"হেফাজতের ১৩ দফা; সরকারের অবস্থান ও পর্যালোচনা" পর্ব-১ (দফা নং-১)
লিখেছেন লিখেছেন বিদ্রোহী বাঙালী ০২ মে, ২০১৩, ১১:০১:২১ রাত
১। সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহ বিরোধী সকল আইন বাতিল করতে হবে।
এই দাবি প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ
দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের সময় সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভেই ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ সংরক্ষণ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২ক-এ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংরক্ষণ করায় সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংরক্ষিত আছে।
সরকার এখানে স্বীকার করে নিচ্ছে যে, সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংরক্ষিত আছে। হেফাজত ১ নং এ দাবিটি করছে তা সংবিধানে পরোক্ষভাবে রয়েই গেছে। কিন্তু সরকারের বক্তব্যের পরের অংশে বলা হয়েছেÑ
উক্ত প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ১২, ২৮(১) ও ৩৮-এ প্রদত্ত রক্ষাকবচের ফলে হেফাজতের ১ নম্বর দাবিটি সংবিধানের পরিপন্থী হওয়ায় তা পূরণের সাংবিধানিক আবশ্যকতা নেই।
এ অংশে সরকার বলছে হেফাজতের ১ নং দাবিটি সংবিধানের পরিপন্থী। পরিস্কার ভাষায় সরকার নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করে নি কিংবা করতে চায় নি। এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের ১ নং দফাটি একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাকÑ
হেফাজতের ১ নং দফাতে দাবি ছিল মূলত দুটোÑ
(ক) সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন।
(খ) কোরান-সুন্নাহ বিরোধী সকল আইন বাতিল করা।
সরকার মূলত (ক) এর ক্ষেত্রে দাবি করছে যে, এটি সংবিধানে এখনো সংরক্ষিত আছে। আর (খ) এর ক্ষেত্রে দাবি করছে যে, এ দাবিটি সংবিধান-পরিপন্থী।
এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলোÑ (ক) রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের আক্বীদা-বিশ্বাস ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। এটাই স্বভাবিক যুক্তির দাবি। সুতরাং সংবিধানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন’ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ন্যায়সঙ্গত দাবি। এ দাবিকে অগ্রাহ্য করা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের চেতনাকে অগ্রাহ্য ও অবমূল্যায়ন করারই নামান্তর। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নিজেদের ব্যক্তি-জীবনে যে চেতনাগুলোকে লালন করে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো যদি সেগুলোকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে এর অপরিহার্য-পরিণাম দাঁড়ায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝে দূরত্ব ও সংঘাত। উদাহরণ হিসেবে আমাদের ভাষা আন্দোলনের দাবীকে পেশ করতে পারি। যা ছিল এদেশের সংখ্যারিষ্ঠ নাগরিকের প্রাণের দাবী। যে দাবীকে অবদমিত করার সর্বাত্তক চেষ্টা করেছিল তৎকালিন পাকিস্থান সরকার। কিন্তু যেহেতু দাবীটি ছিল এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের, তাই তারা প্রাণ দিয়ে ছিল তবুও তারা এদাবী আদায়ে পিছপা হয়নি।থেকে পিছপাদেশকে এক সংঘাতময় পরিস্থিতিতির দিকে ঠেলে দিয়ে ছিল। আমরা মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের চেতনার কথা বলতে পারি। আমরা ব্যক্তি-জীবনে মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের চেতনাকে লালন করি এবং সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ রাষ্ট্রীয় কর্মকা-েও দেখতে চাই। মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক চেতনাকে কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রহণ করলেই হয় না; রাষ্ট্রিয় পর্যায়েও গ্রহণ করতে হয়। অনুরূপভাবে ইসলামী ধর্মবিশ্বাসীদের কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাসকে ব্যক্তিজীবন ও রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রেই ধারণ করতে হবে।
এটি ঠিক যে, ১৯৭১ এর মূল সংবিধানের আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এটি ছিল একটা বড় ভুল। পরবর্তীতে সংবিধানে ২য় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শিরোনামীয় অংশে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সরকারি ব্যাখ্যার একটা লক্ষণীয় দিক হলো, সরকার স্বীকার করে নিচ্ছে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধানে সংরক্ষতি রয়েছে। প্রশ্ন হলো তাহলে এটিকে তাহলে মূল পাঠ থেকে বাদ দেওয়া হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝে পাওয়া যাবে সরকার কিভাবে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা করে চলেছে। সংবিধানের ৫ম সংশোধনির মাধ্যমে এই অংশটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় সংবিধানের ২য় ভাগের প্রথমেই ৮(১) এ । সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগটির শিরোনাম হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। ৮ নং অনুচ্ছেদটির পাঠ ছিল নি¤œরূপ -
৮ [ (১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার-এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে৷
(১ক) সর্বশক্তিমান অল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি৷]
(২) এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না৷
৮ (২) এ বলা হয়েছে এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে। আরো বলা হয়েছে, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে। অর্থাৎ ৫ম সংশোধনির পর এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘আল্লাহর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’কে বাংলাদেশ পরিচালনার মূলসূত্রগুলোর একটি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সংবিধান ও অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কর্মকা-ের এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৫তম সংশোধনির মাধ্যমে ৮(১) এ বিদ্যমান ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ অংশটি বাদ দেওয়া হয়। এটিকে ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। ফলে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তিসমূহের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না। সংবিধান ও অন্যান্য আইন প্রণয়ন ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও এই অংশের ভূমিকা থাকছে না। মূলত রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের গুরুত্বহীন করে তোলার একটা ঘৃণ্য অপচেষ্টা হলো এই সংশোধনি।
এরপরও সরকার বলছে সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংরক্ষিত আছে। দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের সাথে এটি সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় প্রতারণা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সংবিধানে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় চেতনার কথাও উল্লেখ থাকা উচিত। আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ইসলাম ধর্মের মৌল চেতনা। রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতিতে এ চেতনার অন্তর্ভূতির দাবি করা হয়েছে এ যুক্তিতে যে এ রাষ্ট্রের শতকরা ৯০ শতাংশ নাগারিকই মুসলমান। তবে অন্য ধর্মের অনুসারীদের স্ব স্ব ধর্মীয় বিধি-বিধান মেনে চলার পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা সংবিধানে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে ২ক এবং ৪১ নং অনুচ্ছেদে সেই বিধান রয়েছে। আমরা এই বিধান নিয়ে কোন আপত্তি উত্থাপন করছি না। সুতরাং আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন সংবিধানে যোগ করার দাবি করা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় আকাংক্ষার প্রতিফলন হিসেবে। এটি দ্বারা অন্য ধর্মের স্বাধীনতা বা মর্যাদা খাট করা হচ্ছে না।
(খ) ১নং দফার (খ) প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রীর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-
উক্ত প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ১২, ২৮(১) ও ৩৮-এ প্রদত্ত রক্ষাকবচের ফলে হেফাজতের ১ নম্বর দাবিটি সংবিধানের পরিপন্থী হওয়ায় তা পূরণের সাংবিধানিক আবশ্যকতা নেই।
সরকারের এই ব্যাখ্যাটিও গ্রহণযোগ্য নয়। হেফাজতের দাবিতে কোথাও বলা হয় নি যে, কোরান-সুন্নাহ বিরোধী আইন বাতিল করার ক্ষেত্রে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। হেফাজত দেশের জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগের মুসলমানের পক্ষ থেকে এ দাবিটি জানিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম প্রত্যাশা করে সরকার প্রয়োজনবোধে সংবিধান সংশোধন করে এই দাবিকে বাস্তবায়িত করবে। কেননা, সংবিধান তো অপরিবর্তনীয় নয়।
পৃথিবীতে প্রায় ২০০টি দেশ রয়েছে। তাদের রয়েছে ২০০টি সংবিধান। এই ২০০টি দেশের কোন একটি দেশের সংবিধানও পরিবর্তন অযোগ্য নয়। বরং সকল দেশের সংবিধানই পরিবর্তনযোগ্য এবং প্রায়ই প্রতিটি দেশের সংবিধানের পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন হয়ে থাকে। সংবিধান পরিবর্তনশীল বলেই সংবিধান সংশোধনির ব্যবস্থা স্বয়ং সংবিধানেই উল্লেখ থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানেও দশমভাগে ১৪২ নং অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনির ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া বর্ণিত রয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এই ৪২ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান ১৫ বার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সংবিধান গৃহিত হওয়ার পর অল্প কয়েক বছরের মাথায়ই সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আওয়ামী সরকারের শাসনামলেই ৪ বার সংবিধান সংশোধন করা হয়। পরবর্তীতেও বিভিন্ন সরকারের আমলে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। কোন কোন সরকারের সময়ে একাধিকবারও সংশোধনি আনা হয়েছে। বর্তমান সরকারও পঞ্চদশ সংশোধনির মাধ্যমে সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করেছে। অনেক সময় ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার্থেও বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ধারাতেই পরিবর্তন আনা হয়েছে। সুতরাং বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল না অথবা সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনির পর বর্তমান সংবিধানেও নেই - এটা কোন যুক্তি হতে পারে না।
আরো দুঃখের বিষয় হলো ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অথবা আইন-কানুনের কথা বললেই এক শ্রেণির লোক বলে উঠে ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা বা আইন-কানুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে। বিশেষ করে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের সভ্যরা তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ‘গেলো গেলো’ বলে বক্তৃতা-বিবৃতি-সাক্ষাতকার দেন, টক শোতে কথা বলেন, সেমিনার করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা জানি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তানের শোষণ-ব্যঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্যে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা তৎকালিন পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশের) বিরুদ্ধে যে বৈষশ্য ও শোষণমূলক নীতি অবলম্বনর করেছিল মুক্তি যুদ্ধ ছিল সেই বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির সংগ্রাম। মানবাধিকার, ন্যায়-বিচার, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোন ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিল মুসলমান। তারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নি। তাই ইসলামী আইন-কানুন প্রণিত হলে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে হওয়ার প্রশ্নই অবান্তর।
এক শ্রেণির নাস্তিক্যবাদি ও ইসলাম-বিদ্বেষী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছিনতাই করে সেটি নিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছে। তারা মুক্তযুদ্ধ ও ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সমগ্র জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। তারাই নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি তা নির্ধারণ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা কে আর কে মুক্তিযোদ্ধা নয় সেটিও নির্ধারণ করেন তারাই। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার জন্যে ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে না। লেখা-লেখি, বক্তৃতা-বিবৃতি, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ইসলাম বিদ্বেষিতা প্রমাণ করতে পারলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক হওয়া যায়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেও ইসলামী আইন-কানুনের কথা বললেই স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্ণত করা হয়। তাদের নাস্তিক্যবাদি রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলেই তাকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের সব থেকে বড় চেতনা হলো এই মুক্তিযুদ্ধ চেতনার মুখোশধারী ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করা। মুক্তিযুদ্ধকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহারকারীদের প্রতিহত করা।
আমরা মনে করি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্যে সবচেয়ে উপযোগী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। কেননা, নির্যাতনকারীরা, শোষণকারীরা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অংগকে ব্যবহার করে নির্যাতন করে। শোষণ করে। মানুষের অধিকার হরণ করে। প্রচলিত মানব রচিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইন তৈরি, আইন প্রয়োগ ও শাসনকার্য পরিচালনা এবং আইনের আলোকের বিচার-কার্য সমাধান এ সব কিছুই থাকে শাসকের হাতে। ফলে শাসক এগুলোকে ব্যবহার করে জনগণকে শোষণ করে। পাকিস্তানও এমনটিই করেছে। পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল ইসলামকে বুকে ধারণ করার চেতনা নিয়ে। নিয়ে জন্মের পর মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান ইসলামকে বুকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মুখে ইসলামের কথা বলতো। কিন্তু তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেনি। তারা নির্যাতনকারী, শোষনকারী শাসকগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। ফলে প্রয়োজন হয় সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জনের। অনেক ত্যাগ ও কুরবানির বিনিময়ে আমরা কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হই। ফলে আমাদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা অনেক বেশি শাণিত। আমাদের আবেগ অনুভূতির একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। নাস্তিক্যবাদী ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী এই স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামকে এদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদি গোষ্ঠী রাষ্ট্রকে ইসলামের বিপক্ষে দাঁড় করায়। এই জন্যে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকৃত করে তার অপ-ব্যবহার শুরু করে। ফলাফল একটাই। নির্যাতন ও শোষন। ফলে মুক্তি সংগ্রাম বা স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য ব্যাহত হয়।
ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় আল্লাহর প্রদত্ত আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব হলো শাসকের। নিজেদের শাসন-শোষণকে পাকা-পোক্ত করার জন্যে নতুন নতুন আইন তৈরির সুযোগ শাসকের হাতে থাকে না। প্রতিপক্ষকে দমনের জন্যে শাসক নতুন নতুন আইন তৈরি করতে পারে না। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ বিরুদ্ধ আইন বাতিল করে কুরআন-সুন্নাহ সম্মত আইন প্রণয়ন করা হলেই বরং শোষন-নির্যাতন লোপ পাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে। সুতরাং ইসলামী-আইন, নীতি-আদর্শকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অথবা সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি উল্লেখ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশে বহু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। এই অজুহাতে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ হবে ধর্ম-নিরপেক্ষ। ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়, ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলো বহুধর্মীয় জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র। ধর্ম ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্র সকলের। ইসলাম ধর্ম মুসলমানদের, হিন্দু ধর্ম হিন্দুদের, বৌদ্ধ ধর্ম বৌদ্ধধর্ম অনুসারীদের ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু রাষ্ট্র মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান সকলের। প্রশ্ন হলো এই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বির চেতনাকে রাষ্ট্র কিভাবে ধারণ করবে? বলা হয়, রাষ্ট্র সকল ধর্মের উর্ধ্বে থাকবে। রাষ্ট্র সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে গিয়ে রাষ্ট্র ধর্মবিরোধী কৃত্রিম সংস্কৃতি সৃষ্টি করে। এই ভাবে রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষতার আড়ালে ধর্মভীরু মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে নিস্ক্রিয় ও অকার্যকর করে তোলে। এটিই রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা।
ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে থেকে রাষ্ট্্র ধর্মীয় চেতনাকে বা তার মহত্ব তুলে ধরতে পারে না। এটি খাঁটি ধর্মহীনতা ও ধর্মবিদ্বেষিতা। কার্যত এর অর্থ হলো রাষ্ট্র কর্তৃক সকল ধর্মকে অবজ্ঞা করা। ধর্ম-নিরপেক্ষতা কোন ধর্মকেই সম্মান দেয় না। বরং সকল ধর্মকেই বিকৃত করে। বাস্তবক্ষেত্রে ধর্মকে প্রয়োগ না করে কেবল মুখে মুখে ধর্মকে সম্মান জানানোর কথা বলা আসলে ধর্মের সাথে প্রতারণা করা। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে ধর্মকে দূরে রেখে ব্যক্তি জীবনে ধর্ম অনুশীলনের অর্থ হলো ধর্মের সাথে প্রতারণা করা।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রকে ইসলামের ভিত্তিতে গড়ে তোলার অর্থ এটা নয় যে, অন্য ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্ম চর্চা করতে পারবে না। বরং রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে তার নিজস্ব ধর্ম পালনে সহযোগিতা করবে। মুসলিম তার পূর্ণাঙ্গ জীবনকে ইসলাম অনুযায়ী, হিন্দু তার পূর্ণাঙ্গ জীবনকে হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী এবং খৃস্টান তার পূর্ণাঙ্গ জীবনকে খৃস্টান ধর্ম অনুযায়ী পরিচালনা করার স্বাধীনতা পাবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে তার নিজের ধর্ম অনুযায়ী চলার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সকল নাগরিকের রাষ্ট্রে পরিণত হবে। সুতরাং হেফাজতে ইসলামের ১নং দফাটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অথবা অন্য কোন প্রতিবন্ধকতা নেই।
বিষয়: বিবিধ
১২০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন