হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম ইতিহাস: পর্ব-২

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:৩৪:০১ রাত

অষ্টাদশ শতাব্দীতে এদেশে বৃটিশের আগমণের পর থেকে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পট পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১৭৫৭ সালে এদেশীয় মীরজাফর-জগৎশেঠদের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে বৃটিশ ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী প্রথমে বাংলার বুকে বৃটিশ দখলদারিত্বের সূচনা করে, পরবর্তী একশ’ বছরে তা প্রায় সারা ভারতে বিস্তৃতি লাভ করে। এ উপমহাদেশে তাদের শাসন ও শোষণকে পাকাপোক্ত করার কুমতলবেই তারা হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িতার সৃষ্টি করে। মুসলিম শাসকদের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার পর পরাজিত মুসলিম শাসকদের প্রভাবকে ক্ষুণ্ণ করার জন্যে তারা প্রচুর সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে উচ্চ বর্ণের কিছু সংখ্যক হিন্দুদেরকে হাত করে নেয় এবং তাদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেয়। কোলকাতা ভিত্তিক এই ‘ভদ্দরলোকবাবু’ শ্রেণীটি নব্য শাসক বৃটিশের প্রভুত্বকে স্বাগত জানায় এবং মুসলমানদেরকে শত্রু বলে গণ্য করে। তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানকে দৃঢ় করে তুলে। বৃটিশ প্রবর্তিত ‘জমিদারী’ ব্যবস্থারও এক বড় উপকারভোগী ছিল এই শ্রেণীটি। পরগাছাসদৃশ এই ‘জমিদারবাবুগণ’ অতি দ্রুত গ্রামীন সমাজের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে বাংলার কৃষক ও কর্মজীবী মনুষের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসতে সমর্থ হয়।

এদেরই অগ্রগণ্য একজন হলেন বাংলা সাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপোধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য-কর্ম আধুনিক বাংলা ভাষার এক অমূল্য সম্পদ বলে গণ্য হলেও তা ছিল সাম্প্রদায়িকতায় ভরপুর। তিনি তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে বৃটিশের স্তুতি এবং মুসলিম বিদ্বেষের দ্বারা কলুষিত করেছেন। তাঁর সাহিত্য-কর্ম ‘আনন্দ মঠ’, ‘দুর্গেশ নন্দীনি’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘সীতারাম’ ইত্যাদিতে প্রতিবেশী মুসলিম সমাজের প্রতি বিষোদ্গার করেই ক্ষান্ত হননি, ‘মার-মার, দেবতার শত্রু মার, হিন্দুর শত্রু মার’ প্রভৃতি আক্রমণাত্মক শব্দাবলীর ব্যবহার করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি দিয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তিনি তাঁর ‘সীতারাম’ গ্রন্থে হিন্দুর শত্রু বলতে মুসলমানদেরকে চিহ্নিত করেছেন এবং বৃটিশদেরকে মিত্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলমানদেরকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তাদেরকে ‘ম্লেচ্ছ’, ‘যবন’, ‘নেড়ে’, প্রভৃতি নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোতে তিনি মুসলিম চরিত্রগুলোকে দানবীয় রূপ দিয়ে প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আনন্দ মঠ’ ছিল তাঁর প্রচারিত ‘হিন্দুত্ব’ মতবাদের দর্শন এবং এ গ্রন্থেরই বিখ্যাত সঙ্গীত ‘বন্দে মাতরম’ হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও পৌত্তলিকতার ভাবাদর্শে রচিত ছিল। তিনি হিন্দু মৌলবাদী দর্শনের জনক ও প্রবক্তা হিসেবে ভারত, বিশেষ করে বাংলাভাষাভাষি অঞ্চলে ‘হিন্দুত্ববাদ’ তথা হিংসাত্মক ও সংঘাতময় হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে।

বঙ্কিমীয় ভাবধারার অনুসারী হয়ে কবি হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র মুসলিম ইতিহাস ও ঐতিহ্যেকে শুধু বিকৃতই করেননি, মুসলমান সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করে তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়ার কাজেও তাঁদের ক্ষুধার লেখনীকে ব্যবহার করেছিলেন। আজও ধর্ম-নিরপেক্ষতার খোলসে আবৃত ভারতে যে উগ্র হিন্দু মৌলবাদী ধারা বিরাজ করছে এবং প্রায়শই সেখানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হচ্ছে তার বীজ বঙ্কিম নিজেই বপন করে গিয়েছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারও ইতিহাস বিকৃতির এ মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেননি। বৃটিশ শাসনের ‘স্তুতিকার’ এসব লেখকবৃন্দ যতই বুটিশ প্রভুর গুণকীর্তন করুন না কেন প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য হল এটাই যে, বৃটিশ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই এদেশে তাদের দুঃশাসন, শোষণ ও লুন্ঠনের কারণে ১৭৭০ সালে বিশ্ব-ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। নব্য বৃটিশ প্রভুর নিষ্ঠুরতম দুঃশাসন, শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, উপমহাদেশে বৃটিশ শাসন অবসানের মাত্র চার বছর পূর্বে ১৯৪৩ সালে এ দেশের মানুষ আবারও আর এক দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের এক জরীপের তথ্য অনুযায়ী এ সময় বাংলার ৩৫ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। এসব হৃদয় বিদারক ঘটনার পরও বৃটিশের অনুগ্রহপ্রাপ্ত কোলকাতার ইংরেজী শিক্ষিত এক শ্রেণীর ‘হিন্দু-বুদ্ধিজীবি’ উপমহদেশের গৌরবময় ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে যেভাবে প্রতিবেশী মুসলমানদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন, তাদের নব্য প্রভুর বন্দনা করেছেন এবং সমগ্র ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষের বীজ বপন করেছেন, তা সর্বকালের এক কলঙ্কময় ও লজ্জাজনক কুকীর্তি হিসেবে বিবেচিত হবে।

১৭৯৩ সালে বাংলার গভর্ণর লর্ড কর্ণওয়ালিশ কর্তৃক প্রবর্তিত জমিদারী প্রথাটি ছিল প্রজা শোষণ ও নির্যাতনের এক বড় হাতিয়ার। এ ব্যবস্থার উপকারভোগী জমিদারগণ ছিলেন বাংলার সামন্ত প্রভু। তাদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মালম্বী। এদের হাতে নিগৃহীত ও শোষিত হচ্ছিল বাংলার কৃষক সমাজ বিশেষ করে পশ্চাদপদ মুসলমান জনগোষ্টী এবং তফসিলী সম্প্রদায়ভুক্ত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। এসব জমিদারদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মাঝে মধ্যে সংঘটিত হত কৃষক বিদ্রোহ। হিন্দু জমিদারগণ মুসলমান কৃষকদের ‘দাঁড়ি রাখা’, ‘শিশুদের মুসলিম নামকরণ’ এবং ‘মসজিদের’ ওপর করারোপ করার প্রতিবাদে তিতুমীরের নেতৃত্বে কৃষকরা সংঘটিত হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বীর কৃষক সন্তান বর্তমান চব্বিশ পরগণা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের এলাকা দখল করে সেখানে জমিদারী ও বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং বৃটিশ বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে তিতুমীর বেশ কয়েকবার জয়ী হন। অবশেষে বারাসতের নারকেলবাড়িয়ার যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও শাহাদত বরণ করলে এ বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। বৃটিশ রাজের কর্মচারী ও ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার তাঁর ’দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ গ্রন্থে ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের বিশেষ করে বাংলার মুসলমান কৃষক সমাজ ও অভিজাত শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশা, পশ্চাদপদতা ও বৃটিশদের সাথে তাদের মনস্তাত্বিক দূরত্বের কথা সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।

বৃটিশ আমলে 'হিন্দুত্ববাদের’ জাগরণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক এবং তাঁর সমর্থক বিপিন চন্দ্র পাল ও লালা লাজপত রায়ের উগ্রবাদী ভূমিকা তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দকে সন্দিহান করে তুলে। পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ তখনও কংগ্রেসের প্রথম সারির একজন নেতা। তিনি তৎকালীন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ও উদারপন্থী নেতা দাদাভাই নওরোজীর ভাবশিষ্য ও সেক্রেটারী হিসেবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৬ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ঐক্য চুক্তি সম্পাদিত হয় যা 'লৌক্ষ্ণ প্যাক্ট' নামে পরিচিত। তাঁর এ বিশেষ অবদানের কারণে তাঁকে ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব যখন চুক্তি থেকে সরে এসে মুসলিম স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিল তখন জিন্নাহ্ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে পুরোপুরি মুসলিম লীগের হাল ধরলেন। এরপর থেকে উভয় দলের মধ্যে বিরোধ তীব্রতর হতে থাকে এবং ভারতীয় মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবী প্রবল হতে থাকে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালে নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃতে পশ্চাপদ ভারতীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ১৯০৫ সালে বৃটিশ ভারতের গভর্ণর লর্ড কার্জন বাংলা প্রেসিডেন্সীকে ভাগ করে মুসলিম অধ্যুষিত অনগ্রসর পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করেন এবং ঢাকাকে এর রাজধানী করা হয়। পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর মুসলমানদের উন্নয়নে এটি ছিল একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ। এতে হিন্দু জমিদার, বুদ্ধিজীবি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী তাদের শোষণ ও কায়েমী স্বার্থহানি ঘটার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে বঙ্গ-ভঙ্গ রদ ও স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন। ফলে ১৯১১ সালে বৃটিশরাজ পূর্ববঙ্গকে আসাম থেকে আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গের সাথে পুণরায় জুড়ে দেন। উপমহাদেশের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারত-বিভাজন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে তখন বাংলার মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ’স্বাধীন যুক্তবাংলার’ পক্ষে দাবী তুলেন। অথচ এবার 'বঙ্গ-ভঙ্গ রদ ও স্বদেশী আন্দোলনের’ ধ্বজাধারী সেই ‘হিন্দু জমিদার, বুদ্ধিজীবি ও ব্যবসায়ী’ শ্রেণীটিই ‘স্বাধীন যুক্তবাংলা’ দাবীর তীব্র বিরোধীতা করেন। তাদের চাপে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘স্বাধীন যুক্তবাংলার’ দাবীটি নস্যাৎ করে দেন। অবশেষে ১৯৪৬ সালে কংগ্রেসের একগুয়েমীর কারণে যখন ভারতের স্বাধীনতা সংক্রান্ত বৃটিশ 'কেবিনেট মিশন প্ল্যানটি’ বাতিল হয়ে যায় তখন অখন্ড ভারতের সকল আশাই তিরোহিত হয়ে যায়। এসব কিছুই ছিল তাদের হীন রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক মন-মানসিকতার পরিণতি। অবশেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বিভাজনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশটি বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন দেশের উদ্ভব ঘটে। (চলবে)

বিষয়: বিবিধ

২২২৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

264367
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৪৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
যে সিতারামকে হিন্দু জাতিয়তাবাদের প্রবক্তা বানিয়ে বন্কিম উপন্যাস লিখেছিলেন সেই সিতারাম এর প্রকৃত ইতিহাস সম্পুর্ন ভিন্ন। বন্কিম বৃটিশ সরকারের বিশ্বস্ত কর্মচারি ছিলেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File