বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১১:০৩:৩০ রাত



প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার শিরোণাম হচ্ছে ‘ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর গুলিতে বাংলাদেশী নিহত’ - কিন্তু এর বিপরীতে এমন সংবাদ কখনো দেখা যায়নি যে, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীর গুলিতে ভারতীয় নিহত হয়েছে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে প্রতিনিয়ত হয়রানী, নির্যাতন ও হত্যার ছবি বিশ্বের বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে ব্যথিত করেছে, সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে থাকা বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর লাশ, ভিডিও ক্লিপে সীমান্তে এক বাংলাদেশী নাগরিককে নগ্ন করে অত্যাচারের নির্মম দৃশ্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অমানবিক ও অমার্জনীয় আচরণকে সারা বিশ্বে পরিস্ফুট করে তোলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক পুলিশকে দেয়া তাদের নিজস্ব রিপোর্টে গুলিতে নিহত বাংলাদেশী নাগরিকদের কারো নিকটই কোন অস্ত্র পাওয়া যাবার কথা উল্লেখ করেনি। অথচ ‘রহস্যজনক’ কারণে বাংলাদেশের সরকার নিজের নিরীহ নাগরিকদেরকে হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার পরিবর্তে নমনীয়তা প্রদর্শন করে চলেছে। পনেরো বছরের কিশোরী ফেলানী ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়ে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হযে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ঝুলে রইল। বিশ্বের অধিকাংশ গণমাধ্যমে কাঁটাতারের বেড়ার গায়ে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশের ছবি প্রচারিত হয়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এ নির্মম হত্যাকান্ড সমগ্র বিশ্বের মানুষকে ব্যথিত করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে কোন অনুশোনাবোধ জাগাতে পারেনি। সম্প্রতি ভারতীয় আদালতে ফেলানী হত্যার বিচারের যে প্রহসনটি সংঘটিত হলো তা শুধু হতাশব্যঞ্জকই নয়, লজ্জাজনকও বটে। ভারতীয় আদালত ঘাতককে বেকসুর খালাস দিয়ে এই বর্বরতম হত্যাকান্ডের বিচারটিকে বিবেকহীন প্রহসনে পরিণত করল। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ সরকার এই প্রহসনমূলক বিচারের রায়ের কোন প্রতিবাদ সরকারীভাবে এখনো করেনি।

ভারতের সাথে নেপাল, ভূটান, মিয়ানমার, চীন প্রভৃতি দেশ এবং পাকিস্তানের মত চরম এক শত্রুভাবাপন্ন দেশেরও সীমান্ত রয়েছে - কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষীর হাতে সেসব দেশের এত বেশী নাগরিক এভাবে নিহত হয়েছে এমন খবর খুব কমই পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ’ এর তথ্যানুযায়ী গত দশ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী এক হাজারেরও অধিক বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে। ভারতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান বিচারপতি বালকৃষ্ণ সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণকালে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধের ব্যাপরে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন। এছাড়া সীমান্তে এ ধরণের হত্যাকান্ড বন্ধে ভারতীয় সর্বোচ্চ মহল থেকেও বার বার ওয়াদা করা হয়েছে। উভয় দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়েও হত্যাকান্ড বন্ধ করার ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছিল। তারপরও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অবিমৃশ্যকারিতার জন্য এসব হত্যা কখনোই বন্ধ হয়নি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান ইউ কে বনশাল বিবিসি’র সাথে সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে যখন বলেন, ‘বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি চালানো বন্ধ হবে না’, তখন বুঝতেই হবে বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর এ অমানবিক হত্যাকান্ড ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্তা ব্যক্তিদের অবিবেচক মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। তাদের মতে এসব হত্যাকান্ড উভয় দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলবে না। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী তো বলেই ফেললেন সীমান্তে হত্যাকান্ডে রাষ্ট্র ‘চিন্তিত’ নয়। তাদের এসব মন্তব্যে দেশপ্রেমের বদলে ভারতপ্রেমই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলতঃ সরকারের একটি প্রধান কাজ। জনগণের সমর্থন নিয়ে যখন কোন দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখন আপামর জনগণের স্বার্থরক্ষাই সে সরকারের মূখ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের ব্যর্থতার কারণে প্রতিদিনই দেশের অভ্যন্তরে যেমন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এবং ফলে হত্যা-গুমসহ নানাভাবে জনগণের জান-মালের ক্ষতি সাধন হচ্ছে, তেমনি সরকারের নিস্পৃহতার কারণে সীমান্তেও বিদেশী বাহিনীর নিকট নিরীহ জনগণ হরহামেশাই প্রাণ দিচ্ছে। অথচ সরকার অস্বাভাবিকভাবে নিশ্চিন্ত এবং নিষ্ক্রিয়। এসব ঘটনা সরকারকে একটি চরম ব্যর্থ সরকারে পরিণত করেছে।

এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। শত কোটিরও অধিক জনগোষ্ঠী অধ্যুসিত ভারত একটি বিরাট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বিশ্বের এক উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি। এ বিরাট দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা প্রতিটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই একান্ত কাম্য। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গভীর সম্পর্কোন্নয়নে দুটি দেশের মধ্যে বেশ কিছু সহযেগিতামূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়। একেতো তিন দিকে অভিন্ন সীমান্ত, অভিন্ন নদ-নদী, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক শান্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে এসব সহযোগিতামূলক চুক্তি বাস্তবায়ন ছিল অপরিহার্য। কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুরু হয় ভারতীয় আগ্রাসন। বেআইনী তৎপরতা বন্ধের অজুহাতে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের শত শত মাইল এলাকা জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে, যার নজীর খুব কম দেশের সীমান্তেই দেখা যায়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় আরো যে সব বিষয় পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরায় তা হলো ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে এক তরফাভাবে অভিন্ন নদী গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করায় শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে পানি শূণ্যতা দেখা দেয় এবং বর্ষায় বাঁধের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে প্রবল বন্যার সুষ্টি হয় যা দেশের কৃষি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় দু দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। পরবর্তীতে দীর্ঘ দেন-দরবারের পর দুই দেশের মধ্যে পানি ভাগা-ভাগির একটি চুক্তি হয়। কিন্তু চুক্তির শর্তানুযায়ী বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য পানি দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত সব সময়ই শর্ত লঙ্ঘন করছে। ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখায় পানি শূণ্যতার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলদেশের রাজশাহী বিভাগে মরুময়তা ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে লবণাক্তার সৃষ্টি হয় যা পরিবেশ, কৃষি ও অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এদিকে তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম-বঙ্গ সরকারের অসহযোগিতার কারণে বাস্তবায়িত হতে পারেনি। বঙ্গোপসাগরের জলসীমা নিয়েও বিগত চল্লিশ বছর ধরে উভয় দেশের বিরোধের এখনো কোন সুরাহা হয়নি। অবশেষে মীমাংসার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টিকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

গায়ে পড়ে এবং দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষার আওয়ামী সরকারের নীতিটি খুবই ন্যাক্কারজনক। ভারত যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থকে বারবার পদদলিত করছে সেখানে তাদের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারটিকেই আমাদের সরকার প্রাধান্য দিচ্ছি। বাংলাদেশকে অবহিত না করে ভারত কর্তৃক ত্রিপুরায় অভিন্ন নদী সুরমা ও কুশিয়ারার উৎসমুখে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ পরিকল্পনা আমাদের আরো একটি বড় ভারতীয় আগ্রাসন। অথচ আমরা দেখছি, কিভাবে বর্তমান সরকার ভারতের সাথে ট্র্যানজিট চুক্তি ছাড়াই নিজেদের রাস্তা-ঘাটের ক্ষতি করে, এমনকি নিজ দেশের নদীর পানি প্রবাহকে বন্ধ করে তার ওপর বাঁধ নির্মাণ করে ত্রিপুরা রাজ্যের বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্পের ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহনে ভারতকে সহায়তা প্রদান করেছে। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সম্পাদনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও ভারত ছিটমহল সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সমাধান আজো করেনি, এমনকি সামান্য ‘তিন বিঘা করিডোরটি’ বাংলাদেশকে হস্তান্তর করতে পারেনি, যদিও হস্তান্তরের পরিবর্তে ভারতীয় তত্ত্বাবধানে এ করিডোরটি চব্বিশ ঘন্টা খোলা রাখার ব্যাপারে ২০১১ সালে একটি সুরাহা হয়েছে। এদিকে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবেলায় বাংলাদেশী পণ্য ভারতে রপ্তানীর ক্ষেত্রে যেসব শুল্ক ও অশুল্ক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তা অপসারণে ভারতের গড়িমসি বাণিজ্যিক সম্পর্কোন্নয়নে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। অপর দিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর নিষ্ক্রিয়তার কারণে সীমান্তে অবৈধ অস্ত্র পাচার ও মাদক চোরাচালান বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া ভারতীয় টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে প্রচারে কোন বাধা না থাকলেও ভারতে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল প্রচার নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এসব আগ্রাসন ও অসহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

মুক্তি যুদ্ধের সময় ভারত যে বিশাল উদারতা ও সহযোগিতার পরিচয় দিয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা ক্রমশঃ বিলীন হতে শুরু করে। এ সময় দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন সহযেগিতামূলক চুক্তি বাস্তবায়নে অনীহা, দীর্ঘসূত্রিতা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চুক্তির বরখেলাফ প্রভৃতি কারণে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ধ্বস নামে। ভারতের সঙ্কীর্ণ ও অবন্ধুসুলভ মনোভাবের কারণে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত সম্পর্কে সন্দেহ ও তিক্ততা বিরাজ করছে। অপরদিকে বাংলাদেশ সম্পর্কেও একটি ভুল ধারণা ভারতীয় সর্বোচ্চ মহলে বিরাজমান। সম্প্রতি এক প্রেস সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধান মন্ত্রী মনমোহন সিং এর একটি ভুল মন্তব্য বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে তাদের এ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ মৌলবাদী জামাতে ইসলামীর সমর্থক এবং ভারত বিরোধী। উভয় দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও তিক্ততার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সম্পূর্ণ দূরীভূত না করা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বাস ও সম্প্রীতি ফিরে আসা দুরূহ হবে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার যে নতজানু নীতি ও কৌশল নিয়ে ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য চেষ্টা করছে তা ফলপ্রসু হওয়র চেয়ে বাংলাদেশের মর্যাদাকেই বহুলাংশে ভূলুন্ঠিত করে দিচ্ছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদাকে সমুন্নত রেখে ভারত যদি তার সহযোগিতা ও সমঝোতার হাত প্রসারিত করতে ব্যর্থ হয় তা হলে উভয় দেশের সম্পর্কোন্নয়ন সুদূর পরাহত হবার সম্ভাবনাই বেশী।

বিষয়: বিবিধ

১১৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File