সোনার বাংলা শ্মশান হওয়ার উপাখ্যান - পর্ব: ৩

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৫ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:২১:০১ রাত

এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব নীতির ওপর ভিত্তি করে বৃটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে তার শাসন ও শোষণ প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়। তারা এ দেশের অর্থ-সম্পদ নিজ দেশ বৃটেনে পাচার করতে শুরু করে। ভারতের শিল্প ও বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ভারতকে কাঁচামাল উৎপাদনের ক্ষেত্র ও বৃটিশ পণ্যের এক বিরাট বাজারে পরিণত করে। বৃটিশ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এদেশে তাদের দুঃশাসন, শোষণ ও লুন্ঠনের কারণে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে আসে। বাংলা ১১৭৬ বাংলা সনে (১৭৭০ খৃষ্টাব্দে) বিশ্ব-ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষটি সংঘটিত হয় বিশ্বের এক সমৃদ্ধশালী জনপদ এই বাংলা প্রদেশে - যা এ দেশের ইতিহাসে ’ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় রচিত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে ছিয়াত্তরের সেই ভয়াবহ মন্বন্তরের হৃদয়বিদারক এক করুণ চিত্র ফুটে ওঠেছে। তাঁর বর্ণনায়, ‘এমন ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এদেশের মানুষ অতীতে কখনো প্রত্যক্ষ করে নাই। ১৭৭০ সালের জানুয়ারী থেকে আগষ্ট মাসের মধ্যে এ দুর্ভিক্ষে বাংলাা ও বিহারের প্রায় ১ কোটি মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। ঐ বছর ১৫ই জুলাই থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র দু মাস সময়ে শুধু কোলকাতা শহরেই ৭৬,০০০ লোকের মৃত্যু হয়। কোলকাতার রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি, হাট-বাজার ও কয়েদখানা মৃত মানুষের লাশে ভরে যায়; এসব লাশ সরানোর কাজে লোক পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে। কিন্তু আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো নব-প্রতিষ্টিত বৃটিশ প্রশাসন এ দুর্যোগ ঠেকানোর কোনই ব্যবস্থা নেয়নি’। এই নব্য বেনিয়া প্রশাসন দেশের শাসন ব্যবস্থাকে লুটপাটের হাতিয়ার বানিয়ে ফেলে। তাদের দুবৃর্ত্তিক শোষণ-নিপীড়ন রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় এক চরম অরাজকতার সৃষ্টি করে। আইন-শৃঙ্খলা ও ন্যায় বিচারের যেন কোন অস্তিত্বই ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে যখন দেশ জুড়ে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া বিস্তৃত হতে শুরু করে তখনও লোভী বেনিয়া প্রশাসন তাদের লাভের অঙ্ক বাড়াতেই ব্যস্ত ছিল, মানবতার মূল্য ছিল তাদের কাছে অতি নগণ্য। দুর্ভিক্ষকে সামনে রেখে কোম্পানীর এজেন্টরা ধান-চাল গুদামজাত করা শুরু করল, যা পরিস্থিতিকে আরো অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

ঐতিহাসিক প্রফেসর ডেভিড আরনল্ডের ‘Hunger in the Garden of Plenty: The Bengal Famine of 1770’ গ্রন্থটি ১৭৭০ সালে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে বাংলার মহাদুর্ভিক্ষের ওপর লিখিত একটি গবেষণামূলক দলিল। তিনি এ দুর্ভিক্ষকে মানবিক এক মহাবিপর্যয় বলে চিহ্নিত করেছেন। ১৭৭০ সালের শেষ দিকে এ দুর্ভিক্ষ বাংলার জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবন হরণ করে। ডেভিড আরনল্ড লিখেন, ”এই দুর্ভিক্ষের সাথে এত অধিক পরিমাণ জীবননাশ এবং এত বেশি কষ্ট ও দুর্ভোগ জড়িত ছিল যে, ১৭৭০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষকে ঊনবিংশ শতাব্দী তথা আধুনিক কালের একটি অন্যতম সর্বোচ্চ বিপর্যয় বলে গণ্য করতে হবে”। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন কর্মচারী কোলকাতা থেকে বেনামী চিঠিতে বাংলার এ দুর্ভিক্ষের বিবরণ লন্ডনের বিভিন্ন সংবাদপত্রে পাঠিয়েছিলেন। তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুর্ভিক্ষের এ বিবরণীটি ছিল মর্মবিদারক। এ সময়ে বাংলার খড়াপীড়িত কৃষক সমাজ কিভাবে কোম্পানীর লোভ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কবলে পড়ে লাশে পরিণত হচ্ছিল তার বর্ণনাটি ছিল এমন: ”ততক্ষণে দুর্ভিক্ষটি এ দেশে পক্ষকাল অতিক্রম করেছে, আমরা কোলকাতায় ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম; প্রতিদিন রাস্তায় এবং মাঠে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটছে; তাদের লাশ কুকুর, শৃগাল ও শকুনের দ্বারা বিকৃত হচ্ছে, গরম কালের প্রচন্ডতায় ........ আমরা প্ল্যাগ রোগের পরিণতির আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলাম”(The Annual Register, or a view of the history, politics, and literature, for the year 1771 (London, 1779), 206,)। শুধু পশু-পাখীই নয়, মানুষের লাশ ক্ষুধার্ত মানুষেরও ভক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। এতেও বেনিয়া বৃটিশ প্রশাসনের বিবেকে কোন দহন ছিল না।

এ দুর্ভিক্ষে মানবতার দিকটি বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। এধরনের আরেকটি চিঠিতে মানবিকতা ভূলুন্ঠিত হওয়ার দিকটি ফুটে ওঠে। চিঠিটি লিখেছিলেন কোলকাতা থেকে কোম্পানীর একজন কর্মকর্তা। তিনি বর্ণনা করেন, ”গত ছয় মাস যাবৎ দুর্ভিক্ষ এত প্রকট রূপ ধারণ করেছে যে, কোম্পানীর অধীনস্থ জেলাগুলোতে নমনীয় হিসাবে খাদ্যাভাবে তিন লক্ষের অধিক লোক মৃত্যু বরণ করে”। যদিও প্রাণহনি সংক্রান্ত তার হিসেবটি ছিল নেহায়েৎ কম তবুও এ কর্মকর্তাটির বর্ণনায় আরো ছিল, ”ক্ষুধার তীব্রতা মানুষকে এমনই দুর্দশায় ফেলেছিল যে, দেশের কোন কোন জায়গায় শক্তিমানরা দুর্বলের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো। .... গণদুর্ভোগের সময় বল-নাচ, কনসার্ট ও আমোদ-ফূর্তি কমে যাওয়ারই কথা, কিন্তু আমার বলতে দুঃখই হচ্ছে যে, মোটেই তা কমেনি; এবং এসব প্রমোদ ভবনের দরজা-জানালার নীচে বহু মৃতদেহ পড়েছিল, আর অন্যরা মৃত্যু-যাতনায় কাতরাচ্ছিল” (Weekly Magazine, or, Edinburgh Amusement, "EAST-INDIES," April 11, 1771: 57)। অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত মৃতের সংখ্যা বহুগুন বেশী ছিল। এ প্রসঙ্গে অন্য এক চিঠির লেখক বলেন, ”বাংলা প্রদেশে দুর্ভিক্ষজনিত যে দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল অবিশ্বাস্য। আমি বিশ্বাস করি, আমি সীমার মধ্যে থেকেই বলছি, কমপক্ষে বিশ লাখ মানুষের প্রাণ এ দুর্ভিক্ষে ধ্বংস হয়েছে” (Middlesex Journal or Chronicle of Liberty, "Extract of Letter from Bengal, dated Sept. 16, brought by the Lapwing Packet," March 23, 1771)। এ দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সংখ্যা সম্পর্কে লন্ডনের Public Register এ যা প্রকাশিত হয়েছে তা হলো, ”সমগ্র বাংলা রাজ্য জুড়ে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছে ......। কিছু কিছু চিঠির হিসাব মতে ১৫ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছে, অবার অন্যান্য চিঠির হিসেব অনুযায়ী এর সংখ্যা তিরিশ লাখের কম নয়, কিন্তু তারা সবাই একমত যে, মৃতদেরকে সৎকারের জন্য খুব কম লোকই বেঁচে ছিল” (Public Register or The Freeman's Journal, "LONDON," March 26, 1771)। এ সংক্রান্ত আরো কিছু চিঠি লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

বাংলা-বিহারের তৎকালীন গভর্ণর ওয়ারেন হেস্টিংস দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করা তো দূরের কথা, বরং দুর্ভিক্ষের সময়েও উচ্চ হারে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সচেষ্ট ছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে নব্য বৃটিশ প্রভুর নিষ্ঠুরতম দুঃশাসন, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ছিয়াত্তরের এ মন্বন্তরটিকে এক ব্যাপক ’গণহত্যা’র (Holocaust) সাথে তুলনীয়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, উপমহাদেশের স্বাধীনত লগ্নে অর্থাৎ বৃটিশ শাসন অবসানের মাত্র চার বছর পূর্বে ১৯৪৩ সালে বাংলার মানুষ আবারও আর এক দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। ১৩৫০ বাংলা সনে সংঘটিত এ দুর্ভিক্ষ ’পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের এক জরীপের তথ্য অনুযায়ী এ সময় বাংলার ৩৫ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানী সৈন্য যখন বার্মা সীমান্তে হানা দেয়, তখন বৃটিশ সরকার ‘পোড়া-মাটি’ নীতি অনুসরণ করে এবং খাদ্যশস্য পরিবহণের প্রধান মাধ্যম দেশীয় জলযানসমূহ নির্বিচারে ধ্বংস করে দেয়। একদিকে পরিবহনের সংকটে পড়ে দেশ জুড়ে খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে বৃটিশ সরকার যুদ্ধকালীন খাদ্য মজুত গড়ে তোলার ফলে খাদ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। গরীব জনগণ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষ এ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। রাজধানী কোলকাতার রাস্তাঘাট সহ বাংলার প্রতিটি জনপদে বুভূক্ষু মানুষের লাশের পাহাড় জমে ওঠেছিল। এ দুর্ভিক্ষের ওপর শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের অঙ্কিত স্কেচ এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা করে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এ দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলেন, ফসল উৎপাদন ঘাটতি নয়, কেননা ’৪১ তুলনায় ’৪৩ সালের উৎপাদন বেশীই হয়েছিল, বরং খাদ্য মূল্যের ঊর্দ্ধগতির কারণে সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা লোপ পেয়েছিল এবং নিম্ন আয়ের মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিল। তদুপরি, সরকারের সরবরাহ ও বন্টন নীতি সাধারণ মানুষের অনুকূলে ছিল না।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন পঞ্চাশের এ মন্বন্তর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন অস্ট্রেলিয়ান জৈবরসায়নবিদ ডঃ গিডিওন পল্যা বাংলার এ দুর্ভিক্ষকে মানব-সৃষ্ট ’গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, ”বৃটিশরা ভারতে সহানুভূতিহীন এবং নির্মম এক অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছিল”। তিনি আরও বলেন, ”........ বার্মার চালের আমদানী বন্ধ, মজুতদারী ও মুনাফাখোরীর ওপর সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা মূল্য বৃদ্ধির গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। ১৯৪৩ এর মার্চ-অক্টোবর নাগাদ ঢাকায় চারগুন মূল্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। যেসব ভূমিহীন শ্রমিকেরা খাদ্য কিনে খেত তারাই সবচেয়ে বেশী দুর্দশায় পড়েছিল। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীর এক-তৃতীয়াংশই এ দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিল’। আধুনিক ভারত এবং গ্রেট বৃটেনের অনেক পর্যবেক্ষক বৃটেনের যুদ্ধকালীন উদ্যমী প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলকে দুর্ভিক্ষের ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী করেছেন। ’চার্চিলস্ সিক্রেট ওয়ার’ গ্রন্থের লেখিকা মধুশ্রী মুখার্জী তাঁর বইয়ে বাংলা প্রদেশে দুর্ভিক্ষের অবনতির জন্য চার্চিলকে দোষী সাব্যস্ত করে বলেন যে, ”তিনি দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলের দিকে খাদ্য না পাঠিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত বৃটিশ সৈন্যদের জন্য খাদ্য প্রেরণের আদেশ জারী করেছিলেন”। তাঁর বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ”কিভাবে ভারতের ক্ষুধার্ত মানুষের নিকট অস্ট্রেলিয়ার গম না পাঠিয়ে ভূমধ্যসাগর ও বলকান অঞ্চলে অবস্থানরত বৃটিশ সৈন্যদেরকে তা পাঠানো হয়েছিল। এর চেয়েও বেশী দুঃখজনক ছিল যখন ভারতের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের খাদ্য পাঠানোর উদ্যোগকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছিল”। স্বার্থান্ধ উপনিবেশবাদী শাসকের নিকট মানুষের জীবন ছিল মূল্যহীন, মানবতা ছিল অর্থহীন। বৃটিশ আমলের এ দুটি দুর্ভিক্ষ বিশ্ব ইতিহাসে সর্বকালের এক কলঙ্কময় ও লজ্জাজনক কুকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে বৃটিশরা এ দেশে আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিকাশ শুরু করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে রেলওয়ে ও ষ্টীমার যোগে পরিবহণ ও যাতায়াত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়; টেলিগ্রাফের মাধ্যমে দ্রুত যোগাযোগ চালু হয়; কোলকাতা ও মুম্বাইয়ের মত বড় বড় শহরে বস্ত্রকল, পাটকল, রসায়ন শিল্প, ছাপাখানা, চামড়া শিল্প, ধান ও গম কল, দিয়াশলাই ফ্যাক্টরী, ইত্যাদি মিল-কারখানা গড়ে ওঠে। দেশীয় পুঁজিকে হাতিয়ে নেয়ার জন্য চালু হয়েছিল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ও শেয়ার বাজার। এসবই করা হয়েছিল দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার বিনিময়ে। বাংলা এবং সমগ্র ভারত বৃটিশ পণ্যের বাজারে পরিণত হয়েছিল। বৃটিশ ঔপনিবেশিক নীতির কারণে বাংলার কৃষি ও শিল্প স্থবির হয়ে পড়েছিল। দুইশত বছরের বৃটিশ শাসন এ দেশের কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নে তেমন কোন অবদান রাখতে পারেনি। কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য একোরে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার ফলে বাংলার মানুষ অর্থনেতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। দারিদ্র, ক্ষুধা, অপুষ্টি ও রোগ-ব্যাধি হয়ে পড়ে মানুষের নিত্য সঙ্গী। ’পথের পাঁচালী’, ’অশনি সংকেত’ প্রভৃতি বিখ্যাত উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে এসবের করুণ দৃশ্য ফুটে ওঠেছে। বৃটিশের শাসন-শোষণের গতি অব্যাহত রাখার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু উন্নয়ন তারা করেছিল বটে, তবে তা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ও সামজিক উন্নয়নে তেমন কোন অবদান রাখেনি।

বৃটিশ আমলে মানুষের জীবনযাত্রার মান যে কত নীচে নেমে গিয়েছিল তা বাংলা প্রদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের এক প্রতিবেদনে বিবৃত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ’টাইমস্’ পত্রিকার কোলকাতার প্রতিনিধি ১৯২৭ সালে পহেলা ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেন, ”বাংলার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন যে, রাজ্যের অধিবাসীরা এখন আর তেমন পুষ্টিমানের অথিকারী নন যেমন ছিলেন এক বা একাধিক প্রজন্ম পূর্বে”। বাংলার স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডঃ সি.এ. বেন্টলী তাঁর ১৯২৭-২৮ সালের রিপোর্টে স্বীকার করেন: ”বাংলা প্রদেশেই প্রতি বছর ১৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ঘটে। গড়ে ১৫ বছরের নিম্ন-বয়সী সাড়ে ৭ লক্ষ শিশু প্রতিবছর মৃত্যু বরণ করে - যা সর্বমোট মৃত্যুর শতকরা পঞ্চাশভাগ। শতকরা পঁচিশ ভাগ মানুষ প্রতিরোধযোগ্য ব্যাধিতে মারা যায়। বর্তমান বাঙ্গালী কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকজন যে খাদ্য গ্রহণ করে তা খেয়ে ইঁদুরের মত প্রাণীও পাঁচ সপ্তাহের বেশী বাঁচতে পারবে না। অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে তাদের প্রাণশক্তি এতই দুর্বল যে, যেকোন রোগের সংক্রমণে তারা কাহিল হয়ে পড়ে। গত বছর কলেরায় ১২০,০০০, ম্যালেরিয়ায় ৩৫০,০০০, যক্ষায় ৩,৫০,০০০, আন্ত্রিক রোগে ১০০,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। প্রতি বছর গড়ে ৫৫,০০০ শিশু ধনুষ্টঙ্কার রোগে মারা যায়” (R. Palme Dutt, Notes of the Month INDIA, 1931)। আর এ রিপোর্টের তথ্যই বলে দেয় তারা বাংলার মানুষের কী হাল করে ছেড়েছিলেন। এভাবেই একসময়ের বিশ্বের সমৃদ্ধশালী জনপদ বঙ্গভূমি বৃটিশ শাসনের যাঁতাকলে পড়ে পরিণত হয় দুর্ভিক্ষ-পীড়িত নিঃস্ব এক শ্মশানভূমিতে। (চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১৫৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File