‘আমাকে হত্যা, সাঈদীকে ফাঁসি দেয়া হবে’......

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তমঞ্চ ১৬ মে, ২০১৩, ০৫:৫৪:৫৫ বিকাল

গত কাল এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পর্যবেক্ষণ দলের প্রতিনিধি আমেরিকার যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র‌্যাপের বলেন তারা এই বিচারের উপর সস্তুতি নই এবং আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বহুল আলোচিত সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি’র সন্ধান মিলেছে। বর্তমানে ভারতের একটি জেলে রয়েছেন তিনি। এ খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটির কাছে বালি বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলে আদালতের গেট থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। এরপর তাকে সীমান্ত দিয়ে জোর করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি ভারতে প্রবেশ করার পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী (বিএসএফ) তাকে আটক করে। তাদের হাতে নির্যাতিত হন তিনি। বর্তমানে কলকাতার দমদম জেলে বন্দি আছেন তিনি।



সুখরঞ্জন বালী। বাংলাদেশের চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার ঘিরে তার নাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়েছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় বালী বেঁচে আছেন। বন্দি জীবন যাপন করছেন কলকাতার একটি কারাগারে।

বুধবার রাত ১২টার দিকে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ-এর অনলাইনে প্রকাশিত পত্রিকাটির বিশেষ প্রতিবেদন সম্পাদক ডেভিড বার্গম্যানের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। গত ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে বলে আসামিপক্ষ দাবি করে আসছে। কলকাতার একটি কারাগারে তার খোঁজ পাওয়া গেছে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা পিরোজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সুখরঞ্জন বালী, তাকে গত বছরের ৫ নভেম্বর সকালে ট্রাইব্যুনালের ফটক থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় বলে নিশ্চিত করেছেন। ওইদিন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন তিনি।

কারাগারে আটক অবস্থায় দেয়া এক বিবৃতিতে বালী বলেন, তাকে আদালত চত্বর থেকে একটি পুলিশের গাড়িতে ‘অপহরণ’ করে পরে একটি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই অফিসের ডেস্কে একটি পেপার স্টাম্পে কিছু শব্দ দেখে তিনি পরে ওই অফিসটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অফিস বুঝতে পারেন।

সুখরঞ্জন বালী কলকাতার দুম দুম সংশোধন কেন্দ্রে আটক রয়েছেন বলে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য পায় নিউ এইজ এবং তাকে দেখতে পরিবারের সদস্যরা সেখানে যায়। এরপর এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে এবং কিভাবে তিনি সেখানে গেলেন তা নিশ্চিত করতে কাজ করে আসছিল পত্রিকাটি।

পত্রিকাটি তার সঙ্গে দেখা করতে এবং একটি বিবৃতি নিতে ওই কারাগারে প্রবেশে সক্ষম একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তার কারণে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছার কথা জানায় ওই ব্যক্তি। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের কোনো পক্ষের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা/সংশ্লিষ্টতা নেই।

বিবৃতি নেয়া ওই ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন, যে ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছেন, বালীর আসল ছবির সঙ্গে তার সম্পূর্ণ মিল রয়েছে।

বিবৃতি নেয়া ওই ব্যক্তি বলেন, ‘বালী পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা দেন। আমি মনে করি, ঘটনাটি সত্য না হলে এ রকম মুহূর্তে তার কাছ থেকে এমন বিবরণ আসা খুবই কঠিন।’ অবশ্য বালীকে তখন নার্ভাস দেখাচ্ছিলো বলেও ওই ব্যক্তি নিউ এইজ-কে জানান।

ওই অফিসের লোকজন পুলিশের পোশাক পরিহিত ছিল এবং আমাকে যখন তারা অপহরণ করেছিল তখন তারা সাদা পোশাকে ছিল।

অফিসে তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি বলে তিনি জানান। তবে ‘কেন আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে এজন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল... তারা বলেছে- আমাকে হত্যা করা হবে এবং সাঈদী সাহেবকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।’

বিবৃতি অনুযায়ী, গত ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের আগে ঢাকায় তাকে ছয় সপ্তাহ ধরে অবৈধভাবে আটক করে রাখা হয়। প্রথম তিন মাস তাকে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক রাখা হয়।

নিউ এইজ নিরপেক্ষভাবে বালীর এসব দাবি নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ, এর আগে তার পরিবারের এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামিপক্ষের দেয়া বক্তব্যে গরমিল রয়েছে। সময়সীমার ব্যাপারে বালীর দেয়া বক্তব্যের সত্যতা ভারতে আটক থাকার বিষয়ে আদালতে দেয়া বিভিন্ন কাগজপত্র প্রমাণ করে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির ফরেইনার অ্যাক্ট-১৯৪৬ এর অধীনে কলকাতার একটি আদালত বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়। যেহেতু বিচার চলাকালে এই সময়টা তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে (বালীর বিষয়ে) কোনো তথ্য নেই। আমি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের (পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা বলেছি এবং তিনি বলেছেন- তিনি কিছুই জানেন না। এই মুহূর্তে বালী কোথায় আছে তিনি তা জানেন না।’

গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন, এরমধ্যে একটি হলো- সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশাবালীকে হত্যায় জড়িত থাকা।

আদালত রায়ে উল্লেখ করে, বিশাবালীকে একটি নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং ‘অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উস্কানিতে রাজাকার বাহিনীর গুলিতে তিনি নিহত হন’। আদালত অন্য ছয়টি অপরাধের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা ঘোষণা করেনি। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে বালীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো অপহরণ করেছে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের ৫ নভেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ঘটনাটি তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জানালে চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, ‘আদালত চত্বরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের জানা মতে এমন কিছু হয়নি বলে জানিয়েছেন।’ তদন্ত সংস্থার প্রধানও চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন।

এরই ধারাবাহিকতায়, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই অপহরণের অভিযোগ নেতাদের বেআইনিভাবে মুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টার তাদের (জামায়াতে ইসলামীর) অগ্রহণযোগ্য নাটকের অংশ।’

অপহরণের ঘটনার এক সপ্তাহ পর হেবিয়াস কার্পাসের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম হাই কোর্টকে বলেন, ‘এই গল্প একেবারেই ভিত্তিহীন... এই আবেদন একবারেই বিভ্রান্তিকর।’

বালীর বিবৃতিতে বলা হয়, ছয় সপ্তাহ তাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো আটকে রাখার পর ২৩ ডিসেম্বর তার চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং বাংলাদেশ পুলিশ তাকে সীমান্তে নিয়ে যায় এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে তাকে তুলে দেয়া হয়।

নিজের সই করা বিবৃতিতে বালী বলেন, ‘তারা আমাকে খাবার দেয়ার জন্য মাগুরার একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামায়। তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং আমি বুঝতে পারি আমাকে প্রাইভেটকারে এখানে আনা হয়েছে।’

‘আমার খাবার গ্রহণ শেষ হলে ফের আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং আমাদের গাড়ি ফের চলতে শুরু করে। সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে বিএসএফের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে তারা চলে যায়’ যোগ করেন তিনি।

বালী বলেন, বিএসএফ সদস্যরা তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। ‘তারা আমাকে নির্যাতন করে এবং জানতে চায় আমি সেখানে কী করতে ছিলাম। বিএসএফের হাতে তুলে দেয়ার আগ পর্যন্ত আমি কী করেছি তা তুলে ধরার চেষ্টা করি। সম্ভবত তারা আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব পায়নি এবং আমাকে আরো বেধড়ক মারধর করা হয়।’

এতে আহত হলে বিএসএফ তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে স্বরূপনগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখান থেকে পরদিন তাকে বসিরহাট আদালতে তোলা হয়। বসিরহাট কারাগারে ২০ দিন আটক থাকার পর তাকে দুম দুম সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয় বলে জানান বালী।

বিবৃতিতে বালী বলেন, ২০১২ সালের মে মাসের কিছুদিন পর সাঈদীর ছেলে ‘বুলবুল’ তার বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে এসে প্রথমবারের সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে বলেন।

যেহেতু তিনি উপস্থিত ছিলেন না, তারা ফোনে কথা বলেন। ‘বুলবুল তার বাবার জন্য সাক্ষী হতে আমাকে অনুরোধ করে। কিছুদিন পর বুলবুল মারা যান’, বিবৃতিতে ২০১২ সালের ১৩ জুন রফিক-বিন-সাঈদী, সাঈদীর বড় ছেলে মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়।

এই ছেলে হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর সাঈদীর আরেক ছেলের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখেন বলে জানান বালী এবং দুর্গাপূজার আগে (অক্টোবর ২০-২৪) তিনি ঢাকা আসেন, সাঈদীর বাসায় ১৫ থেকে ১৬ দিন অবস্থান করেন।

তিনি বলেন, ৫ নভেম্বর তাকে সাঈদীর আইনজীবীদের অফিস পল্টনের একটি ভবনের ১০ম তলায় নেয়া হয় এবং সেখান থেকে ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়।

এর আগে সাঈদীর আইনজীবীরা এবং বালীর স্ত্রী দাবি করেন, বালী নভেম্বরের শুরুতে প্রথমে ঢাকা আসেন। ঢাকায় অবস্থানকালে বালী সাঈদীর পরিবারের কোনো সদস্যের বাড়িতে অবস্থান করেননি বলেও দাবি করেন তারা আইনজীবীরা।

ভারতীয় পুলিশের ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দাখিল করা প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা কুলদীপ সিং ভারতীয় সীমান্তবর্তী স্বরূপনগরে ‘সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ’ করেন এবং বালীকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি পালান। এফআইআর-এ বলা হয়, আটক করা হলে বালী তাদের জানায়, ‘তিনি বাংলাদেশ থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’

কলকাতায় ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) শরিফ উদ্দিন নিউ এইজ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন সংশোধন কেন্দ্রে আটক বাংলাদেশিদের দেখতে এপ্রিলের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দল কলকাতায় আসেন।’

‘আমরা দুম দুম সংশোধন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বালী সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা আমি বলতে পারবো না’ যোগ করেন তিনি।

ওই প্রতিনিধি দলের একজন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির লে. কর্নেল তৌহিদ নিউ এইজ-কে বলেন, ‘বালীর সঙ্গে তারা দেখা করেছেন কিনা তা তিনি বলতে পারবেন না।’

তিনি বলেন, ‘যেহেতু কারাগারে প্রায় ১৩০ জন ছিল, তাই আমি বিষয়টি স্মরণ করতে পারছি না। আপনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হবে।’

সুখরঞ্জন বালী। বাংলাদেশের চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার ঘিরে তার নাম দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়েছে। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় বালী বেঁচে আছেন। বন্দি জীবন যাপন করছেন কলকাতার একটি কারাগারে।

বুধবার রাত ১২টার দিকে ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ-এর অনলাইনে প্রকাশিত পত্রিকাটির বিশেষ প্রতিবেদন সম্পাদক ডেভিড বার্গম্যানের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। গত ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করে বলে আসামিপক্ষ দাবি করে আসছে। কলকাতার একটি কারাগারে তার খোঁজ পাওয়া গেছে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা পিরোজপুরের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক সুখরঞ্জন বালী, তাকে গত বছরের ৫ নভেম্বর সকালে ট্রাইব্যুনালের ফটক থেকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় বলে নিশ্চিত করেছেন। ওইদিন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন তিনি।

কারাগারে আটক অবস্থায় দেয়া এক বিবৃতিতে বালী বলেন, তাকে আদালত চত্বর থেকে একটি পুলিশের গাড়িতে ‘অপহরণ’ করে পরে একটি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই অফিসের ডেস্কে একটি পেপার স্টাম্পে কিছু শব্দ দেখে তিনি পরে ওই অফিসটি পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অফিস বুঝতে পারেন।

সুখরঞ্জন বালী কলকাতার দুম দুম সংশোধন কেন্দ্রে আটক রয়েছেন বলে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য পায় নিউ এইজ এবং তাকে দেখতে পরিবারের সদস্যরা সেখানে যায়। এরপর এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে এবং কিভাবে তিনি সেখানে গেলেন তা নিশ্চিত করতে কাজ করে আসছিল পত্রিকাটি।

পত্রিকাটি তার সঙ্গে দেখা করতে এবং একটি বিবৃতি নিতে ওই কারাগারে প্রবেশে সক্ষম একজন ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিরাপত্তার কারণে তার নাম প্রকাশে অনিচ্ছার কথা জানায় ওই ব্যক্তি। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালের কোনো পক্ষের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা/সংশ্লিষ্টতা নেই।

বিবৃতি নেয়া ওই ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন, যে ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছেন, বালীর আসল ছবির সঙ্গে তার সম্পূর্ণ মিল রয়েছে।

বিবৃতি নেয়া ওই ব্যক্তি বলেন, ‘বালী পুরো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা দেন। আমি মনে করি, ঘটনাটি সত্য না হলে এ রকম মুহূর্তে তার কাছ থেকে এমন বিবরণ আসা খুবই কঠিন।’ অবশ্য বালীকে তখন নার্ভাস দেখাচ্ছিলো বলেও ওই ব্যক্তি নিউ এইজ-কে জানান।

ওই অফিসের লোকজন পুলিশের পোশাক পরিহিত ছিল এবং আমাকে যখন তারা অপহরণ করেছিল তখন তারা সাদা পোশাকে ছিল।

অফিসে তাকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি বলে তিনি জানান। তবে ‘কেন আমি সাঈদী সাহেবের পক্ষে এজন্য প্রশ্ন করা হয়েছিল... তারা বলেছে- আমাকে হত্যা করা হবে এবং সাঈদী সাহেবকে ফাঁসিতে ঝুলানো হবে।’

বিবৃতি অনুযায়ী, গত ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে হস্তান্তরের আগে ঢাকায় তাকে ছয় সপ্তাহ ধরে অবৈধভাবে আটক করে রাখা হয়। প্রথম তিন মাস তাকে ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক রাখা হয়।

নিউ এইজ নিরপেক্ষভাবে বালীর এসব দাবি নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ, এর আগে তার পরিবারের এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আসামিপক্ষের দেয়া বক্তব্যে গরমিল রয়েছে। সময়সীমার ব্যাপারে বালীর দেয়া বক্তব্যের সত্যতা ভারতে আটক থাকার বিষয়ে আদালতে দেয়া বিভিন্ন কাগজপত্র প্রমাণ করে।

গত ৩ এপ্রিল ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির ফরেইনার অ্যাক্ট-১৯৪৬ এর অধীনে কলকাতার একটি আদালত বালীকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়। যেহেতু বিচার চলাকালে এই সময়টা তিনি কারাভোগ করেছেন, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে যেকোনো দিন বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হতে পারে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এবং পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে (বালীর বিষয়ে) কোনো তথ্য নেই। আমি যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের (পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা বলেছি এবং তিনি বলেছেন- তিনি কিছুই জানেন না। এই মুহূর্তে বালী কোথায় আছে তিনি তা জানেন না।’

গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দুটি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আল্লামা সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন, এরমধ্যে একটি হলো- সুখরঞ্জন বালীর ভাই বিশাবালীকে হত্যায় জড়িত থাকা।

আদালত রায়ে উল্লেখ করে, বিশাবালীকে একটি নারিকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং ‘অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উস্কানিতে রাজাকার বাহিনীর গুলিতে তিনি নিহত হন’। আদালত অন্য ছয়টি অপরাধের জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও কোনো সাজা ঘোষণা করেনি। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল চত্বর থেকে বালীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো অপহরণ করেছে এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে সরকার এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ।

গত বছরের ৫ নভেম্বর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ঘটনাটি তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জানালে চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, ‘আদালত চত্বরে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের জানা মতে এমন কিছু হয়নি বলে জানিয়েছেন।’ তদন্ত সংস্থার প্রধানও চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেন।

এরই ধারাবাহিকতায়, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই অপহরণের অভিযোগ নেতাদের বেআইনিভাবে মুক্ত করতে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টার তাদের (জামায়াতে ইসলামীর) অগ্রহণযোগ্য নাটকের অংশ।’

অপহরণের ঘটনার এক সপ্তাহ পর হেবিয়াস কার্পাসের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম হাই কোর্টকে বলেন, ‘এই গল্প একেবারেই ভিত্তিহীন... এই আবেদন একবারেই বিভ্রান্তিকর।’

বালীর বিবৃতিতে বলা হয়, ছয় সপ্তাহ তাকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো আটকে রাখার পর ২৩ ডিসেম্বর তার চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং বাংলাদেশ পুলিশ তাকে সীমান্তে নিয়ে যায় এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে তাকে তুলে দেয়া হয়।

নিজের সই করা বিবৃতিতে বালী বলেন, ‘তারা আমাকে খাবার দেয়ার জন্য মাগুরার একটি হোটেলের সামনে গাড়ি থামায়। তারা আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয় এবং আমি বুঝতে পারি আমাকে প্রাইভেটকারে এখানে আনা হয়েছে।’

‘আমার খাবার গ্রহণ শেষ হলে ফের আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয় এবং আমাদের গাড়ি ফের চলতে শুরু করে। সর্বশেষ বিকেল ৫টার দিকে বিএসএফের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে তারা চলে যায়’ যোগ করেন তিনি।

বালী বলেন, বিএসএফ সদস্যরা তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। ‘তারা আমাকে নির্যাতন করে এবং জানতে চায় আমি সেখানে কী করতে ছিলাম। বিএসএফের হাতে তুলে দেয়ার আগ পর্যন্ত আমি কী করেছি তা তুলে ধরার চেষ্টা করি। সম্ভবত তারা আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব পায়নি এবং আমাকে আরো বেধড়ক মারধর করা হয়।’

এতে আহত হলে বিএসএফ তাকে একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে স্বরূপনগর থানায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখান থেকে পরদিন তাকে বসিরহাট আদালতে তোলা হয়। বসিরহাট কারাগারে ২০ দিন আটক থাকার পর তাকে দুম দুম সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয় বলে জানান বালী।

বিবৃতিতে বালী বলেন, ২০১২ সালের মে মাসের কিছুদিন পর সাঈদীর ছেলে ‘বুলবুল’ তার বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে এসে প্রথমবারের সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে বলেন।

যেহেতু তিনি উপস্থিত ছিলেন না, তারা ফোনে কথা বলেন। ‘বুলবুল তার বাবার জন্য সাক্ষী হতে আমাকে অনুরোধ করে। কিছুদিন পর বুলবুল মারা যান’, বিবৃতিতে ২০১২ সালের ১৩ জুন রফিক-বিন-সাঈদী, সাঈদীর বড় ছেলে মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়।

এই ছেলে হৃদরোগে মারা যাওয়ার পর সাঈদীর আরেক ছেলের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখেন বলে জানান বালী এবং দুর্গাপূজার আগে (অক্টোবর ২০-২৪) তিনি ঢাকা আসেন, সাঈদীর বাসায় ১৫ থেকে ১৬ দিন অবস্থান করেন।

তিনি বলেন, ৫ নভেম্বর তাকে সাঈদীর আইনজীবীদের অফিস পল্টনের একটি ভবনের ১০ম তলায় নেয়া হয় এবং সেখান থেকে ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়।

এর আগে সাঈদীর আইনজীবীরা এবং বালীর স্ত্রী দাবি করেন, বালী নভেম্বরের শুরুতে প্রথমে ঢাকা আসেন। ঢাকায় অবস্থানকালে বালী সাঈদীর পরিবারের কোনো সদস্যের বাড়িতে অবস্থান করেননি বলেও দাবি করেন তারা আইনজীবীরা।

ভারতীয় পুলিশের ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দাখিল করা প্রথম প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ কর্মকর্তা কুলদীপ সিং ভারতীয় সীমান্তবর্তী স্বরূপনগরে ‘সন্দেহজনক গতিবিধি পর্যবেক্ষণ’ করেন এবং বালীকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি পালান। এফআইআর-এ বলা হয়, আটক করা হলে বালী তাদের জানায়, ‘তিনি বাংলাদেশ থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’

কলকাতায় ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) শরিফ উদ্দিন নিউ এইজ-কে বলেন, ‘বিভিন্ন সংশোধন কেন্দ্রে আটক বাংলাদেশিদের দেখতে এপ্রিলের শেষের দিকে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দল কলকাতায় আসেন।’

‘আমরা দুম দুম সংশোধন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলটি বালী সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা আমি বলতে পারবো না’ যোগ করেন তিনি।

ওই প্রতিনিধি দলের একজন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির লে. কর্নেল তৌহিদ নিউ এইজ-কে বলেন, ‘বালীর সঙ্গে তারা দেখা করেছেন কিনা তা তিনি বলতে পারবেন না।’

তিনি বলেন, ‘যেহেতু কারাগারে প্রায় ১৩০ জন ছিল, তাই আমি বিষয়টি স্মরণ করতে পারছি না। আপনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হবে।’

বিষয়: রাজনীতি

১৬১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File