সোনার বাংলা শ্মশান হওয়ার উপাখ্যান - পর্ব: ৫
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:২০:৫৭ সকাল
ভারতের স্বাধীনতার রূপরেখা তৈরীর ব্যাপারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বৃটিশ সরকারের 'কেবিনেট মিশন প্ল্যানটি’ বাতিল হয়ে যায়। এরই সাথে অখন্ড ভারতের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কংগ্রেসের 'কুইট ইন্ডিয়া’ এবং মুসলিম লীগের 'পাকিস্তান আন্দোলনের’ ডামাডোলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরই পরিণতিতে ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট বাংলা দ্বি-খন্ডিত হয়ে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্ত হয়। সীমান্ত নির্ধারণী কমিশন প্রধান রেডক্লিফের রোয়েদাদে বাংলাকে এমনভাবে বিভক্ত করা হয় যার ফলে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চলসহ রাজধানী কোলকাতা নগরী পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান এক অনগ্রসর কৃষি ও দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কোলকাতা নগরীর বিত্ত-বৈভব তৈরীতে পূর্ববঙ্গের বিরাট অবদান থাকলেও দেশ বিভাগের পর এর কানাকড়িও তার ভাগে পড়েনি। দেশ বিভাজনের পর উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মুসলিম পরিবার সমুহ পূর্ববঙ্গে পাড়ি জমায়। অনদিকে পুর্ববাংলার অধিকাংশ শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী হিন্দু ব্যক্তিবর্গ ভারতে চলে যায়। ফলে পূর্ববঙ্গের স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দেয় এবং ব্যবসায়িক মন্দার সৃষ্টি হয়। উদ্বাস্তু পুণর্বাসন অর্থনৈতিক সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করে। ভারতের ধনী মুসলিম ব্যবসায়ীগণ প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে তাদের ব্যবসা স্থানান্তরিত করেন। ফলে সেখানকার অর্থনীতি লাভবান হয়।
নব্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের রাজধানী প্রথমে করাচীতে স্থাপিত হয় এবং পরবর্তীতে তা ইসলামাবাদে স্থানান্তরিত হয়। পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় স্থাপিত হয়। হাজার মাইলের ব্যবধানের দুটি ভৌগলিক অঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের মানুষ একই ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন। তবে আশা ছিল এ নব্য দেশের দুটি অঞ্চলের মানুষ ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নীতিতে অটল থাকতে পারলে তারা তাদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতে পারবে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! এক ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে মুক্ত হয়ে আরেক নব্য উপনিবেশবাদী শক্তির জালে আটকা পড়লো পূর্ব বাংলা। মিঃ জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তানে একটি কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে ওঠে। পাকিস্তানের রাজধানী, কেন্দ্রীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে চলে যায়। পাকিস্তানের সূচনা লগ্নেই কেন্দ্রীয় সরকার ইসলামী ঐক্যের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা করে বসে । শুরু হয় পুর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাথে বৈমাত্রেয় আচরণ। প্রথমেই তারা উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে অপাঙ্ক্তেয় করে রাখার চক্রান্ত করে। ফলে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবীতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তুমুল গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে। এ দেশের রাজনীতিবিদ, ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিী সমাজ জেল-যুলুম উপেক্ষা করে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী বুকের তাজা রক্ত ঢেলে তারা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করে। তখন থেকেই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ১৯৪৯ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, ইয়ার মোহাম্মদ খান ও শামসুল হকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এতে যোগদান করেন। নুরুল আমীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার বাঙ্গালীর স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হলে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক নির্বাচনে শেরে-বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ’যুক্ত ফ্রন্টের’ নিকট মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারকে হঠিয়ে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খাঁ ক্ষমতা দখল করে। দেশের শাসনতন্ত্র বাতিল করে দেয় এবং সামরিক শাসন জারী করে। সামরিক সরকার দেশবরেণ্য নেতাদেরকে কারারুদ্ধ করে। ফলে পাকিস্তানে গণতন্ত্র বন্দী হয়ে পড়ে। জাতির এ ঘোর দুর্দিনে দেশের ছাত্র ও সাংবাদিক সমাজ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। 'দৈনিক ইত্তেফাক’ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গণতন্ত্র পুণপ্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীকে হাতিয়ার করেন। এরই মধ্যে শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ১৯৬১ সালে ইন্তেকাল করেন। এর বছর তিনেক পর ১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও মৃত্যু বরণ করেন। এ দুই মহান নেতার শূণ্যস্থান পূরণ করেন তাদেরই উত্তরসূরী বাঙ্গালীর উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আওয়ামী লীগকে পুণর্গঠন করেন এবং এর অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৬৬ সালে শোষিত-বঞ্চিত বাঙ্গালী জাতি স্বায়ত্ব শাসনের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি জাতিকে ৬-দফার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এর পরিণতিতে অকুতোভয় শেখ মুজিব জেল-জলুম ও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। আইয়ুব সরকার তাঁকে ’আগরতলা ষড়যন্ত্র’ ও 'দেশদ্রোহীতার’ অভিযোগে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দী করে বিচার শুরু করে। প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের ১১-দফা দাবীর অনুকূলে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ একের পর এক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতে থাকেন। দেশের এ সঙ্গিন মূহুর্তে মজলুম জননেতা অশীতিপর মওলানা ভাসানী গণ-আন্দোলনের হাল ধরেন। তিনি পল্টন ময়দানের জনসভা সভা থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট অভিমুখে যাত্রা করেন। জনতার প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যায়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারীতে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন গণ-জোয়ারে পরিণত হয়। ফেব্রুয়ারীতে শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন এবং 'বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন। এ সময় পাকিস্তানের উভয় অংশে আইয়ুব বিরোধী উত্তাল গণ-জোয়ার সৃষ্টি হলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খাঁকে সরিয়ে তাঁর প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ ক্ষমতা দখল করেন। তিনি জনগণের দাবীর মুখে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে দেশ ব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য হন। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তানের 'পিপোলস্ পার্টির’ নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো সাথে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আলোচনার নামে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র কাল ক্ষেপনের সুযোগ নেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল সেনা ও মরণাস্ত্রের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। এ আলোচনা ব্যর্থ হলে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা শেখ মুজিবকে বন্দী করে। ঐ রাতেই তারা 'অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সামরিক অভিযান চালিয়ে দেশ জুড়ে বাঙ্গালী নিধন যজ্ঞে মেতে ওঠে। দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় তখন থেকেই। ৯-মাস ব্যাপী তীব্র যুদ্ধের পর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লাখো লাখো শহীদের রক্তে রঙ্গীন হয়ে বাংলার আকাশে বিজয়ের পতাকা উত্তোলিত হয়।
