হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্ম ইতিহাস: পর্ব-১
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:৩৪:৩৯ রাত
১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিশেক রাজত্বের অবসান হলে পাকিস্তান এবং ভারত নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার বিষময় পরিবেশে এ দেশ দু’টি জন্ম লাভ করে। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রক্রিয়া হাজার হাজার মানুষের জীবননাশ, লক্ষ লক্ষ লোকের পৈতৃক ভিটেমাটি থেকে দেশান্তর ও বিপুল সহায়-সম্পদহানির দ্বারা স্বাধীনতার ইতিহাসকে কালিমা লিপ্ত করেছে। আজ স্বাধীনতার ৬৭ বছর পরও হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার তিক্ত-বিষাক্ত পরিবেশের অবসান হয়নি। ধর্মান্ধতা ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এ উপমহাদেশের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় শিকড় গেড়ে বসে আছে। বৃটিশরা এদেশে সাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে 'বিভাজন এবং শাসন' নীতির প্রবর্তন করে। তারা এদেশ ছেড়ে গেলেও তাদের প্রবর্তিত এ নীতিটি স্বদেশীয় রাজনীতিকদের নীতিকে এখনও প্রভাবিত করছে। এদের রাজনৈতিক কুটচালে একদিকে যেমন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা তথা মৌলবাদী সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গমা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে সামাজিক অশান্তি ও আন্ত-রাষ্ট্রীয় কলহের সৃষ্টি হচ্ছে। বৃটিশ আগমনের পূর্বে ছয়শত বছর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন বিরাজ করছিল। মধ্য-এশীয় দেশ থেকে এদের আগমণ ঘটলেও এরা এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছে এবং এদেশের সম্পদ লুট করে তাদের দেশে নিয়ে যায় নি। তারা এখানকার জনগোষ্ঠীর সাথে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ নিয়ে বসবাস করেছে, এদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে। ফলে এ সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন সাম্প্রতদায়িক দাঙ্গা ও অশান্তির সৃষ্টি হয়নি, সকল সম্প্রদায়ের মানুষজনের মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বিরাজ করছিল।
এ উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সবাই কি বহিরাগত? না, তা নয়। মধ্য এশিয়ার কিছু সংখ্যক সাহসী মুসলিম যোদ্ধা ও সৈনিক ভাগ্যান্বেষণে এদেশে এসেছিলেন, কিন্তু ধর্ম প্রচার করার কোন উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। আরব বণিকগণও বাণিজ্য উপলক্ষ্যে এখানে আগমণ করেছেন। মুসলিম শাসকবৃন্দ এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিশেষ কোন ভূমিকা পালন করেননি, বরং পীর-আওলিয়া-দরবেশগণ এদেশে ইসলাম প্রচারের মহান ব্রত পালন করেছেন। জাতিভেদ ও কৌলীন্য প্রথার কশাঘাতে জর্জরিত অচ্ছুৎ নিম্নবর্ণের হিন্দু সমাজ ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্ব ও উদারতার নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ফলে এ উপমহাদেশে দ্রুত ইসলামের বিস্তার লাভ ঘটে। সুতরাং এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, এদেশের মুসলমানরা বহিরাগত নয়, বরং এখানকারই ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠী। বঙ্গদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয় ১২০১ সালে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে। বঙ্গদেশে সুলতানশাহী ও মোঘল আমলে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতির উৎপত্তি হয় এবং মুসলিম শাসকবৃন্দ এখানকার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিমূলক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারায় কখনোই নাক গলায়নি। এ সময়ে সরকারী কর্মকান্ডে ‘ফারসী’ সংস্কৃত ভাষার স্থলাভিষিক্ত হয়। মুসলিম শাসনের পূর্বে সেন রাজাদের রাজত্বকালীন সময়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাষা ‘বাংলা’ ছিল অচ্ছুৎ এবং অপাঙক্তেয়, রাজদরবারে এর প্রবেশাধিকার ছিল না। সেন রাজন্যবর্গ ছিলেন সংস্কৃত ভাষার পৃষ্টপোষক এবং তাঁদের সময়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ পুরোহিতগণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বাংলার ব্যবহারের ওপর শুধু ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা জারী করেই ক্ষান্ত হননি যে, বরং যারা বাংলায় অনুদিত ধর্ম-কথা শ্রবণ করবে তারা ‘রৌরব’ নামক এক নিকৃষ্ট নরকে চিরস্থায়ী হবে - এ সাবধান বার্তাটিও প্রচার করেছিলেন। ব্রাহ্মণ পন্ডিত ও পুরোহিতগণের একচ্ছত্র প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হয়ে তৎকালীন হিন্দু রাজন্যবর্গ সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলার প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গবেষক ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর ‘বাংলা ভাষা ও সািহত্য’ নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে বাংলার মুসলিম সুলতানগণের বাংলাভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চার এক সুন্দর বিবরণ তুলে ধরেছেন। সুলতান নসরত শাহ্, হুসেন শাহ্ ও শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ প্রমুখের শাসনামলে তাঁরা সাধারণ হিন্দু জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির চর্চার দ্বারকে অবারিত করে দেন। সুলতানী আমলে বাংলাভাষার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন ঘটে। বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষার প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি পরিপূর্ণ ভাষা রূপে মুসলিম রাজদরবারে মর্যাদা লাভ করে এবং সরকারের স্থানীয় কর্মকান্ডে এর ব্যবহার স্বীকৃত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে গৌড়ের সুলতান নসরত শাহের রাজত্বকালে সর্বপ্রথম ‘রাময়ণ’ ও ‘মহাভারত’ মহাকাব্য দু’টি বাংলায় অনুদিত হয়। এ কাজে তাঁর সেনাপতি পরাগল খাঁ ও সেনাপতি-পুত্র ছুঁটি খাঁর সবিশেষ অবদান ছিল। কবীন্দ্র পরমেশ্বর এ দু’টি মহাকাব্যের অনুবাদক ছিলেন। সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহের উৎসাহে কবি মালাধর বসু হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ ভগবৎ গীতা’ এর কয়েকটি অধ্যায় বাংলায় অনুবাদ করে ‘গুণরাজখান’ উপাধি লাভ করেন। এছাড়া এ সময়ে দৈনন্দিন সরকারী কর্মকান্ডে ও দলিল-পত্রে বাংলাভাষার প্রচলন শুরু হয়। মধ্যযুগে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে মুসলিম শাসকদের অবদান ইতিহাসের একটি স্বীকৃত বিষয়, কারণ এ সময়েই বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষার কৌলীন্যকে পাশ কাটিয়ে এবং গ্রামীন কুঁড়েঘর ছেড়ে সাহিত্যের রাজপথে চলার সামর্থ্য অর্জন করে।
মুসলিম শাসনামলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের সাথে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান সমাজের কোন দ্বন্দ-কলহ ছিল না। রাজায় রাজায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু প্রতিবেশী হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বা প্রাণহাণির কোন খবর তৎকালীন ইতিহাসের পাতায় নেই। হিন্দুদের পূজা-পার্বণ ও মুসলমানদের মহররম ও ঈদ উৎসবে তাঁদের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সে সময়কার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। মন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, ইত্যাদি উচ্চ সরকারী পদে হিন্দু ধর্মালম্বীদের অংশগ্রহণ ছিল অবারিত। হিন্দু কবি, সঙ্গীতজ্ঞ ও গুণীজনের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল মুসলিম রাজদরবার। সবাই ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্দ্ধে ওঠে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় সবাই সহানুভুতির মনোভাব নিয়ে একাত্ম হয়ে কাজ করেছেন। বন্যা ও খরায় ফসলহানির ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য প্রজারা খাজনা রেয়াত ছাড়াও ‘তাকাবি’ (কৃষি) ঋণ পেয়েছেন। তখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। ‘গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ’ ছিল তখনকার সমৃদ্ধির প্রতীক। বাংলার ‘মসলিম বস্ত্র’ শিল্প ছিল পৃথিবী জুড়ে সমাদৃত। ব্যবসা-বাণিজ্যে বঙ্গদেশের সমৃদ্ধি ছিল ঈর্ষনীয়। বাংলা ছিল সমগ্র ভারতের ধন-ভান্ডার। তাই মোঘলরা এর নাম দিয়েছিল ‘স্বর্গ-রাজ্য’। ‘ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ কবির দেশ-বন্দনার এ সঙ্গীতটি ছিল তৎকালীন বাংলার সুখ-সমৃদ্ধির এক মনোরম চিত্র। (চলবে)
বিষয়: বিবিধ
৩২৯৩ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক নয় বলে এটা সম্ভব হয়েছে। হিন্দু রাজদরবারে এটা কখনো সম্ভব হত না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন