মানব-সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়: পর্ব: ২

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:৫৬:০২ সন্ধ্যা

মানুষের ভোগবাদী কর্মকান্ড বিশ্ব প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর যে ভয়াবহ হুমকির সৃষ্টি করেছে তা বিশ্বের পরিবেশবিদ, গবেষক, বিজ্ঞানী ও সচেতন মানুষকে আতংকিত করে তুলেছে। এহেন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের এক শীর্ষ-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ শীর্ষ সম্মেলনে বিষয়টি এতই গুরুত্ব পায় যে, এরপর থেকে প্রতি বছরই এধরনের বিশ্ব-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব সম্মেলনে যোগ দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ পৃথিবীর পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব এবং পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র রক্ষার উপায় ও নীতি নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা করছেন। এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল ও আলোচনায় মানব-সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশ বিধ্বংসী যে সব বিপর্যয় নেমে এসেছে তার কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা হলো:

• প্রতি বছর পৃথিবীর সমুদ্রগুলোতে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, তার মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যই সর্বাধিক, যা কখনো পানি কিংবা মাটিতে মিশে না। সমুদ্র দূষণের কারণে প্রতি বছর ১০ লক্ষ সামুদ্রিক পাখী ও ১ লক্ষ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে।

• পরিবেশ দূষণ একটি বড় ঘাতক যা পৃথিবীর ১০ কোটি মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।

• শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এ পর্যন্ত বায়ুমন্ডলে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। প্রতি বছর একটি মটরকার থেকে অর্ধটন এবং ‘নাসা’র একটি স্পেস-শাটল থেকে ২৮টন কার্বনডাইঅক্সাইড নির্গত হয়। এভাবে পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি গাড়ী, হাজার হাজার নৌ ও আকাশ যান এবং শতশত স্পেস-শাটল বায়ুমন্ডলকে প্রতিদিন দূষিত করছে। বর্তমানে পৃথিবী জুড়ে ৫০ কোটি গাড়ি চলাচল করে, ২০৩০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১০০ কোটি। তখন এসব গাড়ী থেকে নির্গত কার্বনডাইঅক্সাইড পৃথিবীর বায়ুমন্ডলকে যে কি পরিমাণ দূষিত করে তুলবে তা অচিন্তনীয়।

• ‘ইন্টারগভার্ণমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’(আইপিসিসি) এর অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন দেশের তের শতেরও বেশী বৈজ্ঞানিক অভিমত দিয়েছেন যে, মানুষের কর্মকান্ডের কারণে বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস উৎপন্নের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁদের দেয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী শতাব্দীতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২,৫ ডিগ্রী থেকে ১০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত বাড়তে পারে, যার পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ। বর্তমানে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সে হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদন এক-পঞ্চমাংশ হ্রাস পাবে, আফ্রিকায় তা অর্ধেকে নেমে আসবে।

• পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে তা পৃথিবীর জন্য আরেক বিপদ ডেকে এনেছে। ওজোন স্তর সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষতিকারক অতি-বেগুনী রশ্মীকে ঠেকিয়ে রাখে। গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই ওজোন স্তরে ফাটল ধরেছে যা পৃথিবীতে বিপদজনক অতি-বেগুনী রশ্মীর অনুপ্রবেশকে সুগম করে দিয়েছে। এসব মানবিক কর্মকান্ডের ফলে পৃথিবীর পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্রের ওপর যে ভয়াবহ হুমকি নেমে এসেছে তা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রতিফলিত হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত ‘আইপিসিসি’র পঞ্চম খসড়া এসেসমেন্ট রিপোর্টের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকা জানিয়েছে, ভবিষ্যত পরিস্থিতি ‘ভয়াবহ, অতীব ক্ষতিকর ও অপূরণীয়’। বিপোর্টে আরো বলা হয়, ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ হার ছিল প্রতি বছর ১.৩ শতাংশ যা ২০০০ থেকে ২০১০ বাড়তে থাকে বছরে ২.২ শতাংশ হারে। এই দশকে এ বৃদ্ধির হার আরো বাড়বে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।

• জলবায়ুর পরিবর্তন ঘন ঘন দুর্যোগের প্রকোপ ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর এক থেকে দুই ডিগ্রী উষ্ণতা বাড়ছে। এর ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সমুদ্রসংলগ্ন ভূভাগ তলিয়ে যাচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সঙ্গে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বাড়ছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড রিস্ক রিপোর্ট-২০১২ অনুযায়ী দুর্যোগ ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে পঞ্চম স্থানে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শতকের মধ্যভাগে সমুদ্র-পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭ শতাংশ ভূখন্ড সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। এর ফলে কয়েক কোটি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। পরিণতিতে দেশে খাদ্যাভাব, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংকট এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির মত মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

• দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিকে আমেরিকার পারমাণবিক বোমার আঘাতে সৃষ্ট তেজষ্ক্রীয় বিকীরণে জাপানের দুটো শহর হিরোশিমা ও নাগাসাকি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। এরপর আবারো ২০১১ সালে সুনামীর ধ্বংসযজ্ঞের কবলে পড়ে যখন জাপানের ফুকুশিমা দ্বীপে অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বিধ্বস্ত হয় তখন এ কেন্দ্র থেকে নির্গত তেজষ্ক্রীয় বিকীরণ জাপানের মূল ভূখন্ডের ১১,৫০০ বর্গমাইল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক কেন্দ্রটির ১২ মাইল পরিধির মধ্যে অবস্থিত ২৩০ বর্গমাইল এলাকা এবং সেই সাথে কেন্দ্রটির উত্তর-পশ্চিম দিকের আরো ৮০ মাইল এলাকাকে মানব বসতির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করে সেখান থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এ এলাকাগুলো এখন স্থায়ীভাবে মানব-বসতি বহির্ভূত অঞ্চল হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

• পৃথিবীর পরমাণু শক্তির অধিকারী দেশগুলো পারমাণবিক, হাইড্রোজেন, রাসায়নিক, অন্যান্য বিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র তৈরী করে পৃথিবীর পরিবেশকে বিষময় করে তুলছে। খনিজ তেলসহ পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য তারা এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে এসব বিধ্বংসী মরণাস্ত্রের মহড়া চালাচ্ছে।

• উন্নত বিশ্বের মুনাফালোভী কর্পোরেট হাউসগুলো কীটনাশক ওষুধ তৈরীর সাথে সাথে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও হরমোন প্রযুক্তির মাধ্যমে হাইব্রীড ফসল ও গবাদি পশুপাখীর জাত উদ্ভাবন করছে। এসব হাইব্রীড জাত থেকে উৎপন্ন খাদ্যসামগ্রী খেয়ে মানব দেহে নানাবিধ জটিলতা ও রোগব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে।

• বাংলাদেশে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন, কার্বাইড ও রঙের মত রাসায়নিক উপকরণ মিশিয়ে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক খাবারকে বিষাক্ত করে তুলেছে, যার ফলে ক্যানসারসহ বিভিন্ন ধরনের মরণব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

আল্লাহ্ এ পৃথিবীর নিয়ামতের সম্ভার আমানত হিসেবে সৃষ্টির সেরা জীব মানবজাতির ওপর অর্পণ করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা চেয়েছিলেন মানুষ কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে প্রকৃতির নিয়ামতসমূহ দায়িত্বশীলতার সাথে রক্ষা করবে, পরিমিতভাবে ভোগ করবে, নিজেকে আত্মসর্বস্ব ও ভোগসর্বস্ব প্রাণীতে পরিণত করবে না এবং এ দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না। কেননা, ক্ষণকালীন পার্থিব ভোগ-বিলাস, লোভ ও স্বার্থপরতা তার জীবনের লক্ষ্য নয়। তিনি মানুষকে এ পৃথিবীতে চিরস্থায়ী করে সৃষ্টি করেননি, একটি নির্দিষ্ট জীবনকালে একটি মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে সৃষ্টি করেছেন - যাতে মানুষ তার ক্ষণিকের অবস্থান এ পৃথিবীর বুকে এক সুন্দর ও শান্তিময় পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু মানুষ তার জীবনের আসল উদ্দেশ্য ও গন্তব্য সম্পর্কেই উদাসীন। পার্থিব জীবনের প্রতি ভোগবাদী মানুষের অতিরিক্ত আসক্তির কারণে পৃথিবী এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তাদের এসব কর্মকান্ডের পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ার করে আল্লাহ্ বলেন, “জলে স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। (এর মাধ্যমে) আল্লাহ্ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (তাদের অশুভ কর্মকান্ড থেকে) ফিরে আসে (৩০:৪১)।” এ ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবন হলো মানুষের জন্য এক পরীক্ষাগার। এখানে অণু পরিমাণ ভাল বা মন্দ কাজ করলেও তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব মানুষের আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে - যা বিচার দিবসে তার হাতে পেশ করা হবে। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার নিকট মানুষের কোন কাজকর্মই জবাবদিহির ঊর্দ্ধে নয়। সুতরাং মানুষকে তার পরিণাম ফল সম্পর্কে এখনই সাবধান হতে হবে। (সমাপ্ত)

বিষয়: বিবিধ

১১১২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

265919
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৩৫
আহ জীবন লিখেছেন : ব্যাপারটা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারবনা কিন্তু বলি বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট বিজলী বাতির নিচে বসে, কীবোর্ড এ আঙ্গুল দিয়ে লিখে বিজ্ঞানের দিকেই আঙ্গুল তুলে বলি কেন যেন মনে হয় সব নষ্টের মুলে এই বিজ্ঞান। হয়তো আমার বুঝার ভুল ও হতে পারে।
265978
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৫৮
শিহাব আহমদ লিখেছেন : বিজ্ঞান নয়, মানুষের অতি ভোগবাদী প্রবণতা এর জন্য দায়ী। অনুগ্রহ করে এ লেখার উপসংহার অনুচ্ছেদটি পড়লে তা বুঝতে পারবেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File