সোনার বাংলা শ্মশান হওয়ার উপাখ্যান - পর্ব: ২
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০২ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:৩৩:৪৫ রাত
সুজলা-সুফলা বাংলার বিপুল সম্পদ ও প্রাচুর্যই এক সময়ে তার দুর্ভাগ্যের কারণ হলো। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বেনিয়া বৃটিশের মানদন্ড দেখা দিল রাজদন্ড রূপে। ১৬৩০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বৃটিশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে বাণিজ্যের জন্য আসে। সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারা এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে। তবে এরা প্রায় সময়ই সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার করত ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করত। ১৭০৫ সালে সম্রাট আওরঙজেবের মৃত্যুর পর মোঘল সম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে। এ সুযোগে বাংলার পরবর্তী সুবেদারগণ স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠেন এবং দিল্লীর নামমাত্র নিয়ন্ত্রণে থেকে স্বাধীন নবাবের মতই শাসন কাজ চালিয়ে যান। ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁ মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর কোন পুত্রসন্তান না থাকায় মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর স্নেহভাজন দৌহিত্র তরুণ সিরাজুদ্দৌলাকে বাংলার নবাব পদে অভিষিক্ত করেন। এতে পারিবারিক দ্বন্দ দেখা দেয় এবং তরুণ নবাব বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হন। এ সুযোগে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও রাজ-কর্মচারীদের সহায়তায় ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে এবং বিপুল পরিমাণে শুল্ক ও কর ফাঁকি দিতে শুরু করে। স্বাধীনচেতা নবাব ইংরেজ বেনিয়াদের এসব চক্রান্ত নস্যাৎ করতে কলিকাতায় অবস্থিত কোম্পানীর বাণিজ্য-কুঠি আক্রমণ করে তা ধ্বংস করে দেন এবং কুঠিয়ালদেরকে বন্দী করেন। এরপর প্রতিশোধ পরায়ণ ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের জাল আরো বিস্তৃত হয়। তারা নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ ও রায় দুর্লভকে প্রচুর উৎকোচের বিনিময়ে হাত করতে সমর্থ হয়। অবশেষে এদেরই বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন এবং পরে নিহত হন। সেই সাথে বাংলার স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নেমে আসে বাংলার কৃষি ও শিল্পের ওপর মহাদুর্যোগ। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বৃটিশ বস্ত্রের বাজারকে সম্প্রসারণ করার জন্য প্রথমেই বাংলার জগদ্বিখ্যাত মসলিন শিল্পকে শক্তি প্রয়োগ ও নির্যাতনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়। ১৭৭২ সালে উইলিয়াম বোল্টস্ তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ’মসলিন তাঁতীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, তাদের কর্মদক্ষতাকে বিনষ্ট করার জন্য তাদের হাতের বৃদ্ধাঙুলী কেটে ফেলা হয়। এর ফলে এত উৎকৃষ্ট মানের মসলিন শিল্পের মান দ্রুত বিনষ্ট হয়ে যায়, যা এখন পর্যন্ত পুণরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি’। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ সাংবাদিক ও সমাজ-বিজ্ঞানী রজনী পাম দত্ত বলেন, ”ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মাচারীরা সুপারী, ঘি. চাল, মাছ, পাট, রসুন, চিনি, তামাক, ইত্যাদি দেশীয় পণ্য এক-চতুর্থাংশ মূল্যে জোরপূর্বক কিনে নিতো” (রজনী পাম দত্ত)। বৃটিশ পণ্যের একচেটিয়া বাজার তৈরীর উদ্দেশ্যে তারা এদেশীয় পণ্যের পরিবহণের ওপর করারোপ করতো। কৃষকদেরকে ধান চাষের পরিবর্তে নীল চাষে বাধ্য করা হতো। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত 'নীল দর্পন’ নাটকে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর নীল কুঠিয়ালদের অত্যাচার-নিপীড়নের এক করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। কোম্পানী আমলে বর্ধিত হারে ভূমি রাজস্ব আদায়, বাজার মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে কৃষকের কাছ থেকে জোরপূর্বক পণ্য ক্রয়, ধানের পরিবর্তে নীল চাষে বাধ্যকরণ এসব নিপীড়নমূলক নীতির কারণে বাংলার কৃষকেরা দ্রুত দারিদ্র্যের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে যায়।
তবে ১৭৯৩ সালে বাংলার গভর্ণর লর্ড কর্ণওয়ালিশ রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আইন জারী করে যে জমিদারী প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন তা গ্রামীণ বাংলার কৃষক সমাজকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। এই আইনের অধীনে বৃটিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ নিলাম ডাকে ধনাঢ্য ব্যক্তিগণের নিকট রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার খাজনা আদায়ের দায়িত্বভার অর্পণ করতো। এসব দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণই হলেন বাংলার নব্য জমিদার শ্রেণী এবং তারা সামন্ত প্রভুর মতই আচরণ করতেন। এ আইনের ৭নং ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী জমিদারগণ খাজনা প্রদানে অনাদায়ী ও অপারগ কৃষকদের জমি ছিনিয়ে নিতে পারতেন। এসব জমিদার তাদের জমিদারী এলাকায় থাকতেন না, সাধারণত বড় বড় শহরেই ছিল তাদের বাসস্থান। তারা নায়েব-পেয়াদা-লাঠিয়াল দ্বারা শোষণ-নিপীড়ন চালিয়ে জমিদারী পরিচালনা করতেন। ফসলহানি কিংবা অসুখ-বিসুখের কারণে গরীব কৃষক খাজনা আদায়ে অসর্থ হলে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়া হতো। কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা দেখার কেউ না থাকায় তাদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়, কৃষিতে নেমে আসে স্থবিরতা । প্রখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন তাঁর 'জমিদার দর্পন’ নাটকে বাংলার কৃষক সমাজের ওপর জমিদারদের অত্যাচার-নিপীড়নের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। একদিকে জমিদার শ্রেণী অন্যদিকে ইংরেজ নীল-কুঠিয়ালদের সম্মিলিত শোষণ ও অত্যাচার নিপীড়নে কৃষকদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি করে। এর পরিণতিতে বাঁশের কেল্লার নায়ক তীতুমীরের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ, ফকির মজনু শাহ্ ও সন্যাসী সীতারামের নেতৃত্বে ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ, কৃষক নেতা নুরুল দীনের সংগ্রাম, সমগ্র বাংলা জুড়ে নীল-বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ সালে সারা ভারত ব্যাপী সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। বৃটিশ কর্তৃপক্ষ তাদের এদেশীয় দোসর অত্যাচারী জমিদারদের সহায়তায় নির্মমভাবে এসব বিদ্রোহ দমন করে।
পন্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর 'দ্যা ডিসকভারী অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বাংলা প্রদেশে বৃটিশ শাসনের প্রভাব সম্পর্কে বলেন যে, 'বৃটিশ-পূর্ব বাংলা নিশ্চিতভাবেই ছিল এক ধনাঢ্য ও সমৃদ্ধ জনপদ। কিন্তু ১৮৭ বছর শাসন চালিয়ে বৃটিশরাজ এখানকার উন্নয়ন সাধন ও এর জনগণকে স্ব-শাসন (self-rule) পদ্ধতি শেখানোর ক্লান্তিকর প্রচেষ্টার পর আজও এ রাজ্যটি দারিদ্র-পীড়িত ও মৃতবৎ মানুষের জনপদেই রয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ’ভারতে বঙ্গদেশই সর্বপ্রথম পুরোপুরি বৃটিশ শাসনের কবলে পড়ে। বৃটিশ বেনিয়া শাসনপ্রতিষ্ঠার পরপরই এ জনপদ সর্বগ্রাসী লুটতরাজের শিকারে পরিণত হয়। বৃটিশের রাজস্ব আদায়ের মাত্রা এমন তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে, খাজনার শেষ কপর্দকটিও শুধু যে জীবিত কৃষকের নিকট থেকেই আদায় করা হয়েছে তা নয়, এমনকি মৃতরাও এর থেকে রেহাই পায়নি - যা ছিল নেহায়েৎই লুন্ঠন। দুর্ভিক্ষের কবলে বঙ্গদেশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত না হওয়া পর্যন্ত খাজনা আদায়ের নামে এ লুন্ঠন প্রক্রিয়া Òপ্যাগোডা-বৃক্ষে” বারংবার ঝাঁকুনি দেয়ার মত চলছিল। তথাকথিত Ôবাণিজ্যের’ নামে এ ছিল স্রেফ লুটপাট - ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। এটা স্মরণে রাখতে হবে যে, এ লুন্ঠন প্রক্রিয়া বিভিন্ন নামে এবং বিভিন্ন রূপে শুধু কয়েকটি বছরই নয় - বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর অবধি চালু ছিল। এ সর্বগ্রাসী লুটপাট ক্রমশ বৈধ শোষণে রূপান্তরিত হয়। বৃটিশ শাসনের শুরুতে দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজন-প্রীতি, সহিংসতা এবং অর্থ-লিপ্সার ভযাবহতা ধারণাতীত রূপ পরিগ্রহ করেছিল - যার পরিণতিতে ১৭৭০ সালে এক মহাদুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়ে বাংলা ও বিহারের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারায়। ভারতের যেসব অঞ্চল দীর্ঘ সময় বৃটিশ শাসনাধীন ছিল সেগুলোতে আজ অবধি চরম দারিদ্র বিরাজ করছে।’ নেহরুর এ ঐতিহাসিক বক্তব্য বৃটিশ বেনিয়াদের লুটসর্বস্ব দুঃশাসনকে লজ্জাজনকভাবে পরিস্ফুট করে তুলেছে। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৩২৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইউরোপিয় দের এই অর্থনৈতিক লুটপাট কে সভ্যতার প্রসার নামে চালান হয় এবং আমরা সেটাবে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস ও করি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন