭২ এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকরী করা হলো। নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে। তিনি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এ সময় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু তিনি তাঁর আকাশ-ছোঁয়া এ জনপ্রিয়তাকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। এটা সত্যি যে, স্বাধীনতার অব্যবহতি পর দেশের সিভিল প্রশাসন ছিল দক্ষ জনবলহীন। দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ নেতৃবৃন্দের সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নীতি-নির্দ্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত যোগ্যতাসম্পন্ন নেতৃত্ব তখনও গড়ে ওঠেনি। এসময় মুক্তিযুদ্ধের মিত্রশক্তি ভারতের ওপর সার্বিক নির্ভরতা ছিল বেশী। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য অবকাঠামোর অবস্থা ছিল নাজুক। উদ্বাস্তু পুণর্বাসন ও অবকাঠামো পুণর্গঠনে সরকার ছিল ব্যতিব্যস্ত। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে। কালোবাজারী, মজুতদারী ও নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি রোধে প্রশাসন প্রায় ব্যর্থই ছিল। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশী - প্রাপ্তি ছিল অনেক কম। ফলে জন-অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। এহেন অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রধানমন্ত্রী জনগণের নিকট তিন বছর সময় চান। সাংবাদিক এন্থনি মাসকেরেনহাস তাঁর গ্রন্থ 'বাংলাদেশ: লীগ্যাসী অব ব্লাড’ এ লেখেন, "১৯৭২ এর গ্রীষ্মকাল নাগাদ সবকিছুই শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য প্রতিকূল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল”। ১৯৭২ এর জুনের দিকে চালের দাম "বাংলাদেশের মঙ্গা কালীন দামের তুলনায়ও ছিল বেশী” । "..... চরম বাজার অব্যবস্থাপনার কারণে অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন, কেরোসিন, রান্নার তেল, লবণ ও সাবান পাওয়াটাও দুষ্কর হয়ে ওঠে। দেশটিতে অর্থের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় - কারণ ছিল বেকারত্ব ....... যা প্রশমনের কোন ইঙ্গিত ছিল না ....."। "এবং সার্বিক দুরবস্থার সাথে যুক্ত হলো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সহিংসতা” (Mascarenhas, 1986, page 22)। উদ্ধৃত চিত্রটি ছিল আসন্ন এক দুর্যোগের আগাম বার্তা। এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ অগ্রসর হচ্ছিল। বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতিও এ পরিস্থিতির অবনতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। এক শ্রেণীর লুটেরাদের দৌরাত্ম্যে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত ত্রাণসামগ্রী দলীয় সুবিধভোগীরা লোপাট করে নেওয়ায় শেখ মুজিব নিজেই অসন্তেুাষ প্রকাশ করেন। নতুন রাষ্ট্রের অনভিজ্ঞ প্রশাসন, বিধ্বস্ত অবকাঠামো, রাজস্ব ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার অভাব এবং নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা এসবকিছুকে সামাল দেওয়ার মতো তেমন প্রস্তুতি সরকারের ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনা ভেটোর কারণে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ বিঘিœত হচ্ছিল। মধ্য-প্রাচ্যের দেশগুলো তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
চুয়াত্তরের শুরুতেই দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস ক্রমশ দেশকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। চালের দাম রকেট গতিতে বৃদ্ধি পেলো। প্রধান খাদ্যশস্যের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেলো। পত্র-পত্রিকায় অনাহারক্লিষ্ট মানুষের দুঃখ-কষ্টের খবর প্রতিদিনই প্রকাশ পেতে থাকে। একের পর এক বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। বিদেশী উৎস থেকে যথাসময়ে খাদ্য আমদানি করতেও সরকার ব্যর্থ হলো। এ দুঃসময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিএল-৪৮০ আওতাভুক্ত ২,২০,০০০ টনের খাদ্য-সাহয্যের চালান বন্ধ করে দেওয়ায় খাদ্য ঘাটতির তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। খাদ্যাভাবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে চললো। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে সরকার দেশ জুড়ে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। দুর্ভিক্ষের কারণ ও অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। তবে মোদ্দা কথা হলো, তথ্য-উপাত্ত বিচার না করেও এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় এ দুর্ভিক্ষে অসংখ্য নিরন্ন মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। এদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র, দিন-মজুর ও ভূমিহীন শ্রেণীভুক্ত। রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাঙ্গালী জাতির জন্য এ দুর্ভিক্ষ ছিল দুর্ভাগ্যজনক। এ দুর্ভিক্ষ যেমনি দেশের ভেতরে মানুষের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে, তেমনি বিশ্ব-সমাজে বাংলাদেশকে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রবণ ও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশ হিসেবে পরিচিত করে তোলে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে 'ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ বলে একটি 'তলাবিহীন ঝুড়ির’ সাথে তুলনা করেন। এ শ্লেষপূর্ণ মন্তব্যটি ছিল তাঁর বাংলাদেশ-বিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। এর চেয়েও আর এক ন্যাক্কারজনক এবং অমানবিক মন্তব্য করেন আমেরিকান পরিবেশ ও জীব বিজ্ঞানী গ্যারেট হারডিন। তিনি লেখেন, 'প্রজনন ছাড়া সবকিছুতে অক্ষম একটি জনগোষ্ঠীর দেশে চাল পাঠানো একটি ব্যর্থ উদ্যোগ। তাঁর মতে, বাংলাদেশীদেরকে অনাহারে মরতে দেওয়াই উচিত’। বিদেশী সাহায্য প্রাপ্তির আশায় বাংলাদেশী আমলা ও কূটনীতিকগণ বিশ্বসভায় বাংলাদেশের দুঃখ-দুর্দশার কথা এমনভাবে চিত্রিত করেছেন যে, বাংলাদেশ সম্পর্কিত এসব অপমানজনক মন্তব্য প্রাপ্য ছিল বলেই মনে হয়েছে।
পাকিস্তানী আমলের সামরিক স্বৈরাচারের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল সেটি জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহকে রক্ষা করবে বলে আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু পকিস্তানী স্বৈরাচারের প্রেতাত্মা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসতে বেশী একটা সময় নেয়নি। সংবিধান প্রণয়নের একটি বছর পূর্ণ না হতেই এতে দ্বিতীয় সংশোধনী এনে দেশে 'জরুরী অবস্থা’ জারীর বিধান সম্বলিত বিভিন্ন 'কালাকানুন’ অন্তর্ভূক্ত করা হলো এবং জনগণের মৌলিক অধিকারের ধারাগুলোকে স্থগিত করে দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুর সরকার এ সংশোধনীর বলে দেশে 'জরুরী অবস্থা’ জারী করে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠনের তৈরীর স্বাধীনতা, বাক, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ইত্যাদি মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে নেয়। বঙ্গবন্ধুর মত একজন গণতান্ত্রিক নেতার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ বিসর্জনকারী 'কালাকানুন' জারী ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। দেশে জরুরী অবস্থা জারীর পর বিরোধী দলের ওপর 'লাল ঘোড়া’ দাবড়ানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দমন-নিপীড়ন, হত্যা, গুম ও নির্বিচারে গ্রেফতার। সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে তৈরী করা হয় 'রক্ষী বাহিনী’ যা বিরোধী পক্ষকে নিপীড়ন, হত্যা ও গুমের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। এভাবে নয় মাসের ভয়াবহ মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের আবারও এক নব্য স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটল যারা জনগণের মৌলিক অধিকারের টুঁটি চেপে ধরে নৃশংস জুলুম ও অত্যাচারের ধারাকে অব্যাহত রাখল। এরপরে দেশে এ পর্যন্ত সামরিক ও বেসামরিক যত সরকার এসেছে সবাই আওয়ামী লীগের এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই জনগণের মৌলিক অধিকার হরণকারী বিভিন্ন বিধি-বিধান জারী করে দেশ শাসন করেছে এবং এখনও তা অব্যাহত আছে।
দেশে জরুরী অবস্থা জারীর কিছুদিন পরই পঁচাত্তরের জানুয়ারি মাসে 'দ্বিতীয় বিপ্লবের’ নামে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রণীত ও কার্যকরী হয়। এ সংশোনীর আওতায় দেশে সংসদীয় সরকারের পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করা হয় - যা ছিল একটি 'টোটেলিটারিয়ান’ রাষ্ট্রেরই সমার্থক। 'মুজিববাদ’কে আদর্শ করে 'বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরী করা হলো। অন্য সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে এবং মত প্রকাশের সকল স্বাধীনতা হরণ করে দেশে যে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তা একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রেরই নামান্তর। মাত্র চারটি সংবাদপত্র সরকারী নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশের বাকী সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। 'এক নেতা - এক দেশ : বঙ্গবন্ধু - বাংলাদেশ’ - এ ছিল 'বাকশালী’ সরকারের 'সোনার বাংলা’ গড়ার 'দ্বিতীয় বিপ্লবের’ শ্লোগান। এসব পরিবর্তনের ফলে দেশের সংবিধানের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ঠ্যসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ভোল পাল্টে স্বৈরাচারী রূপ ধারণ করবে এটা জনগণ কল্পনা করতে পারেনি। একটি নব্য স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এটা ছিল প্রচন্ড হোচট। জনগণের শাসনের নামে এই বাকশালী একদলীয় শাসন ছিল দেশের মানুষের নিকট অপ্রত্যাশিত এবং রাজনৈতিক দিগন্তে এক অশনি সংকেত। মস্কোপন্থীদের অনুপ্রেরণায় এক ভুল পথ ধরে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল বঙ্গবন্ধুর মত গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, যার পরিণতি হয়েছিল খুবই দুঃখজনক।
গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটায় দেশে 'বাম সহিংস রাজনীতির’ উদ্ভব হয়। এসময় 'জাসদ’ ও 'নক্সালপন্থীদের’ বিপ্লবী তৎপরতা বেড়ে যায়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্য সংকটের পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি, চরম অর্থনৈতিক অরাজকতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের গরীব ও ভূমিহীন মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। ফলে অনাহারে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের 'গণহত্যার’ পর এ দুর্ভিক্ষ ছিল বাংলার জনগণের ওপর আরেক নীরব ঘাতক। দুর্ভিক্ষের আবর্তে পড়ে 'সোনার বাংলার’ স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে বাংলাদেশ 'শ্মশানের’ রূপ ধারণ করলো। 'বাকশালী’ সরকার খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। পঁচাত্তরের আগষ্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয় এবং বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৃশংসভাবে সপরিবারে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহকর্মী খোন্দকার মোস্তাক আহমদ ছিলেন এ পট পরিবর্তনের নায়ক যিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে দেশে সামরিক আইন জারী করেন। আর তখন থেকেই শুরু হয় একটি নব্য স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। দেশের ভাগ্যে 'তলাবিহীন ঝুড়ি’ খেতাবের সাথে 'সহিংস রাজনীতির’ আরেকটি পালক যুক্ত হলো। সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এখনও 'বাংলাদেশ: দ্যা টেষ্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ উন্নয়নের 'গিনিপিগ’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, অদম্য সাহস ও প্রাণশক্তির বলে শত দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলা করেও বাংলাদেশের মানুষ টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর প্রমাণ 'ইউএনডিপি’র সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে বাংলাদেশের লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি। (সমাপ্ত)
বিষয়: বিবিধ
১২০৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন