হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম ইতিহাস:পর্ব-৩

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:৩৪:৩৭ রাত

‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নীতিতে বিশ্বাসী বলে দাবী করলেও ভারতের স্বাধীনতার দীর্ঘ সাতষট্টি বছর পরেও সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প সে দেশের আত্মাকে কলুষিত করে রেখেছে। অহিংস নীতির প্রবক্তা ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম-নিধন প্রায় একটি নিয়মিত ব্যাপার। গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী যিনি গুজরাটের জঘণ্যতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হোতা বলে অভিযুক্ত, তিনি এখন তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ২০০২ সালে এক অপকৌশলের মাধ্যমে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দেন । এ দাঙ্গায় নারী-শিশুসহ এক হাজার মুসলমানকে হত্যার অভিযোগে সারাবিশ্বে ‘গুজরাটের কসাই’ নামে পরিচিতি লাভ করেছেন এই নরেন্দ্র মোদি। অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য মরিয়া তিনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন মোদি। গত নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত মুসলমানদেরকে 'বহিরাগত বাংলাদেশী' হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার এত বড় ‘তকমাধারী’ হওয়া সত্বেও কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি তাঁর দলসহ বিপুল ভোটাধিক্যে বিজয়ী হয়ে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ ভারতের ক্ষমতায় আসীন হতে পেরেছেন। তাঁর শাসনামল শুরু হতে না হতেই মাত্র একশত দিনের মধ্যে ভারতে ৩০/৩৫টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্নাটক প্রভৃতি রাজ্যে এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, যাদের মধ্যে বেশীরভাগই মুসলমান, কিছুসংখ্যক শিখও রয়েছে। আরও শংকার বিষয় হলো, বিজেপির দোসর রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ বা আরএসএসের প্রধান দেশটির নাম ভারত না বলে ‘হিন্দুস্তান’ বলেন। তাদের দাবি, হিন্দুস্তানে বসবাসকারী সবাই হবে হিন্দু। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে অবশিষ্ট রইল আর কী?

সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে ভারতের কোন সরকারই প্রশমিত করতে পারেনি, বরং উস্কে দিয়েছে। কংগ্রেস, বিজেপি অথবা বামপন্থী যে সরকারই ক্ষমত্য়া থাকুক সব সরকারেরই আমলে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী অনেক পশ্চাদপদ রয়ে গেছে। বিবিসি বাংলা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার একটি তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী কোলকাতার পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ‘প্রগতিবাদী’ বাম শাসনের পঁয়ত্রিশ বছরসহ স্বাধীনতার দীর্ঘ ছয় দশক পরেও সেখানকার মুসলমানরা কেমন আছেন তারই খোঁজ করতে ‘মুসলমানের কথা’ নামে এ তথ্যচিত্রটি তৈরি করা হয়েছে। ছবিটির পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তার তথ্যচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের একটা অত্যন্ত করুণ অবস্থা ফুঠে ওঠেছে। “যে গ্রামেই গেছি, সেখানেই খোঁজ পেয়েছি অনেক ১৩-১৪ বছরের কিশোরের যারা বড় বড় শহরে নির্মাণ শিল্পে কাজ করতে গেছে। যদি এখানে অর্থনৈতিক অবস্থাটা ভালই হবে, তাহলে ওইটুকু বাচ্চা ছেলেদের গ্রাম-পরিবার ছেড়ে কেন কাজ করতে যেতে হবে বাইরে?” - প্রশ্ন সৌমিত্র দস্তিদারের। কর্মসংস্থানের ব্যাপারেও যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা অনেকটাই পিছিয়ে, সেই তথ্য আবারও উঠে এসেছে ‘মুসলমানের কথা’ ছবিটিতে। পরিচালক বলছিলেন, “রাজ্যে যে প্রায় ২৫% বাঙালি মুসলমান আছেন, তাঁদের মাত্র দুই শতাংশ সরকারি চাকুরিতে রয়েছেন। বেসরকারি ক্ষেত্রের অবস্থাটাতো আরও খারাপ। যদি শিক্ষক-অধ্যাপকদের মধ্যে মুসলমান খুঁজতে যান, খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে। এমনকি মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও মাত্র জনাকুড়ি মুসলমান সাংবাদিক খুঁজে পেয়েছি এই তথ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে।”

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের শিক্ষা-কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে খুবই করুণ অবস্থা, সেই তথ্য প্রথম উঠে এসেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি ‘সাচার কমিশনের’ প্রতিবেদনে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার সেই তথ্য অস্বীকার করেছিল। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী মুসলমানদের জন্য অনেক ধরণের প্রকল্প ভাতা প্রভৃতি চালু করেছেন। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় আর রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী অনেকেই সমালোচনা করছেন যে ওইসব প্রকল্প বা ভাতায় আপামর মুসলমান মানুষের খুব কিছু উপকার হচ্ছে না। এই সমালোচকদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্য পুলিশের এক খুবই সিনিয়র অফিসার নজরুল ইসলাম - যাঁকে মুসলমানদের বিষয়ে সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে আর ক্ষমতাসীন দলের কোপ-নজরে পড়তে হয়েছে। ঘটনাচক্রে, মিঃ ইসলামের সাক্ষাতকারও রয়েছে সৌমিত্র দস্তিদারের তৈরি তথ্যচিত্রটিতে। [মানবজমিন পত্রিকায় ‘মুসলমানের কথা’ তথ্যচিত্রের প্রদর্শন বন্ধ কলকাতায় - শিরোনামে প্রকাশিত. বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩] সেই তুলনায় বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা অনেক উন্নত, এখানে তারা অনেক কম বৈষম্যের শিকার। এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০% হলেও সরকারী উচ্চ পদে ও বেসরকারী চাকুরীতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে হিন্দুদের অবস্থান অনেক উপরে। শিক্ষা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা একটি অগ্রসরমান সম্প্রদায়।

সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত অংশগ্রহণে একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ফসল হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশের এ মুক্তি সংগ্রামে প্রতিবেশী ভারতের সর্বাত্মক অবদান রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণের কারণে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী জনমত গড়ে ওঠেছে। যেসব বিষয় এ বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে তার অন্যতম হলো: আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারত ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধের মাধ্যমে একতরফাভাবে নদীর পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশে মরুকরণ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, সীমান্ত চুক্তি ভঙ্গ করে বাংলাদেশের ছিটমহল হস্তান্তরে গড়িমসি করছে, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরী করছে, প্রায় প্রদিনই সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ বাংলাদেশী নাগরিককে গুলি ও বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করছে - যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে খুবই বিরল। বাংলাদেশের কোন টিভি চ্যানেল ভারতে প্রচার করতে দেয়া হয় না। ভারতের ‘বড়ভাইসুলভ’ ও সংকীর্ণ পররাষ্ট্রনীতির কারণে সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব গড়ে ওঠছে না। এসব ঘটনার কারণে এবং ভারতে ঘনঘন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাবে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এখানেও উগ্রবাদীরা হিন্দুদের পূজা-পার্বনে মন্দির ও মূর্তি ভাঙচূর করছে, নির্বাচনকালীন সময়ে হিন্দুদের জান-মালের ওপর চড়াও হচ্ছে। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফসল সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বীজ এখনও এ উপমহাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে সক্রিয়। এর মূলোৎপাটনের জন্য সমাজ সংস্কার ও সুস্থ রাজনৈতিক ধারার প্রবর্তন একান্ত প্রয়োজন। (সমাপ্ত)

বিষয়: বিবিধ

১৫৮৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File