বাঙ্গালী জনগণের জন্য নব্য-উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী শাসন কালীন দুইটি যুগ ছিল বৈষম্য ও শোষণের। দেশটির কেন্দ্রীয় প্রশাসনে এবং সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানের জনবল ৯৫% এর বেশী থাকায় উন্নয়নের সিংহভাগ সেখানেই বাস্তবায়িত হতে থাকে। পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় প্রশাসনে এবং কেন্দ্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে পূর্ববাংলার জনগণের অংশগ্রহণের তেমন কোন সুযোগ ছিল না। এসব উন্নয়নের সুফল সেখানকার জনগণ ভোগ করতে থাকে। পূর্ব বাংলার বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস ছিল পাট, চা, চামড়া। পাট ও চায়ের ফলন পুরোটাই পূর্ব বাংলায় হলেও এর রপ্তানী বাণিজ্য ছিল পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে পূর্ব বাংলার রপ্তানী থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিমাঞ্চলের আমদানী পণ্যের চাহিদা মেটাতে এই অর্থ ব্যয়িত হতো, অথচ বঞ্চিত হতো পূর্বাঞ্চল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতিমালা ও বাজেট বরাদ্দ পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে থাকায় পূর্ব বাংলা বঞ্ছনার শিকার হতে থাকে। শুল্ক, আমদানী, শিল্প ও বাণিজ্যিক লাইসেন্স, ব্যাংক ঋণ, ইত্যাদি অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ পশ্চিমের জনগণ ভোগ করতে থাকে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। পুর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমের পণ্যের বাজারে পরিণত করা হয়। বিশ্ব বাজারে এসব পণ্য মানে উন্নত এবং দামে সস্তা হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের আমদানী ও শুল্ক নীতির কারণে এদেশের জনগণ পশ্চিমের পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। ফলে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠে। শিক্ষা, যোগাযোগ ও অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, কৃষি ও সেচ ইত্যাদি খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ ঘটে। অথচ পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে এসব খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। উন্নয়নের যাত্রায় এ বৈষম্যের মাত্রা আমরা নি¤েœর তথ্য থেকে বোঝার চেষ্ট করব।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের চিত্রটি প্রথমে তুলে ধরা যাক। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব বাংলা সংখ্যাগরিষ্ট হলেও বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে তার অংশ সব সময়ই কম ছিল। ১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত সময়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় বাজেটের মোট ব্যয় বরাদ্দ থেকে ১১,৩৩৪ কোটি টাকা পায় পশ্চিম পাকিস্তান, এর বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে ৪,৫৯৩ কোটি টাকা অর্থাৎ যার পরিমাণ ৪০.৫% ( Reports of the Advisory Panels for the Fourth Five Year Plan 1970-75, Vol. I, published by the Planning commission of Pakistan) । ১৯৪৮-৬০ পর্যন্ত দেশের রপ্তানী আয়ের ৭০% অর্জিত পূর্ব পাকিস্তান খেকে অথচ এখানে আমদানী খাতে ব্যয় হয় মাত্র ২৫%। পাকিস্তানের বৈদেশিক উন্নয়ন ঋণ পূর্ব পাকিস্তানের অংশে অতি অল্প জুটলেও, ঋণ পরিশোধের বেলায় এখানকর অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় তা পরিশোধ করা হত। বৈদেশিক সাহয্যের এক-তৃতীয়াংশ এবং উন্নয়ন সাহায্যের ১০% পূর্ব বাংলার ভাগে পড়ে। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মোট ৩.১০০ কোটি টাকার সম্পদ পশ্চিম পাচার হয়ে যায় ১৯৭১ সালের ডলার মূল্যে (১ ডলার = ১১.৯০ টাকা) যার পরিমাণ ছিল ২৬০.৫০ কোটি ডলার। পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১৯৪৯-৫০ এ ছিল ২৮৭ টাকা ১৯৬৯-৭০ এ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩১ টাকা। এর বিপরীতে একই সময়ে পশ্চিমের মাথাপিছু আয় ৩৩৮ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩৭ টাকায়। এ বৃদ্ধির হার পূর্বাংশে ছিল .০৭% আর পশ্চিমাংশে ২% অর্থাৎ প্রায় ৩ গুণ বেশী (Third Five Year Plan of Pakistan, p. 11, and Report of the Panel of Economists on the Fourth Year Plan (1970–75), p. 132) । গ্রাম বাংলায় দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়ে প্রান্তিক চাষী ও ভূমিহীন চাষীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ১৯৭০ এ ভূমিহীন পরিবারের অনুপাত ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের সূচনা কালে পূর্বাংশে ছিল ১১টি বস্ত্র কারখানা, পশ্চিমাংশে ছিল ৯টি। ১৯৭১ সালে পুর্বাংশে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬টি আর পশ্চিমাংশে তা বৃদ্ধি পায় ১৫০টিতে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য ছিল আরো করুণ। দুর্ভাগ্যের বিষয় পাকিস্তান আমলে পুর্ব বাংলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে যায়। ১৯৪৮ সালে এখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২৯,৬৩৩ যা কমে গিয়ে ১৯৭০ সালে দাঁড়ায় ২৮,৯০৮। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে একই সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮,৪১৩ থেকে বেড়ে ৩৮,৯০০ তে পৌঁছে। কি আশ্চর্য! জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব বাংলায় এই সংখ্যা যেখানে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেখানে শিক্ষাখাতে অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে তা কমে গেল। আর পশ্চিম পাকিস্তানে তা প্রায় ৪ গুণের মতো বৃদ্ধি পেলো। পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিদ্যমান স্কুলগুলোতে স্থান ও শিক্ষক সঙ্কুলান এক প্রচন্ড সমস্যায় পরিণত হল। সুযোগ-সুবিধার অভাবে শিক্ষার মান কমলো এবং ঝরে-পড়ার হার বেড়ে গেলো। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ৩,৪৮১ - তা বেড়ে ১৯৭০ সালে এ সংখ্যা দাাঁড়ায় ৫,৬৯৪। ওই একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা ২,৫৯৮ থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৫,৬০০। এ ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার পূর্ববঙ্গে কম ছিল। ১৯৫১-৬১ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ৪১,০০০ থেকে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৮,০০০। অপরদিকে একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে এই সংখ্যা ৪৫,০০০ থেকে বেড়ে ৫৪,০০০ এ ওঠে। পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ১৯৫১-৬১ পর্যন্ত পূর্ব বঙ্গে ৮,০০০ থেকে কমে ৭০০০ এ দাঁড়ায়। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা ১৪,০০০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৪,০০০ এ পৌঁছে। ১৯৫১-৬১ সময় কালে পূর্ববঙ্গে শিক্ষিতের হার ১৮.৮% থেকে ১৯.৯% এ বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ বৃদ্ধির হার মাত্র ১%। এর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে এ বৃদ্ধির হার ছিল দ্বিগুণ, সেখানে শিক্ষিতের হার ৭.৬% থেকে বেড়ে ১৪.৪% এ পৌঁছে। Fifty years of Pakistan in statistics এর সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এই বৈষম্যের চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এই যে করুণ বৈষম্য তা প্রতিফলিত হয় সমগ্র অর্থনীতির ক্ষেত্রে। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক খাতে এ বৈষম্য এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনে পূর্ববঙ্গের নগণ্য প্রবেশাধিকার পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বন্ধনকে শিথিল করে দেয়। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর মুখে ইসলামী ঐক্যের দোহাই ছিল ফাঁকা বুলির মতো। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পূর্ণ অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানীরা নিজেদেরকে সামরিক জাতি হিসেবে গণ্য করে। তাই সামরিক শাসন ছিল তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে গণতন্ত্রমনা পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর প্রতি ছিল সন্দিহান। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ছিল প্রবল। পূর্ব বাংলার জনগণের দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী এতই উদাসীন ছিল যে, ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর যখন পূর্ব বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় তারা ছিল অনেকটা নিঃস্পৃহ। সেখানকার কোন নেতৃবর্গ তাৎক্ষণিকভাবে দুর্গত এলাকায় যান নি। তাদের এধরনের নির্লিপ্ত আচরণ বাঙ্গালী জাতিকে খুবই মর্মাহত করে। মওলানা ভাসানী তাদের এ আচরণের প্রতিবাদ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ দাবী করেন। ষাট দশকের মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সমাজ ছিল অত্যন্ত অধিকার সচেতন। পাকিস্তানী শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের বিক্ষুব্ধ মানুষের মধ্যে ক্রমশ বিক্ষোভের দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের গণপরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ছিল তাদের এ মনোভাবের সুস্পষ্ট প্রকাশ। এরই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১২৮৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন