সোনার বাংলা শ্মশান হওয়ার উপাখ্যান - পর্ব: ১
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০১ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:৫০:১৮ রাত
"ধন-ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি” - কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়।
আবহমান বাংলার এ মনোরম চিত্র শুধু কবির কল্পনায়ই নয়, এক সময়ে বাস্তবেও ছিল তাই। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকেই প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিকাশ ঘটতে শুরু করে। তবে পঞ্চাশ খৃষ্টাব্দে রোমানদের সাথে বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে এ সমৃদ্ধির গতি দ্রত বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণ ছিল সুজলা-সুফলা বাংলার কৃষি সম্পদ, শিল্পজাত সামগ্রী এবং সমুদ্র বাণিজ্য। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে বাংলার মাটি সত্যিকার অর্থেই সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হয়। ষষ্ট শতাব্দীর শেষ দিকে রোমানদের সাথে বাণিজ্যের পরিমাণ কমে আসে। তবে সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের সাথে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। এ সময়ে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত বাংলার পাললিক উর্বর মাটিতে কৃষি-কর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ফলে বাংলার কৃষক সম্প্রদায় ধান-চাল, আঁখ, সরিষা, কার্পাস, সুপারী, নারকেল, পানের বরাজ, ফল-ফলাদি, সুগন্ধি (perfume), ইত্যাদি কৃষি পণ্যের উৎপাদনে প্রচুর সাফল্য অর্জন করে। বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং এর বিবরণে এসব তথ্য যাওয়া যায়। এছাড়া মার্কোপোলো, বার্ণিয়ার, ইউয়ান চুয়াঙ, চাও-জু-কুয়া পিঙ, মা হুয়ান, ইবনে বতুতা, প্রমুখ পর্যটকের বৃত্তান্তেও বাংলার ফয়-ফসলের সমারোহ ও বিভিন্ন শিল্প-দ্রব্যের প্রাচুর্যের তথ্য জানা যায়। 'পেরিপ্লাস অব দ্যা ইরথ্রিয়ান সী’ এর বিবরণীতে প্রাচীন বাংলার বিখ্যাত মসলিন ও সুগন্ধির বর্ণনা পাওয়া যায়। বিখ্যাত চীনা পর্যটক ওয়াঙ সে ইউয়ান ১৩৪৯ সালে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে বাংলার জনগণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, "এই জনগোষ্ঠীর শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য তারা নিজেদের কাছেই ঋণী। এর অন্তর্নিহিত কারণ হলো, কৃষির প্রতি তাদের একনিষ্ঠ সাধনা। তারা নিজেদের অবিরত শ্রম দ্বারা এখানকার জঙ্গলাকীর্ণ ভূমিকে আবাদ করে চাষযোগ্য ফসলী জমিতে রূপান্তরিত করতে পেরেছিল”।
ছয় শত বছর পূর্বে ইটালীর পর্যটক লুডোভিকো ডি ভার্থেমা (Ludovico di Varthema) ১৪০৫ সালে বাংলার রাজধানী গৌড় ভ্রমণ কালে এদেশে সুতীবস্ত্রের ব্যাপক উৎপাদন ও রপ্তানীর বিবরণ তুলে ধরে বলেন, এখান থেকে প্রতি বছর ৫০টি জাহাজ সুতীবস্ত্র নিয়ে মধ্য-প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যেতো। সমসাময়িক কালের অপর পর্তুগীজ পরিব্রাজক, চিকিৎসক ও কুটনীতিক টমস্ পাইরেসের (Tomes Pires) বর্ণনায়ও মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জের সাথে বাংলার বস্ত্র রপ্তানীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৪৩২ সালে চীনা পর্যটক মা হুয়ান বাংলাদেশে ভ্রমণকালে কাগজের ব্যবহার দেখতে পান। তিনি বলেন, বাঙ্গালী মুসলিম কাগজী সম্প্রদায় যে কাগজ তৈরী করেন, "তা সাদা রংয়ের, গাছের বাকল থেকে তৈরী এবং হরিণের চামড়ার মতই মসৃণ”। (Rockhill, “Notes on the Relations,” 440. See also S. A.K. Ghori and A. Rahman, “Paper Technology in Medieval India,” Indian Journal of the History of Science 2 (November 1966): 136.)। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁর The History of Bengal ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক মানৌচি, যিান চল্লিশ বছর ভারতে কাটিয়েছেন, তিনি বলেন, "বিশাল মোঘল সম্রাজ্যের সকল অংশের মধ্যে বাংলার নামটিই ফ্রান্সের নিকট পরিচিত ছিল। এ দেশ থেকে ইউরোপে বিপুল ঐশ্বর্য-প্রবাহই প্রমাণ করে এখানকার সমৃদ্ধির কথা। প্রকৃতপক্ষে, এ দেশের রেশমী ও সুতি কাপড়, চিনি এবং নীলের উৎপাদন মিশরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সব কিছুরই প্রাচুর্য ছিল এখানে। এ সবের মধ্যে ছিল ফল, খাদ্য-শস্য, মসলিন, সোনালী বর্ণের সুতি ও রেশমী বস্ত্র”।
মোঘলদের আমলে বাংলা ছিল স্বর্গরাজ্য। সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলা মোঘল সম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। সপ্তদশ শতাব্দী জুড়ে সুবে-বাংলার সীমান্ত কামরূপ-আসাম এবং চট্টগ্রাম-আরাকান পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। মোঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামে এর নাম দেন 'জাহাঙ্গীরনগর’। পর্তুগীজ ধর্মযাজক ফ্র্যা সেব্যাস্টিন মানরিক (Fray Sebastien Manrique) ১৬৪০ সালে ঢাকায় আসেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে, দুই লক্ষ জন-অধ্যুষিত এ নগরীটিকে 'Gangetic emporium' নামে অভিহিত করেন। এই ঐশ্বর্যমন্ডিত নগরীর প্রাচুর্যে বিমুগ্ধ হয়ে তিনি লেখেন, "এ নগরীতে অনেক জাতির লোকদের সমাগম ঘটেছিল, কারণ এখানে বিভিন্ন পণ্যের এক বিরাট বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল, আর সেসব পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো এ দেশেরই উর্বর মাটিতে” (Travels of Fray Sebastien Manrique, 1:45)। তিনি মোঘলদের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, 'ভূমি রাজস্ব আদায়ের সর্বনিম্ন স্তর ছিল 'পরগণা’ যার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারী কর্মকর্তার পদবী ছিল 'শিকদার’। রাজস্ব আদায়ে প্রয়োজনে কড়াকড়ি আরোপ করা হতো, অনাদায়ী কৃষককে কখনও দাসত্বে আবদ্ধ করা হতো। তবে এর বিপরীতে এমনটাও ঘটত যে, যখন কৃষকরা তাদের অভাব-অভিযোগের কথা বৈধ কর্তৃপক্ষের মারফৎ সরকারের নজরে আনতেন, তখন সরকার এর যথাযথ ও বিহিত ব্যবস্থা নিতেন”। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি ১৬৬৪ সালে কুচবিহারের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে একজন ঊর্দ্ধতন রাজস্ব কর্মকর্তা 'আমিন’ কৃষক নির্যাতনের অভিযোগে তার অধীনস্ত রাজস্ব আদায়কারী 'চৌধুরী’ কে বরখাস্ত করেছিলেন। মানরিকের বর্ণনায় আরো জানা যায়, 'ঊর্দ্ধতন রাজস্ব কর্মকর্তা কৃষকদের সম্মতি সাপেক্ষে রাজস্ব আদায়কারী নিয়োগ দিতেন। রাজস্ব আদায়কারীকে একটি অঙ্গীকার-পত্রে স্বাক্ষর দ্বারা এ মর্মে ওয়াদা করতে হতো যে, তিনি সুচারুরূপে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন যাতে তাঁর সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় কৃষি জমির আবাদ বৃদ্ধি পায় এবং কেহই যেন নির্যাতনের শিকার না হয়’। মোঘল আমলে কৃষকেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলে সরকার থেকে 'তাক্বাবী’ ঋণ পেতো যা দিয়ে তারা ফসল ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতো।
মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মনোনীত সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমল (১৬৬৪-১৬৮৮) ছিল বাংলার স্বর্ণ-যুগ। তিনি মগ-ফিরিঙি জলদস্যুদেরকে নির্মূল করে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকে নিরাপদ করেন। তাঁর আমলে বাংলার সমৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তিনি নগরীর পশ্চিম প্রান্তের তোরণে যে কথাগুলো উৎকীর্ণ করে যান তা ছিল, ”যিনি চালের দাম এমন সস্তায় দেখাতে পারবেন তাঁকেই শুধু দ্বারটি খুলতে দিন” (A Karim, History of Bengal, Mughal Period, Rajshahi, 1995)। এ সময়ে বাংলার জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাগুলো আবাদ হওয়ায় কৃষির দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে। মোঘল আমলে বাংলার শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি লাভ করে এবং এসব পণ্য উত্তর ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হতে থাকে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার ’মসলিন’ বস্ত্র ছিল জগদ্বিখ্যাত। বাংলার রাজধানী ঢাকা এবং সোনারগাঁও সূক্ষ মসলিন বস্ত্রের উৎপাদন ও রপ্তানীর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। রোম ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই বস্ত্র ছিল অতি জনপ্রিয়। ’দ্যা ইকনোমিক হিস্ট্রী অব বেঙ্গল’ গ্রন্থের লেখক এন,কে, সিনহা উল্লেখ করেছেন, লর্ড ভেরেলিস্ট পলাশী যুদ্ধের প্রাক্কালীন বাংলার অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, "কৃষকেরা ছিল অবস্থাসম্পন্ন, শ্রমিকেরা ছিল উদ্যমী, ব্যবসায়ীরা বিত্তবান এবং আমলারা ছিল সন্তুষ্টচিত্ত”। লর্ড ক্লাইভ বাংলার সম্পদের কথা মুক্ত কন্ঠে বর্ণনা করেছেন। যখন ক্লাইভ বাংলার রাজধানী মুর্শীদাবাদে প্রবেশ করেন, তিনি দেখতে পান, "নগরীটি লন্ডনের মতই সম্পদশালী ও জনবহুল ছিল। শুধু পার্থক্য ছিল এই যে, এখানকার (মুর্শীদাবাদের) কিছু নাগরিক লন্ডনের ধনীদের চেয়েও অনেক বেশী ধনাঢ্য ছিল”। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন