বৈধ (রাজ)নীতি: সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ -শেষ পর্ব-

লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ১৫ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:২৩:৩৮ রাত



-প্রথম পর্ব- / -দ্বিতীয় পর্ব-

-------------

আজকের নৈতিক বিপর্যয়

আজ আমাদের দেশে, রাষ্ট্রযন্ত্রসহ, সমাজের সকল স্তরে সার্বিক অনৈতিকতার সয়লাব ঘটছে। একদিকে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, সন্ত্রাস আর অপর দিকে চলছে নৈতিক মূল্যবোধের শেষ বাধটুকুও ভেঙ্গে দেয়ার বৃহত্তর পরিকল্পনা। আজকের মুরতাদ শুধু মুরতাদই নয়, ওরা বিভিন্ন সূত্রের অর্থায়নে চালাচ্ছে ইসলামের বিপক্ষে বিদ্বেষী প্রচারণা, প্রোপাগান্ডা। ধর্ম ধ্বংস করলেই বুঝি সমাজে মান্না আর সালওয়ার সয়লাব ঘটবে। আর তারা এই ধ্বংস ক্রিয়ায় সৃষ্ট করছে এক তুমুল সামাজিক ফাসাদ। এদিক থেকেও আজ উলুল আমরের নৈতিক নেতৃত্বের উপস্থিতি চরম দাবি রাখে। এই অবস্থা যেন জীবন মরণের মত –নৈতিক সঞ্জীবনীর অভাবে সমাজ মুমূর্ষু। দেশে ইসলামী নিয়ম থাকলে উলুল আমরগণ শারিয়ার বিধান অনুযায়ী এই ফাসাদের যে শাস্তি আছে, তারা সামাজিক মাসলাহাতের স্বার্থে, তা’ই প্রয়োগ করতে পারতেন, অথবা শাস্তি বাড়াতে-কমাতেও পারতেন। চরম মূহুর্ত্তে চরম নিরোধক (deterrent/তা’জীর) এর প্রয়োজন। আলী (রা.) এর সময় দু-একজন মুরতাদকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল (আব্দুলকরীম, ১৯৯৭) । এক ব্যক্তি মুরতাদ হওয়া এবং মুরতাদ হয়ে প্রচার প্রোপাগান্ডায় সামাজিক ফাসাদ সৃষ্টি –এই দুই জিনিস এক নয়। তাছাড়া আজকে আরেক সম্প্রদায় আছেন যারা মুরতাদদের অনুকূলে আস্কারা যোগান, যুক্তি ও ধর্ম দেখিয়ে তাদের অবস্থান সমর্থন করেন, তাদেরও বিচারের মুখামুখি হতে পারে। দ্বীন তামাশার বস্তু নয়। যে ব্যক্তি যে জ্ঞানের লায়েক হয়নি, তাকে ভুল তথ্য বিস্তার করার এবং সমাজে ফিতনা ও ভ্রষ্টতার পথ খুলে দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। তারা আদালতে হাজির হলে তাদের জ্ঞান কোথায় এবং ফিতনা কোথায় সেই বাস্তবতা উন্মোচিত হবে। যতটুকু মনে পড়ে, ১৯৮৪ সালের শেষের দিকে সুদানে এক ব্যক্তি কোরান অনলিদের মত এক নতুন ধারণা উদ্ভাবন করে যে মানুষ ‘ইয়াক্বীন’-এর পর্যায়ে উপনীত হলে তার জন্য আর আল্লাহ ইবাদতের প্রয়োজন হয় না। তার মতের পক্ষে কোরানের এই আয়াত উপস্থাপন করে, ‘আপনার প্রভুর ইবাদত করুন ইয়াক্বীন না আসা পর্যন্ত (১৫:৯৯)।’ তখন সুদানে ইসলামী শরিয়া কার্যকর ছিল। তাকে আদালতে নেয়া হয় এবং দীর্ঘ শুনানির পর আদালত তাকে ফাঁসীর হুকুম দেয়। কেননা তার দ্বীনহীন-ধারণা নিজের মধ্যে সীমিত না থেকে, তার ব্যাখ্যা ও কর্মকাণ্ড এবং প্রচার-প্রচারণা হয়ে পড়েছিল সামাজিক ফাসাদ। উলুল আমরদের দায়িত্ব ছিল জনগণের দ্বীনকে সেই ফাসাদ থেকে হেফাজত করা। সে কোরানের উল্লেখিত আয়াতের ১৪০০ বছরের ব্যাখ্যার বাহিরে গিয়ে এমন একটি ধারণার জন্ম দিতে চাচ্ছিল যা ইসলামে নেই। ইয়াক্বীনে পৌঁছে যদি ইবাদত শেষ হয়ে যেত, তবে নবী রাসূলগণ সকলের আগেই তা ছেড়ে দিতেন। ইয়াক্বীন শব্দের অর্থ এখানে ‘মৃত্যু’, যা নির্ধারিত, সুনিশ্চিত (inevitable)। এখানে আয়াতের অর্থ হয় আপনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল্লাহ ইবাদত করতে থাকুন। আজকাল যারা কোরান হাদিস নিয়ে যথেচ্ছ ফাসাদ করছে, সেই ফাসাদ তাদেরকে করতে দেয়া হবে না। সমাজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির প্রসার, বাঁধা-ভাঙ্গা অনৈতিক সামাজিক আচরণের মুক্তধারা নির্বিচারে চলতে দেয়া হবে না। আজ পরিবর্তের প্রয়োজন।

সর্বগ্রাসী সামাজিক চিত্র ও শেষ কথা

আজকে সমাজে যে বাঁধ-ভাঙ্গা অনৈতিকতা: চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, বনসম্পদ লুট, মৎস্য-সম্পদ লুট, ভূমি দস্যিপনা, ব্যাঙ্ক লুট, স্টক-একচ্যাঞ্জ লুট, যেখানে সেখানে জাতীয় সম্পদের হরিলুট, এগুলোই আর্থ-সামাজিক তোলপাড় ঘটাচ্ছে। এর গতি হচ্ছে দ্রুত। এই প্রক্রিয়ায় রয়েছে তাদেরই এক মিডিয়া মহল। আর সকল তাণ্ডবের মধ্যখানে চলছে নানান আদর্শবাদী চিৎকার, বিস্ফোরণ সদৃশ গান-বাজনা, নৃত্য, ইয়াবা ও মাদকের হুলাহোল। অনৈতিক ভিত্তিতে হঠাৎ-প্রাপ্ত সম্পদ সৃষ্টি করছে অপ্রত্যাশিত সামাজিক পরিবর্তন। এগুলোর প্রতিফলন ঘটছে সামাজিক মানসিকতায়। বিগত দুই শতাব্দী ব্যাপী আমাদের ভূখণ্ডে কোথাও তো ইসলামী আইন নেই, শাসন ব্যবস্থাও নেই, তবুও ভুল ব্যাখ্যায় ইসলামী নৈতিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি ভীতি সৃষ্টি করে এবং ইউরোপীয় আদর্শে সেক্যুলার স্বর্গ-সমাজ গড়ার ভুয়া প্রতিশ্রুতি দশকের পর দশক দিচ্ছে।

আজ বিকল্প হিসেবে, নৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার ডাইনামিজমের প্রয়োজন। সৎ-চরিত্রবান, খোদাভীরু, বিজ্ঞ উলুল-আমরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন, যারা নিজ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠবেন, যারা ‘আমানতের’ হেফাজত করবেন এবং পরকালমুখি হয়ে ইহকাল দেখবেন। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, সিভিল সার্ভিস, জুডিসারি, আইন প্রয়োগ ও নিরাপত্তা বাহিনী সর্ব-ব্যাপী বিশ্বাস-হারা যে সেক্যুলার দৈন্যতা প্রবেশ করেছে সেই ধারা প্রতিরোধ করতে হবে। ইউরোপীয় সেক্যুলার মডেলের চিৎকার অনেক করা হয়েছে। একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আদর্শ ও জীবন পদ্ধতি একটি ক্ষুদ্র একাংশের কারণে প্রতিহত হতে পারে না, জলাঞ্জলি হতে পারে না। ওদের প্রচলিত রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সমাজকে কোথায় নিয়ে এসেছে -এই দুর্দশা দেখা দরকার। আজ খোদ ইউরোপের সেক্যুলার ব্যবস্থার দৈন্যতা চুরিতে, ডাকাতিতে, ধর্ষণে, ভীতিতে এবং নানান ত্রাসে জর্জরিত। ইউরোপের ধনাঢ্যতার কারণে কোনো রকমে সামাজিক শৃঙ্খলা ঠিকে আছে যদিও মানসিক অশান্তি গণজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজিত।

আবার, আজকের সামাজিক দুরবস্থা বুঝতে কেবল সমস্যার দিকে তাকালে চলবে না। ওমরদের মত সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণে যেতে হবে, সামাজিক কন্ডিশনসমূহ সামনে আনতে হবে। প্রচলিত সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা ও তার অন্তঃসারশুন্যতার দিকে তাকাতে হবে। এই ব্যবস্থার হাত ধরেই আসছে বিভিন্ন ডাকাত ও লুটেরা শ্রেণী; এই ব্যবস্থার আওতায় সুবিচার, সুশিক্ষা ও সৎচরিত্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ইতিহাস এর সাক্ষী।

পরিশেষে, একথা সতর্কতার সাথে খেয়ালে থাকা উচিৎ যে যদি গণ-সমর্থন ইসলামী রাষ্ট্রীয় চিন্তার অনুকূল আসে, এবং যদি রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাও সম্ভাব্যময় হয়ে ওঠে, তবে সেই পরিসরে যারা উলুল আমরের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তাদেরকে, সর্বাবস্থায়, শান্ত মাথায়, নানান প্রতিকূলতায় কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশে যেসব আইন রয়েছে সেগুলোর এক বড় অংশ জনকল্যাণের স্বার্থেই প্রবর্তিত হয়েছে। তাই সব আইন, সব প্রথা, সব নিয়ম হয়ত উড়িয়ে দেয়ার কথা আসবে না। শুধু সেই আইন, সেই প্রথা, সেই প্রাতিষ্ঠানিক বিধানসমূহ যেগুলো নৈতিক জীবন দর্শনের প্রতিকূলে অবস্থিত, যেগুলো কোরান ও সুন্নাহর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, কেবল সেগুলো। এরই সাথে প্রশস্ত-চিত্তে ‘ভালকে’ ভাল হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা থাকতে হবে, তা হোক পূর্ব থেকে আসা অথবা পশ্চিম থেকে। তারপর ইসলামায়নের সব কাজ তড়ি-ঘড়ি করে ফেলার প্রবণতা সরিয়ে রাখতে হবে। কাজ হতে হবে হলে হলে (ধীরে ধীরে)। সমাজ প্রাসাদের মত। এর একেক খুঁটির সাথে অন্যান্য খুঁটির সম্পর্ক, এর এক ভরের (support) সাথে অন্যান্য ভর সম্পর্কিত। এগুলো ধীরে স্থিরে করলে সময়ের সাথে বিকল্প খুঁটি ও ভর সম্পর্কশীল হতে পারে এবং পরিবর্তন স্থিতিশীলতার সাথে গড়ে ওঠতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সাথে জড়িত লোকজন এবং বিদ্বেষী মহল পদে পদে ইসলামাইজেশন (ইসলামীকরণ) এর বিরোধিতা করবে, মুনাফিক মহল ও তাদের মিডিয়া তিলকে তাল করবে, সত্যকে মিথ্যায় প্রতিপন্ন করবে। সর্বাবস্থায় উলুল আমরগণ উত্তেজনা বিবর্জিত হয়ে সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার (প্রজ্ঞা ও কৌশলের) পথ অবলম্বন করতে হবে। খোলাফায়ে রাশেদা কীভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সেই দরস নতুনভাবে স্মরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে ক্ষমতা হাত বদলালেই সমাজ পরিবর্তিত হয়ে যায় না, বিজয় আস্‌লেই দুশমন শেষ হয়ে যায় না।

References

(1). Kamali, M. S. (1989). Syāsah Shar‘iyyah the Policies of Islamic Government. The American Journal of Islāmic Social Sciences, Vol. 6, (1989), 59-81. Available at http://www.hashimkamali.com/index.php/publications/item/44-siyasah-sharciyyah-or-the-policies-of-islamic-government

(2) Al-Utaiby, S. (2013). As-Syāsah as-Shar‘iyyah. Umm al-Qurā’ University. Available: http://uqu.edu.sa/page/ar/154930. Last accessed 27/08/2013.

(3) Abdulkarim, K. (1997). Mujtama‘ Yathrib. Cairo: Sīnā lin-Nashar

(4) ’Abū al-‘Izz al-Ḥanafī. (2002). Sharḥ al-‘Aqīdah al-Ṭaḥāwiyyah [Arabic], Dār ibn Rajb

(5) Najjar, F. M. (1984). Syāsah in Islāmic Political Philosophy. In: Marmura, M. E. Islāmic theology and Philosophy. New York: State University of New York. pp92-110.

নোটস:

[১] আ‘জমী, এন এম. (১৯৭৬). মেশকাত শরিফ, তৃতীয় জিলদ, (বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যাসহ). ঢাকা: এমদাদিয়া লাইব্রেরী পৃ ২৪৩

বিষয়: বিবিধ

১৫৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File