নবী-রাসুলদের প্রতি কটাক্ষকারী বক্তব্যের জবাবে
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ০২ জুলাই, ২০১৩, ১১:০৭:১১ রাত
[ইদানীং টুডে ব্লগে মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে নানা ধরনের কটুক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে - যা খুবই দুঃখজনক এবং আমাদের এ মুসলিম প্রধান সমাজে একান্ত বেমানান। আল্লাহর নবী (সাঃ) কে যারা হেয় প্রতিপন্ন করে তাদের শাস্তি একদিন আল্লাহর তরফ থেকেই নাযিল হবে। এসব কটুক্তির প্রতিবাদস্বরূপ এবং কটুক্তিকারীদের হেদায়েতের জন্যই আমার এ লিখন]
এ অনন্ত-অসীম মহা বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হলেন আল্লাহ্ তায়ালা। জল-স্থল, আকাশ ও ভূ-গর্ভে বিচরণশীল বিচিত্র প্রাণী, আলো-বাতাস এবং মেঘ-বৃষ্টির প্রবাহ, দিন-রাতের আবর্তন ও ঋতুর পরিবর্তন, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র খচিত নীলাকাশ এবং বৃক্ষ-লতা, নদী-সাগর, বন-পাহাড় শোভিত মনোরম প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য সবই তাঁরই সৃষ্টি। সৃষ্টির অফুরন্ত নিয়ামত, বিশ্ব-প্রকৃতির এ বিরাট বিশাল আয়োজন, এর কোন কিছুই নিরর্থক নয়। এসবের পিছনে সৃষ্টিকর্তার এক মহান উদ্দেশ্য কাজ করছে। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানব জাতিকে আল্লাহ্ এ পৃথিবীতে তাঁর খলীফা হিসেবে পাঠিয়েছেন এবং এ বিশ্ব-প্রকৃতিকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো - মানুষ কৃতজ্ঞ চিত্তে আল্লাহর এ অসীম নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করবে, সৃষ্টিকে ভালবেসে দুনিয়ার বুকে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করবে ও তাঁর বিধান মেনে ন্যায়-নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু মানুষ যখনই তার এ উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত ও বিপথগামী হয়েছে এবং অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়নের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে ঠিক তখনই আল্লাহ্ মানুষের হেদায়েতের জন্য নবী-রাসুলকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য সদুপদেশপূর্ণ আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন, নিজেরা যেমন সৎ ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেছেন তেমনি অন্যদেরকেও সৎ পথ প্রদর্শন করেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বজাতিকে সতর্ক করেছেন যাবতীয় পাপাচার থেকে এবং অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদের লোভে তাঁরা এ কাজ করেননি এবং এর জন্য কোন পারিশ্রমিকও দাবী করেননি। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার বুকে একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
মহান আল্লাহ্-তায়ালা মানুষকে বিশেষ মর্যাদা ও অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন এবং দিয়েছেন ঐশী জ্ঞান যাতে সে এ পৃথিবীতে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে । সে জন্য তিনি যুগে যুগে নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন এবং হেদায়েতের দিক্-নির্দেশনা দিয়ে ঐশী গ্রন্থসমূহ নাযিল করেছেন। হযরত আদম (আঃ) থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসুল মানুষকে আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করেছেন এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য মেনে নিয়ে তাঁর দেয়া বিধান অনুসারে সৎ ও ন্যায়-ভিত্তিক জীবন যাপন করার তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ বলেন, “তিনিই আল্লাহ্ যিনি সত্য (দ্বীনসহ) এ গ্রন্থ ও (ইনসাফের) মানদন্ড নাযিল করেছেন” (৪২-১৭)। যারা একমাত্র আল্লাহ্ ও তাঁর প্রেরিত নবী ও রসুল এবং তাঁর নাযিলকৃত গ্রন্থসমূহের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁরই প্রদর্শিত পথে চলেছে, সৎ কাজ করেছে এবং সমাজে ইনসাফকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, “এ লোকগুলোই তাদের প্রভুর প্রদর্শিত সঠিক পথের ওপর রয়েছে এবং এরাই হচ্ছে সফলকাম” (২-৫)।
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) যে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইতিহাসে তা আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত ছিল। সকল নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত সে সময়টা ছিল মানবজাতির জন্য চরম অবমাননাকর ও হতাশব্যঞ্জক। নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার ও ধর্ষণ মানবতাকে করেছিল ভূলুন্ঠিত। পৌত্তলিকতা, গোত্রে গোত্রে হানাহানি, বংশ পরম্পরায় প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের অনল প্রবাহ এবং অশান্তির করাল ছায়া সারা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ছিল। দাস প্রথা এবং কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করার মতো বর্বর প্রথাও চালু ছিল সে যুগে। শিশু মুহাম্মদ জন্মের পূর্বে পিতা, এর কয়েক বছর পর মাতাকে হারিয়ে হয়েছেন অনাথ। প্রথমে পিতামহ এবং পরে পিতৃব্যের তত্ত্বাবধানে বড় হয়েছেন। শৈশবে লেখাপড়ার বদলে চরিয়েছেন মেষ ও বকরীর পাল, যৌবনে পদার্পণের সাথে সাথে পিতৃব্য আবু তালেবের সঙ্গী হয়ে ব্যবসায়িক সফরে গিয়েছেন । সে অন্ধকার যুগে তিনি ছিলেন সততা, বিশ্বস্ততা ও উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং মানবতার প্রতীক। স্বীকৃতি স্বরূপ জনগণ তাঁকে দিয়েছিল ’আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধি। আর চল্লিশ বছর বয়সে মহান আল্লাহর তরফ থেকে তিনি লাভ করলেন নবুয়্যত - আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন তাঁকে সমগ্র মানবজাতির জন্য মনোনীত করলেন সর্বশেষ নবী এবং অভিহিত করলেন ’রাহমাতুল্লিল আলামীন’ অর্থাৎ জগতসমূহের অশীর্বাদ হিসেবে। তাঁকে ভূষিত করলেন সর্বোত্তম গুণাবলীতে এবং তাঁর অনুপম চরিত্র মাধুর্যকে করলেন সর্বযুগের সকল মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ ।
মানবজাতি যখন এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর আনুগত্য ছেড়ে বিভিন্ন ধরণের ভ্রান্ত বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং পৌত্তলিকতায় লিপ্ত তখনি বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানালেন আল্লাহ্র একত্ববাদের দিকে। বহুশত উপাস্যের দাসত্বের নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র আনুগত্যপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল ভেদাভেদের উর্দ্ধে ওঠে সত্য, ন্যায়, সততা ও সমতার ভিত্তিতে এক শান্তিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই ছিল এ আহ্বানের মূল লক্ষ্য। একমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্যহীন জীবন দুনিয়া ও আখিরাতে কি ধরণের গুরুতর বিপদ বয়ে আনতে পারে সে বিষয়ে তিনি সতর্ক করলেন মানুষকে। ‘আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল’ - এ কলেমার দাওয়াত তিনি পৌঁছে দিলেন ঘরে ঘরে। আল্লাহ্ প্রেরিত সকল নবী রাসুল একই ধরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁদের স্বজাতিকে। তাঁদের এ সর্বজনীন আহ্বানে সমাজের কিছু সংখ্যক গরীব ও দুর্বল লোক সাড়া দিলেও অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় ও বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গ তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি - তারা এর বিরোধিতা করেছে এবং প্রতিরোধের জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে নবী-রাসুলগণ হয়েছিলেন ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্র, নির্যাতন ও নিপীড়ণের শিকার, হত্যা ও নির্বাসনের বলি। ইতিহাস এসবের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। শেষ নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পর নবী-রসুল আগমণের ধারা বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো তাঁদেরকে নিয়ে নানা ধরণের কটাক্ষ ও উপহাস এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
মানবতার শিক্ষক এসব নবী-রাসুলের সম্মান ও মর্যাদা ইসলাম ধর্মে সবার ওপরে। মুসলিম উম্মাহর নিকট তাঁরা সকলেই একইভাবে সম্মানার্হ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর সকল নবী-রাসুল ও তাঁদের নিকট প্রেরিত ঐশী গ্রন্থসমূহের ওপর বিশ্বাস রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন (২:২৫৩)। যুগে যুগে মানুষ তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও সামাজিক রীতি-নীতি নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েছে, ফলে বহু বিভাজন ও বহু মত-পথের উদ্ভব ঘটেছে। তাদের বিরোধ ও বিভক্তির নিরসন ঘটিয়ে আল্লাহ্র একত্ববাদের বাণী প্রচারের মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নবী-রাসুলগণের প্রধান কাজ। তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁদের যুগের আদর্শ এবং সে যুগের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবন-বিধান তাঁরা স্বজাতির মধ্যে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁদের এ মহৎ কাজে তাঁরা সর্বদাই সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বারা প্রতিরোধ ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। ব্যঙ্গ, কটুক্তি ও উপহাসের দ্বারা তাঁদেরকে বিব্রত করার অপচেষ্টা তখনো বিরাজমান ছিল। কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁরা কখনোই হতোদ্যম হননি। অবশেষে মিথ্যা পরাভব মেনেছে এবং সত্য জয়ী হয়েছে। আল্লাহ তাঁর নবী-রাসুলগণের বিরুদ্ধে উপহাসকারী ও ষড়যন্ত্রকারী আ’দ ও সামুদের মতো বহু সম্প্রদায়কে এবং নমরুদ ও ফেরাউনের মতো বহু শাসককে কিভাবে ধ্বংস করে দিয়েছেন পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় তার বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এসব বিদ্রুপকারীরাই সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং নবী-রাসুলগণের প্রচারিত সত্য আজো পৃথিবীকে আলোকিত করছে।
আল্লাহর বাণী প্রচারে মক্কার কাফেররা শুধু বিরোধিতাই করতোনা, নবী করিম (সাঃ) কে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ দ্বারা মানসিকভাবে নিগৃহীত করতো, চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, পাথর ছুড়ে মারতো এবং তিনি যখন কাবা শরীফে নামাযে সিজদারত থাকতেন তখন তাঁর ওপর মৃত পশুর নাড়ি-ভুঁড়ি ফেলে দিতো। তাঁর অনুসারীবৃন্দের সাথেও চলতো একই ধরণের নির্যাতন। রহমতের নবী অসীম ধৈর্যের সাথে এতসব সহ্য করে তাঁর প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর নবী মোহাম্মদ (সাঃ) কে বলেন, “জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে তোমার প্রভুর দিকে আহ্বান করো এবং তাদের সামনে যুক্তি উত্থাপন করো সর্বোত্তম পন্থায়” (১৬:১২৫)। নবীজী (সাঃ) অত্যন্ত মার্জিত, যুক্তিপূর্ণ ও সাবলীল ভাষায় মানুষজনকে ধর্মোপদেশ দিতেন। অবিশ্বাসীরা যখন তাঁকে প্রত্যাখ্যান করত ও তাঁকে ও তাঁর সাথীগণের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত তখন তিনি তাদের অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণে খুবই ব্যথিত ও ব্যকুল হতেন। এমতাবস্থায় নবী (সাঃ) কে সাত্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ্ বলেন, “তোমার পূর্বে (বহু) রসুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছিল। তারা যা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছিল, (পরিণামে) তা-ই বিদ্রুপকারীদেরকে পরিবেষ্টন করেছিল” (১৫:১০)।
কাফেরদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ফলে মক্কার কিছু সংখ্যক মুসলমান আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন। এসময় কাফেররা মুসলমান ও হাশেম গোত্রের লোকজনকে একঘরে করে ফেললে আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গী-সাথীসহ হযরতকে মক্কার অদূরবর্তী শেবা উপত্যকায় দীর্ঘ দুই বছরকাল দুঃসহ নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। এরপর তিনি তাঁর পালিত পুত্র যায়েদ (রাঃ) কে সাথে নিয়ে তায়েফে আল্লাহর বাণী প্রচার করতে গেলেন। কিন্তু তায়েফের সর্দারগণ আল্লাহর নবীর ডাকে সাড়া তো দিলোই না, বরং তাঁকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইলো। নবীজী তখন তায়েফের সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিতে লাগলেন। সর্দারগণ তাঁকে পাগল আখ্যা দিয়ে সাধারণ লোকজনকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলো। ফলে বিরুদ্ধবাদী লোকদের পাথর নিক্ষেপে নবীজীর শরীর মোবারক থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো। এ অবস্থায় যায়েদ (রাঃ) নিজের শরীর দিয়ে নবীজীকে আড়াল করতে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হলেন। এতবড় বিপদেও আল্লাহর নবী (সাঃ) ধৈর্যহারা হলেন না, বরং তিনি এসব লোকদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে কোন ফরিয়াদ না জানিয়ে এদের হেদায়েতের জন্য প্রার্থনা করলেন। আর এ প্রসঙ্গে ওহী নাযিল হলো, “(হে নবী) ধৈর্য ধারণ করুন সুন্দরভাবে, তারা (কাফেরগণ) দেখছে এটা (তাদের শাস্তি) সুদূরপরাহত, কিন্তু আমরা দেখছি তা অতি নিকটবর্তী” (৭০:৬-৭)। আল্লাহ্ তাঁর নবীকে আশ্বস্ত করে বলেন, “তোমার জন্য বিদ্রুপকারীদের মোকাবেলায় আমিই যথেষ্ট” (১৫:৯৫)। “তোমার পূর্বেও রাসুলগণকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তাঁরা তাঁদের প্রতি অস্বীকৃতি ও অন্যায়কে সহ্য করেছেন, যতক্ষণ না আমার সাহায্য তাঁদের নিকট পৌঁছেছিল” (৬:৩৪)।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সান্ত¦না ও আশ্বাস পেয়ে নবীজী (সাঃ) সত্যের বাণী প্রচারে এগিয়ে যেতে থাকেন। যেসব মদীনাবাসী হজ্ব মওসুমে মক্কায় আসতেন তিনি তাদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছুতে লাগলেন। মদীনাবাসীগণ তাঁর এ দাওয়াত কবুল করে তাঁকে মদীনায় গিয়ে ইসলাম প্রচারের আহ্বান জানালেন। তাদের এ আমন্ত্রণ হযরতের মনে এক আশার আলো সঞ্চার করলো, তবে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে ফেলে একা যেতে চাইলেন না। মদীনাবাসীগণ মক্কার সব মুসলিমকে সাদরে গ্রহণ করতে নবীজীর নিকট আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। এদিকে কাফেরগণ হযরতকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। প্রতিটি গোত্র থেকে একজন করে সবাই একযোগে তাঁর ওপর আক্রমণ চালাবে - এ সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত হলো তখনই মদীনায় হিযরতের ব্যপারে আল্লাহর নির্দেশ এলো। সত্য ধর্ম প্রচারের খাতিরে নবীজী (সাঃ) তাঁর প্রিয় জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হলেন। কিন্তু কাফেররা মুসলমানদেরকে মদীনাতেও শান্তিতে থাকতে দিল না, সেখানেও তারা বার বার আক্রমণ চালালো - বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধ এরই প্রমাণ।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। অত্যাচার, নির্যাতন, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা দ্বারা কখনো শান্তি অর্জিত হয় না। শান্তি অর্জনের পথ হলো - মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট আত্ম-সমর্পিত হয়ে যে কোন ধরণের প্ররোচনায় সংযম ও ধৈর্য ধারণ করা, দৃঢ়তার সাথে অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং ক্ষমা ও মহত্বের দ্বারা শত্রুর মনকে জয় করা। যদি অন্যায়কারীকে শাস্তি প্রদান একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে তা হলে এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ, “যদি তোমরা তাদের শাস্তি দাও, তবে ঠিক ততটুকুই শাস্তি দেবে যতটুকু অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর তবে সেটাই হচ্ছে ধৈর্যশীলদের জন্য সর্বোত্তম পন্থা” (১৬:১২৬)। শত্রুর মোকাবেলায় ন্যায়-নীতি অবলম্বন করতে এবং সীমা লঙ্ঘন না করতে আল্লাহ্ তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যত্র আল্লাহ্ তাঁকে উপদেশ দিয়েছেন, “(হে নবী) ভালো আর মন্দ কখনোই সমান হতে পারে না, আপনি ভালো’র দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করুন, তাহলেই আপনার মধ্যে এবং যার সাথে আপনার শত্রুতা - তার মধ্যে এমন (অবস্থার সৃষ্টি) হয়ে যাবে যেন সে আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু। আর এ (অবস্থা) শুধু তাদেরই (ভাগ্যে লেখা) থাকে যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং এসব লোক তারাই হয় যারা সৌভাগ্যের অধিকারী” (৪১:৩৪-৩৫)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ আরো বলেন, “মন্দকে প্রতিহত করুন সর্বোত্তম পন্থায়। (আপনার সম্পর্কে) তারা যেসব কথা বলে সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত” (২৩:৯৬)।
এভাবে পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবী (সাঃ) কে বিরুদ্ধবাদীদের কঠোর সমালোচনা ও তাদের বিরূপ আচরণের জবাবে সাত্ত্বনা দিয়েছেন, শত্রুর প্ররোচনায় মনঃক্ষুণ্ন বা দুঃখিত না হতে উপদেশ দিয়েছেন এবং নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অবিচল থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ্ বলেন, “এবং আপিন ধৈর্যশীল হোন। কারণ আপনার ধৈর্য তো আল্লাহর প্রেরিত (সাহায্য)। তাদের জন্য দুঃখিত হবেন না, এবং তাদের ষড়যন্ত্রে নিজেকে বিপর্যস্ত করবেন না” (১৬:১২৭)। নবী করিম (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সংযম, ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে স্বীয় আদর্শ ও কর্মে অবিচল ছিলেন। তাঁর সুদৃঢ় চরিত্র, সুন্দর আচরণ, ক্ষমা ও মহত্ত শত্রুর মনকে জয় করেছে। তিনি বিজয় ও সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাকে পরিহার করে মানবতা ও মহানুভবতার আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মক্কা বিজয়ের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ তা-ই প্রমাণ করে। সত্যকে কখনোই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও নির্যাতন দ্বারা প্রতিহত করা যায় না - কারণ সত্যের জয় অবধারিত। বরং কালের পরিক্রমায় সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ওইসব বিদ্রুপকারীকেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। আর নবী-রাসুলগণ সকল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ঊর্দ্ধে ওঠে স্বমহিমায় পূণ্যবান মানুষের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন