সোনার বাংলা শ্মশান হওয়ার উপাখ্যান - পর্ব: ৪
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৮ নভেম্বর, ২০১৪, ১১:৫০:০৪ রাত
বৃটিশ শাসনামলের শুরুতেই হিন্দু সমাজ বৃটিশ শাসকদের স্বাগত জানায়। ফলে তারা বৃটিশের অনুগত প্রজা হিসেবে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পায়। ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করে তারা অফিস-আদালতে চাকুরী পেতে থাকে। ফলে হিন্দুরা একটি অগ্রসরমান সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়। জমির খাজনা সংগ্রহের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রণয়ণের ফলে সমগ্র বাংলা জুড়ে নব্য জমিদার শ্রেণীর অভ্যূদ্বয় ঘটে। এসব জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ’উঠতি ভদ্দরলোক’ এ জমিদার শ্রেণী প্রজা শোষণ ও নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলার কৃষক সমাজ এদের অত্যাচার ও শোষণের ফলে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জমিদারবাবুগণ তাদের জমিদারী এলাকায় বসবাস না করে বৃটিশ স্থাপিত রাজধানী কোলকাতা শহরে বিলাসী জীবনযাপন করতেন। তাদের মধ্যে জাত্যাভিমান এমনই প্রবল ছিল যে, তারা নিজেদেরকে ’ভদ্দরলোক বাবু’ মনে করতেন আর গ্রামের মুসলিম কৃষক প্রজা ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরকে তারা ’বাঙাল’ বলে সম্বোধন করতেন। তাদের অধিকাংশের এ উন্নাসিক মনোবৃত্তি হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয় এবং এ দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যকে কখনও সফল হতে দেয়নি। জমিদার শ্রেণীর আভিজাত্যবোধ ও সামন্তবাদী মনোভাবের কারণে তারা তৃণমূল মানুষের নিকট থেকে দূরে সরে যায়। ফলে গ্রামীণ কৃষকসমাজের দুঃখ-দুর্দশা দেখার মত কেহই ছিল না। এসময় হিন্দু-মুসলিম সামাজিক বিভাজন খুবই প্রকট হতে শুরু করে। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাহিত্যি ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ”আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” গ্রন্থে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের একটি তুলনামূলক চিত্র তোলে ধরেন। তাঁর অনুকরণে সামাজিক চিত্রটা কিছুটা এভাবে উদ্ধৃত করা যায়: হিন্দুরা জমিদার - মুসলমানরা তাদের রায়ত, হিন্দুরা পদস্থ কর্মচারী - মুসলমানরা পেয়াদা-চাপরাশি, হিন্দুরা উকিল-মোক্তার - মুসলমানরা মক্কেল, হিন্দুরা মহাজন - মুসলমানরা খাতক, হিন্দুরা শিক্ষক - মুসলমানরা শিক্ষার্থী, হিন্দুগণ চিকিৎসক - মুসলমানগণ চিকিৎসার্থী। বৃটিশ শাসনামলে বাঙালী সমাজের চিত্রটা ছিল এমনই। অগ্রসর হিন্দু সমাজের নিকট বাঙালী মুসলমানরা ছিল এক অচ্যুৎ সম্প্রদায়।
উনবিংশ শতাব্দী ছিল বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের নব জাগরণের যুগ। এ যুগের সূচনা করেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৫-১৮৩৩)। তাঁর নেতৃত্বে এবং ইংরেজদের সহায়তায় ১৮১৭ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিন্দু কলেজ। এ ছাড়া সে সময় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, শ্রীরামপুর কলেজ (Serampore College), সংস্কৃত কলেজ, কোলকাতা মেডিকেল কলেজ, ইত্যাদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব কলেজের হিন্দু শিক্ষার্থীরাই বাংলায় রেনেঁসা যুগের প্রবর্তন করেন। ১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটি আধুনিক জ্ঞানের মশাল প্রজ্জ্বলনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। এরই ধারায় বাংলার নবজাগরণকে সমৃদ্ধ করেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয় কুমার দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র মুখপোধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমুখ মনীষীবৃন্দ। শরৎ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চিত্ত রঞ্জন দাশ, সুভাস চন্দ্র বসু, প্রমুখ বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদগণ এ ধারাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান। শিক্ষা, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এসব মনীষীর অবদান ছিল বিশাল - যা হিন্দু সমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ঠিক এর উল্টো চিত্র ছিল মুসলিম সমাজের। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম শাসকবর্গ বৃটিশ আনুগত্য মেনে নিতে অনাগ্রহী ছিল। বৃটিশরাও তাদেরকে শত্রু গণ্য করে তাদেরকে সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখে। বিধর্মী শাসকদের ক্রমাগত বঞ্চনা ও উপেক্ষার শিকার হয়ে মুসলিম আলেম-ওলেমা, মধ্যবিত্ত ও ধনাঢ্যশ্রেণী ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ সংঘটিত করতে থাকে। ইংরেজ শাসনের প্রথম শতক ছিল বিক্ষোভ ও ঝঞ্ঝামুখর। বাংলার মুসলিম সমাজ একের পর এক বিক্ষোভ ও বিদ্রোহে হয়ে পড়ে রণক্লান্ত। এ সময়ে তাদের আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির অবনতি চরমে পৌঁছে। বৃটিশ সিভিল সার্ভেন্ট ও ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার তাঁর ’দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ গ্রন্থে উনবিংশ শতাব্দীর মুসলিম সমাজের দুঃখ-দুর্দশা, পশ্চাদপদতা ও বৃটিশদের সাথে তাদের মনস্তাত্বিক দূরত্বের কথা সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর এ বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থটি বৃটিশ কর্তৃপক্ষ ও কিছু বিদগ্ধ মুসলিম মনীষির দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়।
বাংলার জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম দুটি স্বতন্ত্র ধারা সব সময় বিরাজমান ছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ট অগ্রসরমান অঞ্চল, অপরদিকে পূর্ববঙ্গ ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট পশ্চাদপদমুখী জনপদ এবং কৃষি-প্রধান এলাকা। প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো যুগের চাহিদার সাথে সাড়া দিতে বিলম্ব করায় শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নের ধারায় মুসলমানগণ অনেক পিছিয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক জ্ঞান-মনস্ক চিন্তা-চেতার উন্মেষ ঘটতে শুরু করে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ছিলেন বিশিষ্ঠ সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ স্যার সৈয়দ আহমদ। ১৮৭৫ সালে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ’মোহামেডান এঙ্গলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’ যা ’আলীগড় কলেজ’ নামে সমধিক পরিচিত। এই কলেজকে কেন্দ্র করে তাঁরই নেতৃত্বে সূচিত হয় মুসলিম জাগরণের ’আলীগড় আন্দোলন’। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমাজকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির নমুনায় প্রতিষ্ঠা করেন ’আলীগড় সায়েন্টিফিক সোসাইটি’। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আলীগড় হয়ে ওঠে সমগ্র উপমহদেশের মুসলিম জনগণের শিক্ষা-দীক্ষার এক পীঠস্থান। প্রথম দিকে তিনি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারতের দুইটি চোখের সমতুল্য মনে করতেন। এ দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের জন্য তিনি কাজ করতে থাকেন। কিন্তু তাঁর এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি উপলব্ধী করতে পারেন হিন্দু ও মুসলিম দুইটি পৃথক জাতি সত্তা - তাদের ঐক্য সুদূরপরাহত। এরপর তিনি পিছিয়ে-পড়া মুসলিম সমাজের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যান। তাঁরই উত্তরসূরীগণ পরবর্তীতে একটি স্বতন্ত্র জাতি সত্তা হিসেবে মুসলমান সমাজ গঠনের নেতৃত্ব দেন।
বাংলার মুসলিম জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন বিশিষ্ঠ শিক্ষাবিদ নবাব আব্দুল লতিফ। তিনি বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি কোলকাতার হিন্দু কলেজকে প্রেসিডেন্সী কলেজে রাপান্তরিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এর ফলে সেখানে মুসলিম ছাত্রদের পড়াশুনার সুযোগ তৈরী হয়। এর আগে ওই কলেজে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মালম্বীদের ভর্তি নিষিদ্ধ ছিল। এ ছাড়া তিনি আরও কয়েকটি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬২ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের প্রথম মুসলমান সদস্য মনোনীত হন। মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে আন্দোলন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৮৬৩ সালে তিনি ’মোহামেডান লিটারারী সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরের বছর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নিযুক্ত হন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় হতাশগ্রস্ত ও অসংগঠিত মুসলিম সমাজ আশার আলো দেখতে পায়। নীল চাষীদেরকে ইংরেজ কুঠিয়ালদের শোষণ-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষায় ’নীল কমিশন’ গঠনে তিনি কার্যকর ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজের আরেক পথিকৃৎ ছিলেন প্রখ্যাত গ্রন্থকার, বিচারক, আইনবিদ ও সংস্কারক সৈয়দ আমীর আলী। প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় থেকে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকাটা তাঁর নিকট অসহনীয় ছিল। রাজনীতি সচেতন এই মনীষী তাঁর প্রতিষ্ঠিত ’সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান এসোসিয়েশন’ এর মাধ্যমে মুসলমানদেরকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করেন। তিনি মুসলিম লীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদ ও গভর্ণর জেনারেলের আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে মুসলিম সমাজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন।
১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতিগোষ্ঠীর মুখপাত্র হওয়ার পরিবর্তে ক্রমশ হিন্দু প্রভাবিত একটি রাজিৈতক প্ল্যাটফরমে পরিণত হয়। সেখানে মুসলমানদের কন্ঠস্বর ছিল ক্ষীণ। মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবী-দাওয়াগুলোকে পাত্তা দিতে অনীহ ছিলেন হিন্দু সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার মুসলিম জনগণ একটি স্বতন্ত্র জাতি সত্তা হিসেবে সংগঠিত হওয়ার প্রয়াস পায়। বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থান পর্ব শুরু হয় এ সময়টিতে। ১৯০৫ সালে বৃটিশ ভারতের গভর্ণর লর্ড কার্জন প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বাংলা প্রেসিডেন্সীকে ভাগ করে অনগ্রসর পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করেন এবং ঢাকাকে এর রাজধানী করা হয়। এ পদক্ষেপ পূর্ব বাংলার অনগ্রসর মুসলমাদের জন্য উন্নয়নের এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে। কিন্তু কোলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু সমাজ তা মেনে নিতে পারে নি। এ বিভাজন পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর তাদের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। হিন্দু জমিদার, পেশাজীবি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী তাদের শোষণ ও কায়েমী স্বার্থহানি ঘটার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে বঙ্গ-ভঙ্গ রদ ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন। এ আন্দোলন সহিংসতার রূপ ধারণ করলে ১৯১১ সালে বঙ্গ বিভাজন রদ করে দেওয়া হয়। এটি বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ছিল খুবই হতাশব্যঞ্জক ও বেদনাদায়ক। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। বাঙালী মুসলমানের জাগরণের এ সময়টিতে তাদের নেতৃত্ব দেন নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব আলী চৌধুরী, শেরে-বাংলা এ, কে, ফজলুল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী। পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বে যুক্ত হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীন, আবুল হাশিম, মাওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, হাবিবুল্লাহ বাহর চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। বাংলার মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে যেসব বরেণ্য সাহিত্যিক ও সাংবাদিক অসামান্য ভূমিকা রাখেন তাঁরা হলেন: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ইসমাইল হেসেন সিরাজী, ভাষাবিদ ডঃ শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়া, কবি গোলাম মোস্তফা, আব্দুল ওয়াদুদ, সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ’দৈনিক আজাদ’ ও মাসিক ’মোম্মদী’ সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ, প্রমুখ মনীষীবৃন্দ। এছাড়া ধূমকেতু, সওগাত, বুলবুল, নবযুগ, যুগবাণী, প্রভৃতি সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রখ্যাত মুসলিম সাহিত্যিক ও লেখকদের রচনা সামগ্রী মুসলমানদের আধুনিক চিন্তা-চেতনায় এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটায়। তাঁরা সবাই চেয়েছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপক জাগরণ।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ শুরুতে ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সারির একজন নেতা। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে একটি ঐক্য চুক্তি সম্পাদিত হয় যা ’লৌক্ষ্ণ প্যাক্ট’ নামে পরিচিত। তাঁর এ বিশেষ অবদানের কারণে তাঁকে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব যখন এ চুক্তি থেকে সরে এসে মুসলিম স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিল তখন জিন্নাহ্ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে পুরোপুরি মুসলিম লীগের হাল ধরলেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক ছিলেন বাংলার আরেক প্রখ্যাত নেতা দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫)। তিনি উপলব্ধী করেন, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্টনের নীতি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সুসংহত করবে। হিন্দু-মুসলিম সাম্য ও ঐক্যের লক্ষ্যে তিনি ১৯২৩ সালে ’বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে একটি চুক্তি তৈরী করেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ এ চুক্তিকে স্বাগত জানালেও হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মুখে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সভা সেটি বাতিল করে দেয়। অদম্য চিত্ত রঞ্জন সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে এ চুক্তির অনুমোদনের প্রচেষ্ট চালান। কিন্তু তাঁর অকাল মৃত্যুতে এ মহতী উদ্যোগের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলার বিদ্রোহী কবি সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে ওঠে নিজেকে একজন খাঁটি অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। হিন্দু-মুসলিম মিলনের জন্য তিনি তাঁর কবিতা ও গানে উদাত্ত আহ্বান জানান। কোন হিন্দু কবি-সাহিত্যিক নজরুলের মতো সামপ্রদায়িকতার এত উর্ধে ওঠতে পারেন নাই। তাঁর গানের দুটি চরণ ছিল: ”মোরা একই বৃন্তে দুটী কুসুম হিন্দু-মুসলমান / মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ”। তাঁর এ আহ্বান সামপ্রদায়িকতার উন্মাদনাকে প্রশমিত করতে পারেনি। স্বার্থান্ধ হিন্দু ’ভদ্দরলোক’ সমাজের নেতৃবৃন্দের ক্রমাগত বিরোধিতা তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দকে তাঁদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন হিন্দু-মুসলিম স্বার্থের দ্বন্দ্বে দুটি স্বতন্ত্র ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। এর পরিণতিতে চল্লিশের দশকে ভারত-বিভাজন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তখন শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ১৯৪৭ সালে বাংলার মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ’স্বাধীন যুক্তবাংলার’ পক্ষে দাবী তুলেন। কিন্তু এবার সেই ’বঙ্গ-ভঙ্গ রদ ও স্বদেশী আন্দোলনের’ ধ্বজাধারীদের উত্তরসূরী কোলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু নেতৃবর্গ ’স্বাধীন যুক্তবাংলা’ দাবীর তীব্র বিরোধীতা করেন। তাদের আশঙ্কা ছিল রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে-ওঠা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়কে দাবিয়ে রেখে তাদের ওপর আর শোষণ-নির্যাতন চালানো যাবে না। তাদের চাপে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্বাধীন যুক্তবাংলার দাবীটি নস্যাৎ করে দেন। এভাবে হিন্দু-মুসলিম মিলন প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হলো বলে বাধ্য হয়েই বিভক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো মুসলিম লীগকে।
বৃটিশ ভারতের ইতিহাসে শেরে-বাংলা এ, কে, ফজলুল হক ছিলেন এমনই এক নেতা যাঁর কিছু কার্যকর আইনী পদক্ষেপ বাংলার কৃষক সমাজ তথা আপামর জনসাধারণকে খুবই উপকৃত করে। তিনি ছিলেন বাংলার অত্যাচরিত ও নিপীড়িত কৃষক সমাজের দরদী নেতা। অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষায় তিনি ছিলেন কৃতসংল্প। ১৯৩৭-৪১ সালে তিনি বৃটিশ বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের অনুকূলে আইন (Bengal Agricultural Debtors’ Act - 1938) পাশ করেন। ঋণ সালিসী বোর্ড গঠন করেন এবং মহাজনী আইন (Money Lenders’ Act - 1938) পাশ করে ঋণ-জর্জরিত কৃষকদেরকে মহাজনী ঋণ থেকে মুক্ত করে তাদের বন্ধকী সম্পত্তি উদ্ধার করেন। এ সময়ে তিনি প্রজাস্বত্ব সংশোধনী আইন (BENGAL TENANCY (AMENDMENT) ACT - 1938) পাশ করে জমিদারগণ কর্তৃক অন্যায়ভাবে জমির খাজনা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন উপলক্ষে আরোপিত সব ধরনের ’আবওয়াব’ ও ’সেলামী’ গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন। এ আইনের আওতায় কৃষক তার জমি বিক্রী বা হস্তান্তরের সময় জমিদারকে দেয় কর থেকেও মুক্তি লাভ করে। বকেয়া খাজনার সুদ ১২% থেকে কমিয়ে ৬.২৫% করা হয়। তা ছাড়া ৪ বছরের খাজনা পরিশোধের বিনিময়ে নদী সিকস্তি জমির মালিকানাও কৃষকদেরকে দেওয়া হয়। ভোক্তভোগী কৃষকেরা এসব সংস্কারের প্রত্যক্ষ সুফল লাভে সমর্থ হয়। শেরে-বাংলার প্রধান মন্ত্রীত্বকালে শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষের অনুকূলে আইন পাশ করেন যার ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে। সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেন। ফলে তাদের সরকারী চাকুরী লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাংলার দুঃখী মানুষ এসব জনকল্যাণমূলক সংস্কারের সুফল লাভের সূচনা লগ্নেই মানব-সৃষ্ট আরেক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। বৃটিশ সরকারের ’পোড়া-মাটি’ নীতির কারণে কীভাবে ১৯৪৩ সালে দেশে খাদ্য সঙ্কটের সৃষ্টি হয় এবং নিম্ন-আয়ের লক্ষ লক্ষ মানুষ মহাদুর্ভিক্ষে পড়ে প্রাণ হারায় তা আগের পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৫৮৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হিন্দু জাগর বলে যেটাকে দাবি করা হয় সেটা প্রকৃতপক্ষে ব্রাম্মন্যবাদিদের জাগরন। সেখানে সাধারন নিন্ম শ্রেনির হিন্দুদের বিশেষ লাভ হয়নি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন