“কোন অভিযোগে কামারুজ্জামানকে শাস্তি দেয়ার মতো উপাদান নেই -১”

লিখেছেন লিখেছেন মুক্তমঞ্চ ০৯ মে, ২০১৩, ০১:০৪:০১ রাত

কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রধান দু’টি অভিযোগ ও তার যথাযথ যুক্তিসমূহ

ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বরসহ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা কামারুজ্জামান। শেরপুর ডাকবাংলোয় বসে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সন্দেহভাজনসহ নিরীহ বাঙালিদের ধরে আনার নির্দেশ দিতেন এবং হত্যা, নির্যাতন চালাতেন তিনি।

এছাড়া শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে তার পরিকল্পনা ও পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই ১২০ জন পুরুষকে হত্যা করা হয় এবং ওই গ্রামের প্রায় ১৭০ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হয়। সে ঘটনার পর থেকে সোহাগপুর গ্রাম এখন ‘বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিত। এ কারণে সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর জন্যও দায়ী কামারুজ্জামান।

সব মিলিয়ে গণহত্যা, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যা, ব্যাপক নির্যাতনযজ্ঞ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে ক্রমাগত নির্যাতনের সুপিরিয়র হিসেবে সব অপরাধের একক ও যৌথ দায় কামারুজ্জামানের ওপর বর্তায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অভিযোগে।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৯ জুন সকালে কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার রামনগর গ্রামের আহম্মেদ মেম্বারের বাড়ি থেকে বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহম্মেদনগরে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে সারা রাত নির্যাতন করে পরদিন হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

প্রথম অভিযোগে জরার, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের গঠন করা ১ নম্বর চার্জে বদিউজ্জামান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুইজন সাক্ষীর সাক্ষ্যে দু’রকম ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হয়েছে। বদিউজ্জামান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেয়া দু’জন সাক্ষীই শোনা সাক্ষী। রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী ফকির আবদুল মান্নান ও ষষ্ঠ সাক্ষী ডা: হাসানুজ্জামান ’৭১ সালে বদিউজ্জামানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষী ফকির আবদুল মান্নান ঘটনার সময় ভারতে ছিলেন এবং বদিউজ্জামানের হত্যার ঘটনা শুনেছেন এমন একজনের কাছ থেকে তিনি এটা শোনেন। আর সাক্ষী ডা: হাসানুজ্জামান ঘটনাস্থল নিজ শ্বশুরবাড়ি ’৭১ সালে কখনও যাননি। পরে তিনি আত্মীয়দের কাছে ভাই হত্যার ঘটনা শোনেন।

ট্রাইব্যুনালের ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে দেখিয়েছেন এই দু’জন সাক্ষীর সাক্ষ্য স্ববিরোধী এবং বিভ্রান্তিকর। এই সাক্ষ্য দেখে মনে হয়েছে তারা শেখানো সাক্ষ্য দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী এই ধরনের শোনা সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেয়া যায় না। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ট্রাইব্যুনালকে দেখান রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী ফকির আবদুল মান্নান বলেছেন, বদিউজ্জামান পাকিস্তান আর্মিতে চাকরি করতেন। ভারতে যেতে না পেরে আহমেদ আলী মেম্বারের বাড়িকে নিরাপদস্থল ভেবে বদিউজ্জামান সেখানে আশ্রয় নেন।

অপর দিকে রাষ্ট্রপক্ষের ষষ্ঠ সাক্ষী বদিউজ্জামানের ভাই ডা: হাসানুজ্জামান বলেছেন, আহমদনগর স্কুলের ক্যাম্পটি আমার শ্বশুরবাড়ির সন্নিকটে হওয়ায় আমার ভাই শহীদ বদিউজ্জামান সেই ক্যাম্পে রেকি করার জন্য ২৯ জুন, ১৯৭১ বিকালে আমার শ্বশুরবাড়িতে যায়। ৩০ জুনের পূর্বে আমার ভাই গোপনে একবার ভারতে গিয়েছিলেন বলে মা-বাবার কাছে শুনেছি। কোন মাসে বা কত তারিখে ভারতে গিয়েছিলেন বা কত দিন ছিলেন তা বলতে পারব না। এখানে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী বলছেন ’৭১ সালে বদিউজ্জামান ভারতে যাননি। অপর দিকে ষষ্ঠ সাক্ষী বলছেন তিনি ভারতে গিয়েছেন।

ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যুক্তি উপস্থাপনে দেখান যে বদিউজ্জামানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এই দু’জন সাক্ষী দুই প্রকারের তথ্য দিয়েছেন। বদিউজ্জামানকে ধরে নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী বলেন, তাকে একদিন রাতে বদর বাহিনীর কিছু লোক ও পাক বাহিনীর সদস্যরা ধরে আহমদনগর ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করে।

আর ষষ্ঠ সাক্ষী ডা: হাসানুজ্জামান বলেছেন, আনুমানিক রাত ১১টায় ১০-১১ জনের একটা সশস্ত্র দল আমার শ্বশুর সাহেবের ঘরের দরজার বাহিরে উঠানে দাঁড়িয়ে ‘ভাই, ভাই,’ বলে ডাকে এবং নিজেদেরকে মুক্তি বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দেয়। আমার চাচাশ্বশুর মকবুল হোসেন একটা বেঞ্চ এনে তাদের বসতে দেন এবং একটি পাতিলে করে মুড়ি এনে দেন। আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তারা পাক বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকেন। এই সময় আমার চাচাশ্বশুর মকবুল হোসেন বেঞ্চের ওপর তাদের রেখে যাওয়া গুলিভর্তি একটি ম্যাগজিন দেখতে পান এবং তিনি ওই ম্যাগজিনটি তাদেরকে ফেরত দেয়ার জন্য ওই লোকদের কাছে যান।

ডা: হাসানুজ্জামানের শ্বশুর আহমেদ আলী মেম্বার সম্পর্কে চতুর্থ সাক্ষী বলেন, আহমেদ আলী মেম্বার শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন, তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পরে মামলা হয় এবং তিনি জেল খাটেন। বদিউজ্জামানের তাওই সাহেব হাসানুজ্জামানের শ্বশুর আমার খালু হতেন, তার নাম আহমেদ আলী মেম্বার। তিনি মুসলিম লীগ করতেন এবং স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন।

এখানে সাক্ষী ডা: হাসানুজ্জামানের শ্বশুর সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী বলছেন তিনি শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন।

ডা: হাসানুজ্জামানও বলেছেন, স্বাধীনতার পর আমার শ্বশুর দালাল আইনে গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকতে পারেন। এরপরও সাক্ষী ডা: হাসানুজ্জামান দাবি করছেন তার শ্বশুরবাড়ি থেকে রাত ১১টায় ১০-১১ জনের একটা সশস্ত্র দল আমার শ্বশুর সাহেবের ঘরের দরজার বাইরে উঠানে দাঁড়িয়ে ‘ভাই, ভাই,’ বলে ডাকেন এবং নিজেদেরকে মুক্তি বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দেন। আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তারা হাঁটতে থাকেন এবং পাক বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে যেতে থাকেন।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক দাবি করেন, কামারুজ্জামানকে জড়িয়ে দু’জন সাক্ষীর এই সাক্ষ্য বিভ্রান্তিকর ও পরস্পরবিরোধী।

গত ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেয়া জবানবন্দীতে রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী ফকির আবদুল মান্নান বলেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ভারত থেকে দেশে এসে শেরপুর আওয়ামী লীগ অফিসে সৈয়দুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনেন যে বদিউজ্জামানকে আলবদররা হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ভারতে গিয়ে চেঙ্গাপাড়া ইয়থ ক্যাম্পে পলিটিক্যাল মবিলাইজার হিসেবে কাজ করি। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরি। যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ নেতারা যুদ্ধকালীন সময় যারা মারা গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের তালিকা করেন। আমার ওই তথ্য সংগ্রহে কোনো ভূমিকা ছিল না। সাধারণ জনগণ শেরপুর আওয়ামী লীগ অফিসে এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে তথ্য দিতো। আমি একদিন তথ্য দেয়ার সময় ওই অফিসে উপস্থিত ছিলাম। সে সময় আহমদনগরের সৈয়দুর রহমানকে বলতে শুনি তার ভাস্তিজামাইয়ের ভাইয়ের বাড়িতে এক ব্যক্তি আশ্রয় নেন। তার নাম বদিউজ্জামান। বদিউজ্জামান (বাঙালি) পাকিস্তান আর্মিতে চাকরি করতেন। বদিউজ্জামানকে একদিন রাতে বদর বাহিনীর কিছু লোক ও পাকিস্তান বাহিনীর সদস্য ধরে নিয়ে আহসদনগর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। তখন আওয়ামী লীগ অফিসের নেতারা ওই সৈয়দুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি ঘটনাটি দেখেছেন? তিনি বলেন, তিনি দেখেননি তার ভাই মকবুল হোসেন দেখেছেন এবং তিনি তার কাছ থেকে শুনেছেন। মকবুল হোসেন এখনো জীবিত আছেন।দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন।

প্রিন্সিপাল হান্নানকে নির্যাতনের এভিডেন্সেও নানা বিভ্রান্তি : ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন কালে ট্রাইব্যুনালকে দেখান মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গঠিত ২ নম্বর চার্জে প্রিন্সিপাল হান্নানকে মাথা ন্যাড়া করে নির্যাতনের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা যে সাক্ষ্য দিয়েছে তার মধ্যে নানা অসংলগ্নতা ও বিভ্রান্তি রয়েছে। যে কারণে ওই চার্জের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এভিডেন্স থেকে ট্রাইব্যুনালকে দেখান প্রিন্সিপাল হান্নানকে নির্যাতনের তারিখ নিয়ে সাক্ষীরা তিন ধরনের তথ্য দিয়েছেন। একজন সাক্ষী বলেছেন অক্টোবর মাসে তাকে মাথা মুড়িয়ে চুনকালি মেখে বাজারে ঘোরানো হয়। আর একজন সাক্ষী বলেছেন এপ্রিল বা মে মাসে তাকে নির্যাতন করা হয়। অন্য একজন বলেছেন জুলাই মাসে তার মাথা ন্যাড়া করা হয়। মাথা ন্যাড়া করার বিষয়েও সাক্ষীরা তিনটি স্থানের কথা বলেছেন একজন বলেছেন হাবিব উকিলের বাড়িতে প্রিন্সিপাল হান্নানের মাথ্যা ন্যাড়া করা হয়। একজন বলেছেন পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে ন্যাড়া করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য একজন সাক্ষী বলেছেন সুরেন সাহার বাড়িতে আলবদর ক্যাম্পে নিয়ে মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, এখানে অনেক অসংলগ্নতা রয়েছে। কন্ট্রাডিকশন আছে। এখানে ঘটনা ঘটার সময় এপ্রিল, মে, জুলাই ও নভেম্বরের কথা বলা হয়েছে। এখানে কোনটা ধরে নেয়া যাবে।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ৩ নম্বর সাী ৭১ সালে ভিুককে পাঁচ টাকা ভিক্ষা দেয়ার কথা বলেছেন; যা অস্বাভাবিক, ওই সময় এক সের চালের দাম ছিল ৫০ পয়সা।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক আরও বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দ্বিতীয় সাক্ষী জহুর মুন্সি একজন সাক্ষী সম্পর্কে বলেছেন তিনি প্রায়ই সুরেন সাহার বাড়িতে অবস্থিত ক্যাম্পে আসতেন। অথচ ওই সাক্ষী বলেছেন আমি সুরেন সাহার বাড়ির ক্যাম্পে একবারই এসেছি।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন সাক্ষীর এভিডেন্সের মধ্যে কন্ট্রাডিকশন থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, সাক্ষী মোহন মুন্সি বলেছেন, পাকিস্তান আর্মির মেজর রিয়াজ পায়ে গুলি লেগে আহত হন। আবার অন্য একজন সাক্ষী বলেছেন মাইন বিস্ফোরণে তিনি আহত হন। এ ছাড়া সাক্ষীরা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তার সাথে ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীর বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।

বিষয়: রাজনীতি

১৬৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File