পবিত্র হজ্জ্ব: মিল্লাতে ইব্রাহীমের নিদর্শন
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০৪ অক্টোবর, ২০১৩, ১২:১৩:০৮ রাত
প্রায় চার হাজার বছর পূর্বের কথা। মানব সমাজ যখন পৌত্তলিকতার অভিশাপে নিমগ্ন তখন ইরাকের ব্যবিলন রাজ্যে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর জন্ম। তাঁর পিতা আযর শুধু মূর্তিপূজকই ছিলেন না, পেশায় একজন মূর্তি-নির্মাতাও ছিলেন। কিন্তু তরুণ ইব্রাহীমের মন এ ধরনের ধর্ম-কর্মে মোটেই সায় দিচ্ছিল না। নিজ হাতে গড়া প্রতিমা কিভাবে তাঁর উপাস্য হতে পারে তা ভেবে তিনি কূল পাচ্ছিলেন না। তাঁর এ মানসিক অবস্থা মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেন: “স্মরণ করুন, যখন ইব্রাহীম তাঁর পিতা আযরকে বলল, তুমি কি প্রতিমাগুলোকে উপাস্য বলে মনে কর? আমি তো দেখতে পাচ্ছি, তুমি ও তোমার সম্প্রদায় স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় নিমগ্ন। আমি এভাবেই ইব্রাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অত্যাশ্চর্য বস্তুসমূহ দেখাতে লাগলাম - যাতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অনন্তর যখন রাতের আঁধার তাঁর ওপর সমাচ্ছন্ন হল, তখন সে একটি নক্ষত্র দেখতে পেয়ে বলল, এটা আমার প্রতিপালক। অতঃপর যখন তা অস্তমিত হল তখন সে বলল, আমি অস্তগামীদেরকে পছন্দ করি না। অতঃপর যখন চাঁদকে ঝলমল করতে দেখল, বলল, এটাই আমার প্রতিপালক। অনন্তর যখন তা অস্তমিত হয়ে গেল, তখন সে বলল, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ-প্রদর্শন না করেন, তবে অবশ্যই আমি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। অতঃপর যখন সূর্যকে উদিত হতে দেখল, সে বলে ওঠলো, এটি বৃহদাকার, এটাই আমার পালনকর্তা। অতপর যখন সেটিও অস্তমিত হল, তখন সে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি সেসব থেকে নির্লিপ্ত। আমি একনিষ্ঠ হয়ে আমার মুখ ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই” (৬:৭৪-৭৯)। তাঁর এ দৃঢ় উপলব্ধী তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় উপাস্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাসী এবং একমাত্র তাঁরই উপাসনায় নিবেদিত হতে সাহায্য করল। ইব্রাহীম (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় ইব্রাহীম ছিল এক সম্প্রদায়ের প্রতীক, সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহরই অনুগত হলো এবং সে শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সে তাঁর অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী ছিল। আল্লাহ্ তাঁকে মনোনীত করলেন এবং সরল পথে পরিচালিত করলেন। আমি তাঁকে দুনিয়াতে দান করেছি কল্যাণ এবং সে পরকালেও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে” (১৬:১২১-১২২)।
মহান আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে নবুওয়্যত দান করলেন এবং মানব সমাজে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু এ প্রচার কাজ খুবই কঠিন হয়ে ওঠল যখন পৌত্তলিকতায় নিমজ্জিত তাঁর সম্প্রদায়, এমন কি তাাঁর পিতাও তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অবস্থা এমনই বিরোধীতার পর্যায়ে পৌঁছাল যে, “যখন ইব্রাহীম তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা যাদের পূজা কর, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার সম্পর্ক তাঁর সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন” (৪৬:২৬-২৭)। একত্ববাদের ওপর প্রতিষ্টিত আল্লাহর সত্য দ্বীন প্রচার করতে গিয়ে তিনি বাদশাহ নমরুদের কোপানলে পড়েন। বাদশাহর সাথে তাঁর তর্ক-বিতর্কের বিষয় পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ এভাবে উদ্ধৃত করেন: “তুমি কি সে ব্যক্তিটিকে দেখনি আল্লাহ্ যাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছিলেন, সে ইব্রাহীমের সাথে বাদানুবাদ করেছিল বিশ্বপালকের ব্যাপারে? ইব্রাহীম যখন বলল, আমার পালনকর্তা হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমি জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইব্রাহীম বলল, নিশ্চয়ই তিনি সূর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে এবার তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত কর। তখন সে (সত্য) অস্বীকারকারী (বাদশাহ) হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ্ সীমালংঘণকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না” (২:২৫৮)। বাদশাহর লোকজন এ বাদানুবাদের কারণে তাঁকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করল। এ কঠিন বিপদে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ধৈর্য ধারন করলেন এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করলেন। আগুনের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এলো: “হে অগ্নি, তুমি ইব্রাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও” (২১:৬৯)। মহান আল্লাহর কি অপার মহিমা, আগুন তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করল না, তিনি অগ্নিকুন্ডে নিরাপদ রইলেন।
ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্জ্ব পালন, যার সূচনা হয়েছিল হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর আমলে। আল্লাহর নির্দেশে তিনি মানব জাতির উপাসনার জন্য পবিত্র মক্কা নগরীতে নির্মাণ করলেন কা’বা গৃহ। আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ পবিত্র ঘরকে কেন্দ্র করে হজ্জ্ব পালন ও তাওয়াফ করার জন্য দুনিয়বাসীর প্রতি ঘোষণা প্রচার করলেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন, “যখন আমি ইব্রাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্যে, নামাযে দন্ডায়মানদের জন্যে এবং রুকু-সেজদাকারীদের জন্যে। এবং মানুষের মধ্যে হজ্জ্বের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পাহাড়-উপত্যকার পথ বেয়ে তোমার কাছে আসবে পায়দলে এবং সর্বপ্রকার হালকা-পাতলা উটে সওয়ার হয়ে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং এই সুসংরক্ষিত গৃহের তাওয়াফ করে” (২২:২৬-২৯)। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মতের ওপর হজ্জ্ব পালন ফরজ করা হয়। আল্লাহর তরফ থেকে পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল হল: “নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মকামে ইব্রাহীমের মত প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে, লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ্ব করা হলো মানুষের উপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার (সে হজ্জ্ব পালন করবে)। আর যে লোক তা মানে না, (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ্ সারা বিশ্বের কোন কিছুরই পরোয়া করেন না” (৩:৯৬-৯৭)। সঙ্গতিসম্পন্ন মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ্জ্ব পালন করা ফরয। এটি একটি অতি পূণ্যময় ইবাদত এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম। হাদীস গ্রন্থ বুখারী ও মুসলিম শরীফে সংকলিত হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে নবী করিম (সাঃ) হজ্জ্বের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ্ব করেছে এবং তাতে কোনরূপ অশ্লীল কথা বলেনি এবং অশ্লীল কাজ করেনি, সে ব্যক্তি হজ্জ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করবে এমন পাপমুক্ত অবস্থায় সেই দিনের ন্যায় যে দিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে”।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বন্ধু। তিনি তাঁকে খেতাব দিলেন ‘খলীলুল্লাহ্’, কারণ আল্লাহর অসীম কৃপায় বন্ধুত্বের সকল পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। বন্ধুত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে মানবজাতির নেতৃত্ব দান করলেন, আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত কা’বা ঘর ও মক্কা নগরীকে তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার ধাম বানিয়ে দিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর প্রতিশ্রুতি এভাবে ব্যক্ত করলেন: “যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পালন করলেন, তখন তাঁর পালনকর্তা (আল্লাহ্) বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। সে বলল, আমার বংশধর থেকেও? তিনি বললেন আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না। যখন আমি কা’বা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ‘মাকামে ইব্রাহীমকে’ (ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে) নামাযের জায়গা বানাও এবং আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। যখন ইব্রাহীম বললেন, প্রভু! এ স্থানকে তুমি শান্তিধাম কর এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করে, তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রিযিক দান কর। (আল্লাহ্) বললেন, যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরও কিছুদিন ফায়দা ভোগ করার সুযোগ দেব, অতঃপর তাদেরকে বলপ্রয়োগে দোযখের আযাবে ঠেলে দেবো; সেটা নিকৃষ্ট বাসস্থান। স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তাঁরা দোয়া করেছিলঃ প্রভু! আমাদের থেকে কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। পরওয়ারদেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্জ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি তওবা কবুলকারী, অতিশয দয়ালু। হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ কর যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন। এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী কুশলী। যে নিজেকে মূর্খ বানিয়ে রেখেছে সে ছাড়া আর কে ইব্রাহীমের ধর্ম থেকে মুখ ফেরায়? নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে (নবী) মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে। স্মরণ কর, যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেন, অনুগত হও। সে বলল, আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম। ইব্রাহীম তাঁর সন্তানদের এরই (এই দ্বীনের আনুগত্যের) ওছিয়ত করেছে এবং ইয়াকুবও (তাঁর সন্তানদের) এই বলে ওছিয়ত করেছে যে, হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনও মৃত্যুবরণ করো না” ২:১২৪-১৩২ ।
আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বন্ধু ইব্রাহীমকে আরো কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিলেন যখন ইব্রাহীম তাঁর প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কে কোরবাণী দিতে স্বপ্নাদিষ্ট হলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ঘটনাটি এভাবে বিবৃত করেন: “অতঃপর সে (ইসমাঈল) যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ্ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যধারনকারী হিসেবে পাবেন। যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল; তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি” (৩৭:১০২-১০৭)। হজ্জ্বের পর হালাল পশু কোরবাণীর বিধান জারী করে আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বন্ধুর এ মহান আত্ম-ত্যাগের ঘটনাটি মানব জাতির নিকট চিরস্মরণীয় করে রাখলেন।
ওমরা ও হজ্জ্বের সময়ে কা’বা শরীফ তাওয়াফের পর সাফা-মারওয়া পাহড়ে সাতবার সায়ী করার বিধানটিও হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পবিত্রা স্ত্রী বিবি হাজেরার স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। আল্লাহর নির্দেশে আবারো কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে যখন নবী ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হাজেরা ও শিশু পুত্র হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে মক্কার মরুময় উপত্যকায় নির্বাসন দিলেন তখন মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেন, “হে আমাদের পালনকর্তা, আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি; হে আমাদের পালনকর্তা, যাতে তারা নামায কায়েম রাখে। অতঃপর আপনি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রুযী-রিজেক দান করুন, সম্ভবতঃ তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে” (১৪:৩৭)। জনমানবহীন, বৃক্ষ-লতা-জলহীন ঊষর মরুতে শিশুপুত্র ইসমাঈল পিপাসায় যখন কাতরাচ্ছিলেন তখন মা হাজেরা সাফা-মারওয়া পাহড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেও যখন পানির সন্ধান পেলেন না, ফিরে এস দেখলেন আল্লাহর কি অসীম মহিমা, ইসমাঈলের পায়ের নীচে একটি ঝর্ণা থেকে পানি উৎসারিত হচ্ছে। এ ঝর্ণাটিই সুবিখ্যাত ‘আবে যমযম’ - যা আজো লক্ষ লক্ষ মানুষকে পানি বিলিয়ে যাচ্ছে। ওমরা ও হজ্জ্ব পালনকারীগণ নিয়ম মাফিক সায়ীর উদ্দেশ্যে সাফা-মারওয়া পাহড়ে সাতবার দৌঁড়ানোর ব্যাপারটি মা হাজেরার স্মৃতিকেই ধারন করে আছে।
কালের পরিক্রমায় মানুষ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) প্রচারিত সত্য দ্বীন ভুলে গিয়ে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনার পরিবর্তে পৌত্তলিকতায় নিমজ্জিত হল। মক্কার কা’বা গৃহে তারা তিনশত ষাটটি মূর্তি স্থাপন করে এসব দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা করতে লাগল। মক্কার ইতিহাসে এ সময়টি ‘আইয়্যামে জাহেলিয়াত’ বা বর্বর যুগ নামে পরিচিত। আল্লাহ্কে ভুলে পাপাচার ও পঙ্কিলতার অন্ধকারে নিমজ্জিত সে সময়কার লোকজন ছিল সত্যিকার অর্থেই পথভ্রষ্ট। আর এ সময়ই মক্কার বুকে হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) এর বংশে জন্ম নিলেন সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়্যত প্রাপ্ত হলেন এবং আল্লাহর ওহী লাভ করলেন: “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করছি যে, ইব্রাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না” (১৬:১২৩)। “তার চাইতে উত্তম জীবন বিধান আর কি হতে পারে যে আল্লাহ্ তায়ালার উদ্দেশ্যে মাথা নত করে দেয়, (মূলত) সে-ই হচ্ছে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি, (তদুপরি) সে ইব্রাহীমের আদর্শের অনুসরণ করে; আর আল্লাহ্ তায়ালা ইব্রাহীমকে স্বীয় বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন” (৪:১২৫)। “তোমাদের জন্যে ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের (ঘটনার) মধ্যে রয়েছে (অনুকরণযোগ্য) আদর্শ” (৬০:৪)।
তৌহিদ অর্থাৎ আল্লাহর একত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সারা বিশ্বে যে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তা-ই হচ্ছে মিল্লাতে ইব্রাহীমের ধারাবাহিকতা। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর ঘর কা’বা শরীফ থেকে পৌত্তলিকার নিদর্শন দেব-দেবীর মূর্তি অপসারণ করে একে পূত-পবিত্র করেন। কা’বা গৃহটিকে তিনি এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর উপাসনাগারে রূপান্তরিত করেন হজ্জ্ব ও ওমরা পালনকারীদের তাওয়াফের জন্যে, নামাযে দন্ডায়মানদের জন্যে এবং রুকু-সেজদাকারীদের জন্যে। তখন থেকেই বিশ্ব মুসলিমের সম্মিলন কেন্দ্র এবং আধ্যাত্মিক রাজধানী মক্কা নগরীর এ গৃহ থেকে সর্বক্ষণই উচ্চারিত হচ্ছে মহান আল্লাহর একত্ববাদের বাণী। পবিত্র হজ্জ্ব মওসুমে যখন বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারী এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর মহমিা ও গুণগান কীর্তনের জন্য একই পোষাকে এ ঘরটিতে সমবেত হন তখন মক্কা মুয়াজ্জমা ও তার আশপাশ মীনা ময়দান, আরাফার মাঠ ও মুজদালেফা নানা দেশের, নানা বর্ণের, নানা গোত্রের, বিচিত্র ভাষাভাষি মানুষের আগমণে পরিণত হয় এক শ্বেত-শুভ্র মানব সমুদ্রে। তাদের প্রতিটি কণ্ঠে একই শব্দাবলী উচ্চারিত হতে থাকে - ‘আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ অর্থাৎ আমি হাজির, হে প্রভু, আমি তোমার আহবানে - তোমারই দরবারে হাজির। আর মানবজাতির এ মহাসমাবেশের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় মিল্লাতে ইব্রাহীমের নিদর্শন।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন