মানুষ কখন সৃষ্টির সেরা জীব - পর্ব: ১
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ২২ অক্টোবর, ২০১৪, ০৬:৩৩:২৬ সকাল
“যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা”- পবিত্র কুরআন (৯৮:৭) ।
জ্ঞান-গরিমায়, বিবেক ও বুদ্ধিমত্তায় এবং সর্বোত্তম অবয়বে মহান আল্লাহর সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি হলো মানুষ। তাই মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। তবে সব মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব নয়। সেরা জীবের মর্যাদা লাভের জন্য তাকে কিছু গুণাবলী অর্জন করতে হয় এবং নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে এসব গুণের উৎকর্ষ সাধনের দ্বারা সৃষ্টির সেরা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। যারা নিজেদের জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে তারা অনুধাবন করতে পারে - আল্লাহ্ তা’আলা এমনি এমনি এসব সৃষ্টি করেননি, তাঁর সমগ্র সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক সূক্ষ পরিকল্পনা, গূঢ় রহস্য এবং মহৎ উদ্দেশ্য। বিশ্ব-জগতের এত লক্ষ-কোটি প্রাণীর মধ্যে মানুষকেই কেন আল্লাহ্ তাঁর অফুরন্ত নেয়ামতের অধিকারী করে সৃষ্টির সেরা জীব এবং তাঁর খলীফা (প্রতিনিধি) হিসেবে এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন? চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই এ প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। মানুষের অন্তরে এ কৌতুহলকে জাগ্রত করার জন্য আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয় আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্যে। যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে, ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করে, (তারা বলে) হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি বৃথাই সৃষ্টি করোনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদেরকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে অব্যাহতি দাও” (৩:১৯০-১৯১)।
এ পৃথিবীতে বসবাসের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে দিয়েছেন যাবতীয় জীবনোপকরণ, সুযোগ-সুবিধা এবং সর্বোপরি জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা। এ প্রসঙ্গে মহান স্রষ্টা বলেন, “নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি (১৭:৭০)”। তিনি মানুষকে আরও বৈশিষ্ট-মন্ডিত করেছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা প্রদান করে। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট হলো পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন। আর এ গুরু দায়িত্বের ব্যাপারে একমাত্র মানুষকেই জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর নিকট। এ জবাবদিহির ব্যাপারটি ঘটবে ক্বিয়ামতের দিবসে বিচারের কাঠগড়ায়। সে দিন সবাই পরিপূর্ণ ন্যায় বিচার পাবে। যারা পার্থিব জীবনে সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিল সেদিন তারা অনন্ত শান্তির অধিকারী হবে। আর যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে তাদের শাস্তি হবে কঠিন ও কঠোর। শাণিত বিবেকবোধ এবং জবাবদিহির ভয় এ দুনিয়ায় মানুষকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট রাখে।
সৃষ্টির সেরা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রয়োজন ঐশী নির্দেশিকা (guideline)। এ পৃথিীবিতে রয়েছে বিপরীত ধর্মী চিন্তা ও কর্ম - যেমন, সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দ. এসব । মহান আল্লাহ মানুষকে বিবেক বোধ দিয়েছেন যাতে সে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সঠিক পথে চলতে পারে। এতদসত্ত্বেও মানুষ যেহেতু ভুল-প্রবণ, সে যাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি এড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অনুযায়ী সঠিক জীবন যাপন করতে পারে সে জন্যে মানুষের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ নাযিল করেছেন ঐশী গ্রন্থ এবং যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী ও রাসুল। এ সবকিছুর উদ্দেশ্য হল মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তৈরী করা। ঐশী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ যেমন নিজে সৎ পথ অবলম্বন করবে এবং যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত থাকবে, তেমনি অন্যদেরকেও কল্যাণকর কাজের নির্দেশ দেবে। এসব গুণসম্পন্ন মানুষ সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, "তারা আল্লাহর প্রতি ও ক্বিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়; অকল্যাণ থেকে বারণ করে এবং সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে” (৩:১১৪)। আর এদেরকেই তিনি সৎকর্মপরাণ বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সৎকর্ম বা ধার্মিকতার ব্যাখ্যায় অন্যত্র বলা হয়েছে, "পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ ফেরানোই শুধু ধার্মিকতা নয়, বরং বড় ধার্মিকতা হলো - যারা ঈমান আনে আল্লাহর ওপর, ক্বিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর, কিতাবের ওপর এবং সকল নবী-রাসুলর ওপর; আর যারা তাঁকে (আল্লাহকে) ভালবেসে ধন-সম্পদ ব্যয় করে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক, মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত (গরীবের হক) আদায় করে, এবং যারা কৃত ওয়াদা পালন করে এবং অভাব-অনটনে, রোগে-শোকে ও (অন্যায়ের বিরুদ্ধে) যুদ্ধের সময় ধৈর্যধারণ করে তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী এবং সৎকর্মশীল" (২:১৭৭)। এরকম আরও অনেক সৎকর্ম দ্বারা আত্মিক উন্নতি সম্ভব। তবে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধির জন্য লোক-দেখানো সৎকাজ পার্থিব জীবনে কিছুটা ফলদায়ক হলেও পরকালে তা কোন সুফল বয়ে আনে না - একমাত্র নিঃস্বার্থ নেক আমল যা শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয় - তা-ই মানুষকে তার উভয় জীবনে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করে। এদের প্রসঙ্গে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেন, "হ্যাঁ, যে ব্যক্তি নিজের সত্তাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পণ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও বটে, তার জন্য তার পালনকর্তার কাছে রয়েছে পুরস্কার। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না" (২:১১২)।
কিছু মানুষ আছে পরকালের প্রতি তাদের কোন বিশ্বাস নেই। তারা মনে করে মৃত্যুই সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেবে, মরে গেলে এ জীবনের কাজকর্মের কোন হিসাব দিতে হবে না। এটা কোন যৌক্তিক কথা নয়, কারণ অনেকেই অন্যায় কর্ম ঘটিয়ে এ দুনিয়ার বিচারকে ফাঁকি দিতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক হিসেবে নিশ্চিতভাবেই সব মানুষকে ক্বিয়ামত দিবসে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। যারা পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে অবিশ্বাস পোষণ করে তাদেরেক স্বয়ং আল্লাহ্ প্রশ্ন করেন, "তোমরা কি ধারণা করে নিয়েছ যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?" (২৩:১১৫)। আল্লাহর বিচার অতি সূক্ষ ও ন্যায্য - একমাত্র তাঁর দয়া ও ক্ষমা ছাড়া পরকালের বিচার থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। বিচার দিবসে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকারের ক্ষণটি সম্পর্কে সতর্ক করে তিনি বলেন, "ভয় কর ঐ দিনটিকে, যে দিন তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে, অতঃপর প্রত্যেকেই তার (জীবনভর) অর্জিত কর্মফলের পুরোপুরি বিনিময় পাবে এবং কোনরূপ অবিচার করা হবে না" (২:২৮১)। এ দিন আল্লাহ্ মানুষের প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন। মানুষ তার কাজ-কর্মের কোন কিছুই সে দিন অস্বীকার করতে পারবে না। এর কারণ হিসেবে আল্লাহ্ বলেন, “আমি প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার গ্রীবালগ্ন করে রেখেছি। ক্বিয়ামতের দিন বের করে দেখাব তাকে একটি কিতাব (আমলনামা), যা সে খোলা অবস্থায় পাবে। (তাকে বলা হবে) পাঠ কর তুমি তোমার কিতাব। আজ তোমার হিসাব গ্রহণের জন্যে তুমিই যথেষ্ট” (১৭:১৩-১৪)। এ জবাবদিহির কঠিন দিনটিতে তার ঈমান ও নেক আমলই তাকে সাহয্য করতে পারবে - অন্য কিছু নয়। এ কথা মানুষকে সর্বক্ষণ স্মরণ রাখার উপদেশ দিয়ে আল্লাহ্ বলেন, “আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না" (২:৪৮)। সুতরাং সেই নিশ্চিত ক্ষণটি আসার আগেই জবাবদিহির পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে নিতে হবে। সেরা জীবের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্টগুলো অর্জন করতে হবে। এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হতে পারবে তাদের জন্য আল্লাহ্র ঘোষণা হলো: "অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা এই নেক বান্দাদেরকে দুনিয়ার জীবনেও ভালো প্রতিফল দিয়েছেন এবং পরকালীন জীবনেও তিনি তাদের জন্য সুন্দর পুরস্কারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা নেককার বান্দাদের ভালবাসেন" (৩:১৪৮)। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
২৩১০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হে আল্লাহ সেই কঠিন বিচারের দিন আমাদের দয়া ও ক্ষমা করে আপনার জান্নাত দিয়েন । আমীন ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন