তাওহীদের কলিমায় ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমাজের সার্বিক আনুগত্য পর্ব ১
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৫:৫৪:২০ বিকাল
-এক-
(১.১) নবী মুহাম্মদ (সা.) এর কলিমায় প্রথম দিন থেকেই সার্বিক জীবনের ধারণা ছিল। এই কলিমা উচ্চারণের সাথে সাথে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ‘ক্বিবলা’ পরিবর্তিত হবে –এই কথাটি সেদিনের জ্ঞানী-গুণী ও সমাজপতিগণ বুঝতে পেরেছিল। এই স্বীকৃতিতে আছে যে আল্লাহই একমাত্র ‘ইলাহ’ যার রাসূল মুহাম্মদ এবং এই ইলাহের (আল্লাহর) আদেশ নিষেধই হবে আনুগত্যের স্থান, আইনের উৎস, নৈতিকতার উৎস। ন্যায়-অন্যায়, আইন, ইনসাফ, আয়-ব্যয় সবকিছুর নীতি-নৈতিকতার নির্ধারক হন এই ইলাহ এবং রাসূলের আদেশ-নির্দেশও হয়ে পড়ে এর আওতাভুক্ত। তারপর যাকে ‘উপাস্য’ (ইলাহ) হিসেবে গ্রহণ করা হবে, তাকে না মানার যৌক্তিকতা থাকে না, কারণও থাকে না। সব মিলিয়ে এই কলিমার গোটা অর্থ তারা বুঝতে পেরেছিল। এবং, এজন্যই বিরোধিতা করেছিল। মানুষ অমনি অমনি ঝগড়া/বিবাদে লিপ্ত হতে যায় না।
(১.২) ‘এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই’ –এই আহবান ছিল সকল নবী-রাসূলের -এবং তারা সবাই এজন্য নিগৃহীত, নির্যাতিত এবং প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলেন। এটা এজন্য যে এই কলিমা পাঠের সাথে সাথে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য সার্বিক হয়ে পড়ে। আনুগত্যকে ভাগ-বাটোয়ারা করার অবকাশ থাকে না –এমনটি করতে গেলেই বিশ্বাস ও আনুগত্যে অংশিদারিত্ব ঢুকে পড়ে, দ্বীন একমাত্র এক ইলাহের জন্য নিঙ্কলুষ থাকে না।
(১.৩) আনুগত্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে আল্লাহর ‘আমর’ বা তার নির্দেশ, -কোনো দর্শন বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়। আল্লাহর আনুগত্য ‘কীভাবে’ করা হবে এই জ্ঞানই হচ্ছে ‘ইলম’। কোন্ বৈজ্ঞানিক/যৌক্তিক ‘কারণে’ তার নির্দেশ এল, অথবা সত্তাগতভাবে তিনিইবা কেমন/কীরূপ, তার অস্তিত্বের প্রকৃতি কী এবং তার নির্দেশের দর্শন কী -এসবের বিচার বিশ্লেষণ নয়। এই আনুগত্যের ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হতেই আল্লাহ নির্দেশ দেন (২:২০৮)। নির্দেশ কেবল তাঁরই। এই সব ধারণার সারনির্যাস তাওহীদের কলিমায় নিহিত।
(১.৪) ইব্রাহীমের (আ.) কলিমাতেই ছিল তার গোটা জীবন প্রণালী তাই তিনি একা হলেও তাঁর মূলমন্ত্রের বিষয়বস্তু ছিল সামগ্রিক, ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহ ইব্রাহীম ছিলেন এক উম্মাহ (জাতি/সম্প্রদায়), আল্লাহ্র অনুগত, একনিষ্ঠ’ (১৬:১২০)। উলুল আযম পর্যায়ের রাসূলগণের মধ্যে নূহ (আ.) অন্যতম বা প্রধান এবং এই ধারায় আসেন ইব্রাহীম (আ.)। ইব্রাহীম (আ.) এঁর জীবন ও আনুগত্যের স্থানসমূহকে আল্লাহ ‘উসওয়ায়ে হাসানা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। আল্লাহর দিকে এই মহান নবীর প্রত্যাবর্তনের কথা এভাবে এসেছে, ‘وَإِنَّ مِن شِيعَتِهِ لَإِبْرَاهِيمَ ﴿٨٣﴾ إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ -আর নূহ পন্থীদেরই মধ্যে ইব্রাহীম ছিলেন একজন। স্মরণ করুন, তিনি তার প্রভুর দিকে নিষ্কলুষ-চিত্তে (বি-কালবিন সালীম) হাজির হয়েছিলেন’ (৩৭/৮৩-৮৪)। তিনি কঠিন পরীক্ষা দিয়েছিলেন – নিমরূদের মোকাবেলা, অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়া, স্ত্রী-পুত্র নির্বাসন, পুত্র কোরবানি ইত্যাদি। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করুন, ইব্রাহীমকে তাঁর প্রভু কিছু বিষয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি (ইব্রাহীম) সেগুলো পরিপূরণ করেন। অতঃপর তার প্রভু বলেন, আমি তোমাকে মানবজাতির ইমাম বানাব’ (২:১২৪)। এবং এই কথাও, ‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে এক চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল: আমরা তোমাদের থেকে মুক্ত হয়ে গিয়েছি এবং তোমরা, আল্লাহকে বাদ দিয়ে, যেসবের আনুগত্য কর (ইবাদত কর), সেসব থেকেও (আমরা মুক্ত)। আমরা তোমাদেরকে মানি না। আমরা ও তোমাদের মধ্যে এক শত্রুতা ও তীব্র বিরাগ শুরু হয়ে গিয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না কর’ (৬০/৪)।
-দুই-
(২.১) ইসলাম উবুদিয়াতের ধর্ম, দাসত্বের ধর্ম। ‘দাস’ যেভাবে মুনিবের আনুগত্য করে সেই আনুগত্যই এখানে প্রধান। এর নাম আত্মসমর্পণ, ইসলাম। ‘মুহাম্মদ আল্লাহর দাস ও রাসূল’। তাঁকে ‘বাদশাহ রাসূল’ অথবা ‘গোলাম রাসূল’ (عبدا رسولا) –এ দুটির একটি গ্রহণ করতে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল। তিনি গোলাম রাসূল হতে পছন্দ করেন। তাই তাঁর খাওয়া-পরা, উঠা-বসা, চাল-চলন দাসের মতই হয়েছে। এখানেই বনী-ইসরাইলের অনেক বাদশাহ রাসূলের প্রকৃতি থেকে মুহাম্মদের (সা.) উবুদিয়াতের ধর্মীয় আচরণের ভিন্নতা রয়েছে। এই ধর্ম ইয়াহুদী ও খৃষ্টিয়ান ধারা বাদ দিয়ে ইব্রাহীম (আ.) থেকেই পুনর্যাত্রা করেছে। এই তথ্যটি অনেকের সমঝে নেই –বিশেষ করে জায়োনিষ্ট-সৃষ্ট ইসলাম বিদ্বেষী জনগোষ্ঠীতে। ইব্রাহীমের (আ.) উদাহরণ আবার লক্ষ্য করুন। কোরানে এসেছে: “(স্মরণ করুন), যখন তাকে (ইব্রাহীমকে) তার প্রভু বললেন, “তুমি আত্মসমর্পণ কর (অনুগত হও)”, (তখন) তিনি বললেন, “আমি বিশ্ব-জাহানের মালিকের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম”’ (২:১৩১ ‘إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ ۖ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ )। ইব্রাহীম (আ.) আমাদের জাতির পিতা (২২:৭৮)। তিনি আনুগত্য ও খোদা-প্রেমে এতই নিষ্কলুষ ছিলেন যে যখন স্বপ্নে তাঁকে পুত্র কোরবানীর ইঙ্গিত (ওহী) দেয়া হয়েছিল তখনও তা বাস্তবে রূপ দিতে কুণ্ঠিত হননি। এজন্যই আল্লাহ তাঁকে মানব জাতির ইমাম বানিয়েছেন। আনুগত্যের বৈশিষ্ট্যেই তিনি আমাদেরকে ‘মুসলিম’ আখ্যায়িত করেছেন (২২:৭৮)। আর এই আনুগত্যের ধারা ও বৈশিষ্ট্য মুহাম্মাদের (সা.) মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে।
(২.২) তবে এটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে আজকে মুসলিম সমাজে আনুগত্যের ব্যবস্থা নানান বিভাজনে বিভক্ত। সমাজ ও সামাজিক নৈতিকতা, শিক্ষা ও শিক্ষা-ব্যবস্থা, সামাজিক আচরণ ও আইনি আশয়-বিষয়ে আল্লাহর যেসব ‘আদেশ-নির্দেশ’ রয়েছে সেইসব বিষয়ে নির্বিকার হয়ে কিছু কিছু লোক একটি ‘সুন্দর’ ব্যক্তিক ইসলামের সমঝ লাভ করেছেন। এই সুন্দর ইসলামটি ‘অরাজনৈতিক’। তাই বৃহত্তর অনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার বিপক্ষে তাদের কোনো বক্তব্য নেই, কর্ম নেই, প্রচার নেই, আলোচনা নেই। বরং সময়মত ইসলামের আদর্শের বিপক্ষের ব্যবস্থাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে সেই ব্যবস্থার প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। তাদের দৃষ্টিতে তাদের এই যে অবস্থান -এটিই হচ্ছে ‘শান্তির ইসলাম’, সত্য সঠিক ধর্ম। অথচ প্রত্যেক নবীর তাওহীদের কলিমাতে বিপরীত নৈতিকতার সমাজ ও স্রোতের বিপক্ষে আহবান ছিল এবং এজন্য তারা নির্যাতিত, দেশ বহির্ভূত, এবং কখনো শাহাদত বরণ করতেও হয়েছিল।
-তিন-
শুরু থেকে সার্বিক ধারণা: লা ইলাহার দাওয়াতে সমাজ, রাষ্ট্র ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
(৩.১) এই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ প্রকৃতিটাই ছিল এমন যে এর ব্যাপ্তি অপর কোনো ব্যবস্থা ও মূল্যবোধের আওতাভুক্ত হয় না। মুসাকে (আ.) প্রথমেই ফিরাউনের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। মুসার (আ.) দাওয়াতে ফিরাউন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছিল, সে বুঝতে পেরেছিল যে এই দাওয়াত গোটা সমাজ পরিবর্তনের দাওয়াত। সে বলেছিল, ‘তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও, ডাকুক সে তার পালনকর্তাকে! আমি আশংকা করি সে তোমাদের দ্বীনকে (শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা) পরিবর্তিত করে দেবে অথবা সে দেশময় বিপর্যয় (ফাসাদ) সৃষ্টি করবে (৪০:২৬)।
(৩.২) সকল নবী রাসূলের বাণীতে সমাজ সংশোধন, আর্থিক ব্যবস্থার সংশোধন, সামাজিক আচরণের সংশোধন, ব্যক্তির চিন্তা ও আচরণের সংশোধন –এইসব ছিল। এই দাওয়াত কখনো একান্ত ব্যক্তিক ছিল না। শোয়ায়েব (আ.) এর কাওমের কথা বিবেচনা করুন। তাঁর জাতি বলছে, ‘قالوا يا شعيب أصلاتك تأمرك أن نترك ما يعبد آباؤنا أو أن نفعل في أموالنا ما نشاء إنك لأنت الحليم الرشيد -হে শোয়ায়েব, তোমার নামায কি এই নির্দেশ দেয় যে আমরা আমাদের বাপ-দাদারা যেসবের ইবাদত করতেন তা ছেড়ে দেই এবং এটাও (কী নির্দেশ দেয়) যে আমাদের ধনমালের বিষয়ে আমরা যেভাবে চাই সেভাবে (আয়/ব্যয়) করতে পারব না’ (১১:৮৭)?
(৩.২) সার্বিক আনুগত্যের দাওয়াতে প্রতিক্রিয়ার বিষয় প্রকৃতিজাত। এর মধ্যে দুটো দিক থাকে –ইতিবাচক ও নেতিবাচক। প্রথমটি হচ্ছে এক ইলাহ মানার আহবান আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে যাবতীয় মন্দকে বর্জন করা যা সমাজকে আচ্ছাদন করে। ওরাক্বা বিন নওফল নব্যুয়তের শুরু লগ্নেই সমাজের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আভাষ দিয়েছিলেন। তারপর আমরা কোরাইশদের ধারণা ও বাস্তব বিরোধিতাতে পাই; এবং তাদের ‘সমঝোতা’ বা আপোষ প্রস্তাবেও পাই। এই কথাগুলো নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব এখানে দেখতে পারেন
বিষয়: বিবিধ
১৮৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন