শারিয়া কী?

লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ২৫ মে, ২০১৪, ১০:৩৩:৪১ রাত

[লেখাটির পরিধি সংকোচন করা হয়েছে।] এই থ্রেডে অন্যান্য লেখা:

১। বৈধ (রাজ)নীতি: সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ (পর্ব ১, পর্ব ২, পর্ব ৩)

২। ইসলামের রাজনীতি: শাব্দিক উৎস ও ধারণা

৩। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিবন্ধক যুক্তি

৪। কাল-সাগরের ঢেউ

ভূমিকা

শারিয়া (شريعة) একটি অতি পরিচিত শব্দ। এটি ইসলামী আইনের পরিসর যা জীবনের সকল অঙ্গনকে আবেষ্টন করে, অর্থাৎ ব্যক্তিক, পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়। এখানে আইন সুবিন্যাস্ত হয়। যেখানে কোরান ও সুন্নাহর আইন অনুপস্থিত অথবা অস্পষ্ট সেখানে সৃষ্টিশৈলী ও যৌক্তিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কোরান ও সুন্নাহর সাথে আইনকে সমন্বিত করা হয় এবং এতে মূল বিধানের নিকটবর্তী সমঝে উপনীত হওয়া হয়। ইসলামী শারিয়া হচ্ছে কোরান-সুন্নাহ বুঝার ও অনুসরণ করার প্রজ্ঞাপূর্ণ ও ব্যাপৃত পরিসর। কোরান ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেসব নীতি-পদ্ধতি গৃহীত হয় তাতে কোরান ও সুন্নাহকে সঠিকভাবে বোঝা ও অবলম্বনের ইচ্ছা ব্যতীত আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না।

ইসলামী আইন দার্শনিকদের মতে, আইন পাঁচভাগে বিভক্ত: ১। ইতিকাদ (বিশ্বাস), ২। আদব (ন্যায়নীতি), ৩। ইবাদাত (উপাসনা), ৪। মুয়ামালাত (কাজ-কারবার), ৫। উকুবাত (শাস্তি)’ (গাজী শামছুর রহমান, ১৯৮১: ভূমিকা)। অর্থাৎ এই পাঁচ ভাগে প্রধান সকল দিককে কভার করা যায়। তবে অন্যরা আরও বিভাগে বর্ধিত করেন। তাছাড়া প্রশাসনিক নিয়মনীতির বিধানও এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

শারিয়া শব্দের ক্রিয়াবাচক অর্থ

প্রথমত, বাংলায় শারিয়া শব্দের বানানটি দেখে নেই। তারপর অর্থ বিবেচনা করব। এই শব্দটি স্বাধারণত তিনভাবে দেখে থাকি: ‘শরিয়া’, ‘শারিয়া’ ও ‘শারিয়াহ’। প্রতিবর্ণনের (transliteration) দিক থেকে এটি শারী‘আহ (شريعة/sharī‘ah) লেখা অধিক সংগত মনে হয়। তবে এই প্রবন্ধে আমি প্রচলিতভাবে ‘শারিয়া’ লিখে যাব। কেননা হঠাৎ করে নতুন কিছু শুরু করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না।

শারিয়া শব্দ ক্রিয়াবাচক শারা‘আ (شرع) শব্দ থেকে নির্গত। শারা‘আর শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল ‘শুরু (شروع) করা’। আমরা বাংলায় শব্দটিকে গ্রহণ করেছি। তবে আমাদের এই প্রসঙ্গে ‘শুরুর’ তাৎপর্য অনুসন্ধান করছি না যদিও একটু ব্যাখ্যায় গেলে এই তাৎপর্যেও শারিয়ার অর্থ দেখা যেতে পারে। আল্লাহই মানুষের জন্য তার নৈতিক জীবনের পথ নির্দেশ করেছেন, শুরু করে দিয়েছেন। এই শুরু তাঁরই নির্দেশ। নৈতিকতার বিষয়টি আমরা কেবল প্রাণী জগতে মানুষের মধ্যে স্পষ্টত লক্ষ্য করি। পানি থেকে আল্লাহ যেমন প্রাণবন্ত সবকিছু সৃষ্টি করেছেন (২১:৩০) তেমনি যেন তাঁর নির্দেশ থেকে নৈতিক জীবনের পরিমণ্ডল রূপায়িত হয়েছে। তাঁর নির্দেশকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় আমাদের ভাল-মন্দ বিবেচনার নৈতিক জীন্দেগী। এই নির্দেশই নৈতিকতার আসল বস্তু। হত্যা কেন হারাম হবে অথবা শুয়ের গোশত কেন খাওয়া যাবে না, অথবা যিনা-ব্যভিচার কেন মন্দ হবে? উত্তর হবে আল্লাহ তা নিষেধ করেছেন -এটা তাঁরই নির্দেশ। আল্লাহ বলেন, ‘সতর্ক হও, সৃষ্টি তাঁরই এবং নির্দেশও তাঁর। তিনি মহামহিমাময় আল্লাহ্ -বিশ্বজগতের প্রভু’ (৭:৫৪)! আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোনো নৈতিক জীবনের ধারণা যৌক্তিক নয়। আমি এই যৌক্তিকতা অন্য কোনো প্রবন্ধে আলোচনা করব। আর এদিক দিক থেকে তার নির্দেশে সমন্বিত কর্ম সাধনের নামবাচক (noun) শব্দ হয় শারিয়া। শুরু-কেন্দ্রিক এই তাৎপর্য এক পাশে রেখে আমরা অপর অর্থ অনুসন্ধান করতে যাব।

শারা‘আ (شرع) শব্দের অপর অর্থ হয় জলাশয়ে যাওয়া, জলাশয়ে নামা, জলাশয় থেকে পানি পান করা ইত্যাদি। যেমন বলা হয় শারা‘আত আদ-দাওয়াব (شرعت الدواب الماء) পশুগুলো জলাশয়ে নেমেছে (বা জলাশয় থেকে পানি খেয়েছে) [লিসানুল আরব/আরবি লেক্সিকন]। শারা‘আতু ফী আল-মা ( شرعت في الماء) আমি (জলাশয় থেকে) পানি খেয়েছি, বা আমি জলাশয়ে নেমেছি (পানিতে ঢুকেছি) [উইলিয়াম লেন/আরবি লেক্সিকন]। এটিই প্রাচীন অর্থ।

জলাশয় হচ্ছে সেই স্থান যেখানে পানির সংকীর্ণতার অবসান হয়েছে, পানির পরিমাণ বৃহৎ হয়েছে। (এটা সংকীর্ণ অর্থের জলাশয় নয় যা বৃষ্টিতে জমে এবং পরে শেষ হয়)। আবার রূপকতায় কোনো একটি ধারণা বা চিন্তাকে বর্ধিত বা প্রশস্ত করা অর্থেও শারা‘আ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। পথ প্রবর্তন বা পথে আসার সুযোগ করা অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন শারা‘আ আল-বাবা ইলাথ থারীক্ব (شرع الباب إلي الطريق) সে রাস্তায় আসায় জন্য একটি দরজা খোলে দিয়েছে (লিসান/মুখতারুস সিহাহ)। কেউ কোনো আলোচ্য বিষয়ে প্রবেশ করা অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন শারা‘আ যাইদ ফী আল-আমর (شرع زيد في الأمر যাইদ এই বিষয়ে নেমেছে, (অর্থাৎ যাইদ আলোচনায় নেমেছে বা কোনো বিশেষ কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। এটি প্রথমে যে ধারণা দিয়েছি তার সমার্থক)। কোনো একটি ধারা প্রতিষ্ঠা, প্রবর্তন বা নির্দেশ/জারি করা অর্থেও হতে পারে। যেমন শারা‘আ লাহুম ফুলান (شرع لهم فلان) অমুক ব্যক্তি একটি (আইনি/ধর্মীয়) নির্দেশ করেছেন, বা পথ নির্ধারণ করেছেন। এভাবে, কোনো বিষয়কে স্পষ্ট করা, ব্যাখ্যায় বর্ধিত করা, দ্ব্যর্থতা দূর করা, জটিলতা পরিষ্কার করাও হতে পারে। নির্ধারণ ও নির্দেশের অর্থ আমরা কোরান থেকে নিতে পারি। যেমন: شَرَعَ لَكُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحاً وَٱلَّذِيۤ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَىٰ وَعِيسَىٰ أَنْ أَقِيمُواْ ٱلدِّينَ وَلاَ تَتَفَرَّقُواْ فِيهِ ‘তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সেই পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি (এখন)প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’ (৪২:১৩)। এভাবে কুফুরি দ্বীন-ধর্মের ব্যাপারেও শব্দটির ব্যবহারটি এসেছে, সেই ধর্ম হোক পৌত্তলিকতা, নাস্তিকতা অথবা সংকর ধর্ম (সেক্যুলারিজম), যেগুলো মানুষ নিজেরাই নিজেদের জন্য নির্ধারিত করে নিয়েছে যার পক্ষে আল্লাহর কোনো বাণী আসেনি। আল্লাহ বলেন, لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنْ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ তাদের কি এমন কিছু শরীক দেবতা রয়েছে, যারা তাদের জন্যে ধর্ম নির্ধারিত করেছে, যার অনুমতি (বা যে নির্ধারণের অনুমতি) আল্লাহ দেননি’ (৪২:২১)?

নামবাচক (nominal) অর্থ

উল্লেখ হয়েছে, শারিয়া অর্থ জলাশয়, পানির স্থান। তবে এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে আইন-এটিই সকলের কাছে পরিচিত। মরুর কোনো জলাশয়ে উপস্থিত হওয়া জীবন লাভের মত। শব্দটির গভীর তাৎপর্য আমরা মরুভূর রূঢ় পরিবেশে পাই। ইসলামের অনেক মৌলিক শব্দ মরুর জীবন ব্যবস্থায় উৎসারিত। একটি প্রাণী যখন পানির অন্বেষায় চতুর্দিকে ঘোরে,তার সন্ধানী মন বিভিন্ন বিকল্প পথ বা ধারা অবলম্বনের চিন্তা করে, অস্থিরতা অনুভব করে, তারপর যখন সে জলাশয়ে উপনীত হয় তখন যেন তার সমস্যার সমাধান হয়েছে,অস্থিরতার অবসান হয়েছে।

শারিয়া হচ্ছে জীবন সমস্যার সমাধান-কল্পে, নৈতিক জীবন যাপন করতে, নানান ধারণা, নানান পথ, নানান সমস্যার মোকাবেলায় একটি নিশ্চিত ও নির্ধারিত পথ। এখানে জীবন জিজ্ঞাসার যাবতীয় সমাধান রয়েছে। এই স্থানটি যেন জীবন সঞ্জীবনী, জীবন নির্ঝরিণী।

ইসলামী শারিয়ার মূল উৎস হচ্ছে কোরান, সুন্নাহ (এখানে সুন্নাহ হাদিস অর্থে নয়), ইজমা ও ক্বিয়াস। কখনো বিধানের স্পষ্টতা কোরানেই রয়েছে, কখনো বা সুন্নায়, অথবা হয়ত ইজমায় স্পষ্ট হয়েছে, নতুবা ক্বিয়াসে, (শেষোক্ত পরিভাষাদ্বয়ের অর্থ পরে আসছে)। কোরান হচ্ছে আল্লাহর বাণী। সুন্নাহ তাঁর রাসূলের ব্যাখ্যা, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, নির্দেশনা –এক কথায় তাঁর দেখানো পথ যা তাঁর কাছ থেকে বর্ণিত হাদিস থেকে নির্যাস করা হয়। এই সুন্নাহ সাহাবিদের (রা.) মাধ্যমে প্রচারিত ও সংরক্ষিত। নবী থেকে প্রাপ্ত বর্ণনায়, তাঁর কর্মধারা ও শিক্ষায় কালীন ও চিরন্তনী যে যে মূলনীতি পাওয়া যায় সেটিই হয় সুন্নাহ। তবে কখনো কখনো হাদিস ও সুন্নাহ শব্দদ্বয় পারস্পারিক প্রতিস্থাপিত (interexchanged) অর্থে ব্যবহৃত হতেও দেখা যায়। তবে কথা আগেইটাই থাকে অর্থাৎ সুন্নাহ হাদিস থেকেই নির্ধারিত ও সংরক্ষিত। পরের পর্বে শারিয়ার প্রয়োজন, শারিয়ার ভিত্তি এবং ফিকহি নিয়ম-পদ্ধতি (methodology) আলোচনা করা হবে।

রেফারেন্সেস

____________________________

(১) ইবন মানযুর, লিসানুল আরব, [অনলাইন, প্রাপ্তব্য]

(২) আর-রাজি, (১৯৯৭).মুখতারুস সিহাহ। বাইরূত:মাকতাবাহ লুবনান [আনলাইনেও প্রাপ্তব্য]

(৩) Lane, E. W. (1968). An Arabic English Lexicon, Beirut: Librairie Du Liban [অনলাইনেও প্রাপ্তব্য]

(৪) গাজী শামছুর রহমান, (১৯৮১), ইসলামী আইনতত্ত্বের বিকাশ ও পরিচিতি , ঢাকা: ইসলামী ফাউণ্ডেশন

বিষয়: বিবিধ

১২২৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

226272
২৬ মে ২০১৪ রাত ০১:৫৩
এম_আহমদ লিখেছেন : @হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে

ভাই, ভুলে আপনার মন্তব্যটা মুছে ফেলেছি, এজন্য দুঃখিত। পাঠ ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File