বৈধ (রাজ)নীতি: সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ -পর্ব ৩-

লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ১৩ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:৩৮:৫৩ রাত

-প্রথম পর্ব-

-দ্বিতীয় পর্ব-

-------------

প্রাথমিক যুগ থেকে সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ

সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার প্রয়োগ নবীদের কর্মনীতিতে ছিল এবং খলিফাদের কর্ম পদ্ধতিতেও ছিল। সূরা তাওবায় (৯/১১৮) তাবুকের যুদ্ধে পিছনে পড়ে থাকা তিন ব্যক্তির শাস্তির ব্যাপার সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার আওতায় ছিল। কেননা সেই যুদ্ধে না যাওয়া বাকিদেরকে মাফ করা হয়েছিল (উতাইবী, ২০১৩)। সমাজের মাসলাহাতের জন্য হাতিমের অংশকে কাবা গৃহের সাথে সংযুক্ত না করাও ছিল সেই নীতির ভিত্তিতে। মুতার যুদ্ধে খালেদ বিন ওয়ালিদকে রাসূলুয়াল্লাহ (সা.) কোনো পর্যায়ে নেতৃত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন নি কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার নীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি প্রণয়নের উদাহরণ নবীতে এবং খোলাফায়ে রাশেদায় ভুরি ভুরি রয়েছে (প্রাগুক্ত)। নবী ইউসূফ (আ.) নিজে অগ্রসর হয়ে বাদশাহর কাছে বাইতুল মালের দায়িত্ব গ্রহণ করাতেও এই নীতি কার্যকর ছিল।

কোরানের ৯:৬০ আয়াতে যাকাতের টাকা যে কয়টি খাতে ব্যবহার করার কথা আছে তাতে দাসমুক্তি ও ‘যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন’ এমন দুটি খাতও রয়েছে। উল্লেখিত দ্বিতীয় খাতে যে শ্রেণীর লোকজন বিবেচনায় আসেন তারা হচ্ছেন ক্ষমতাধর লোক যাদের সাহায্য ও সহযোগিতায় রাষ্ট্র ও সমাজ নিরাপদ থাকতে পারে। যদিও এই খাতের কথা কোরানে আছে তথাপি ওমর (রা.) এই ভাতা বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ ইসলামকে ক্ষমতা সম্পন্ন ও মহান করেছেন সুতরাং এখন ইসলাম আর তাদের অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী নয়’ (কামালী, ১৯৮৯)। একবার অনাবৃষ্টিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ওমর (রা.) ঐ বৎসর কেউ চুরি করলে হাত কাটার আইন মওকুফ করেন, এতেই প্রকাশ পেয়েছিল সার্বিক কল্যাণ ও আইনের অন্তর্নিহিত এহসাস ও উদ্দেশ্য অনুধাবন। ইমাম ইবন কায়্যিম (র.) বলেন, সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ আপনাতেই ‘পরিপূর্ণভাবে’ শরিয়ার রীতির সাথে সঙ্গতিশীল হওয়া বুঝায় না। ইবন কায়্যিম বলেন, ‘যে পদক্ষেপ সমাজকে কল্যাণ ও সুস্থতার নিকটবর্তী করে এবং অকল্যাণ ও ফাসাদ থেকে সরিয়ে রাখে তা’ই ন্যায়পরায়ণ সিয়াসাহর অন্তর্ভুক্ত হয়। এই কাজ করতে গিয়ে যদি নবীর কোনো অনুমোদন বা কোরানের আয়াত না পাওয়া যায় তবুও। যারা বলেন যে সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ বলতে কিছু নেই, যা আছে তা কেবল শরিয়াহ, তারা ভুল, তারা নবীর (সা.) সাহাবিদেরকে বুঝতে ভুল করেছেন, (কামালী, ১৯৮৯)

ইসলাম যৌন অনৈতিকতার দূরাবস্থা থেকে সমাজকে রক্ষা করতে বৈবাহিক নিয়ম সহজ করেছে কিন্তু এখানে খেল তামাশা পছন্দ করেনি। কোনো একটি বিবাহ ভাঙ্গতে এক মজলিসে তিন তালাকের নিয়ম কার্যকর ছিল না। আবু বাকরের (রা.) সময় তা ছিল না। কিন্তু ওমর (রা.) তাঁর সমাজের আচরণ লক্ষ্য করে একত্রে তিন তালাক কার্যকর করেন। এতে কোরানের আক্ষরিক বিধান ও পূর্ববর্তী নিয়মের ব্যত্যয় দেখা যায়। কিন্তু এটা ছিল পরিস্থিতির মোকাবেলায় আইনের গুরুগম্ভীরতা প্রতিষ্ঠা করতে। এমন গুরুতর বিষয় যেন সমাজে খেলতামাশায় পর্যবেশিত না হয়।

কোনো সমাজ ব্যবস্থার কর্তৃত্ব হাত বদলালেই আগের সব প্রথা একদম বিলীন হয়ে যায় না। জাহেলী প্রথার অকল্যাণকর দিকগুলোর উচ্ছেদ ঘটালেও সেই পূর্ব-প্রথার অনেক উপস্থিতি এখানে-সেখানে ছিল। ওমরের (রা.) অনুভূতিতে সামাজিক ব্যবস্থা ও প্রথাকেন্দ্রিক সেই দূরদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়। অদূর ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেদিকেও তাঁর সতর্কতা ছিল। মুস্তাজিল বিন হুসাইন থেকে বর্ণিত, একদিন ওমর (রা.) আমাদের মজলিসে বক্তৃতা করলেন। তিনি বললেন, কাবার প্রভুর শপথ, আমি জানি আরবরা কবে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। একজন মুসলিম দাঁড়িয়ে বলল, আমিরুল মু’মিনীন, তারা কবে ধ্বংস-প্রাপ্ত হবে? তিনি বললেন, যখন এমন ব্যক্তি তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করবে (অর্থাৎ সিয়াসার দায়িত্ব নেবে) যে জাহেলী (সমাজ/রাষ্ট্র) ব্যবস্থার এলাজ করেনি (মোকাবেলা করেনি, এই কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি) এবং (এই কাজে) নবীর সাথী হয় নি (নবীর সুহবত লাভ করেনি, নবীর একান্ত সাহাবী হয়নি) [আল-মুসতাদরাক (১)]। অর্থাৎ যেসব সামাজিক অবস্থার মোকাবেলায় আইন পরিবর্তন হচ্ছিল বা নতুন আইন জারি হচ্ছিল ওরা সেই আইনের পিছনের প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য ও এহসাস অনুভব করেনি।

রাষ্ট্রযন্ত্রের বাহিরের সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহর উদাহরণ দিতে উতাইবী (২০১৩) ইবন তাইমিয়া (র.) থেকে মুসার (আ.) ও খিদরের (আ.) সাক্ষাতের ঘটনা উল্লেখ করেন। খিদর (আ.) যে কাজগুলো করেন, সেগুলো আপাত দৃষ্টিতে সমস্যাবহুল হলেও তাতে খিদর যে ‘ইলম’ প্রদর্শন করেন তাতে তার প্রত্যেকটি কাজে মাসলাহাতের (কল্যাণের) প্রেক্ষিত বহন করে।

আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের সাথে প্রতারণা করে এবং অপরকে ধোঁকা দিয়ে অন্যায়-কার্য পরিচালনা এক জঘন্য অন্যায়। একবার আব্দুল্লাহ বিন আবি জুজ‘আ নামক এক ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ তাঁর একটি জুব্বাসহ, তায়েফের সাক্বিফ গোত্রে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাদের ওখানে গিয়ে বলেন, এই দেখুন রাসূল্লাহর জুব্বা। তিনি আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদের যে কোনো ঘরে ইচ্ছা থাকতে পারব। তারা বললেন, এই হচ্ছে আমাদের বসবাসের গৃহাদি, আপনি যেখানে ইচ্ছা সেখানে অবস্থান নিতে পারেন। কিন্তু যখন রাত হল, তিনি বললেন, আমি আপনাদের যে কোনো মহিলার সাথে রাত কাটাতে পারব। তারা বললেন, আমরা তো রাসূলের সাথে ওয়াদা করে এসেছি, তিনি তো আমাকের যিনা-কার্য হারাম করলেন। আমরা তো তাঁর কাছে কাউকে পাঠাতে হবে। তারপর তারা রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এক ব্যক্তিকে পাঠালেন। তিনি যোহরের সময় রাসূল্লাহর (সা.) দরবারে উপস্থিত হলেন এবং বিস্তারিত বিষয় জানালেন। রাসূলুল্লাহ দুই জন আনসারীকে [বিষয়টি সরে জমিনে প্রমাণিত হলে] তাকে হত্যা করে তার মৃতদেহকে পুড়িয়ে দেবার নির্দেশ দেন। তারা তাই করেন। মতান্তরে হত্যার আগেই আব্দুল্লাহ বিন আবি জুজ’আহ তার প্রকৃতির টানে বাইরে গেলে তাকে সর্প দংশন করে। আনসারীরা তার মৃতদেহকে পুড়িয়ে দেন (আব্দুলকরীম, ১৯৯৭)। এখানে লক্ষণীয় যে তখনও যিনার কাজ সম্পন্ন হয় নি। এধরনের শাস্তির শ্রেণী হচ্ছে তা‘যীরাত, প্রতিরোধক। লক্ষণীয়, এই ব্যক্তি রাসূলকে দেখেছিলেন, রাসুলের কথা শুনেছিলেন, ঈমানের ঘোষণা দিয়ে মুসলিম হয়েছিলেন। এটাও মনে রাখতে হবে যে সমাজ হচ্ছে মানবের এক বৈচিত্র্যময় সমষ্টি। রাসূলের (সা.) সময়েও কেউ কেউ অনেক ওয়াক্তের নামাজ পড়তেন না, এমনকি জুমার নামাজে যেতেন না। (এরা ছিলেন সম্ভবত মুনাফিক/মিশকাত)। এই বাস্তবতাকে উদ্দেশ্য করে রাসূলকে (সা.) বলতে হয়েছিল, ‘আমার ইচ্ছে হয় আমি যেন অন্য কাউকে নামাজ পড়াতে নির্দেশ করি আর, যারা জুমুয়ায় উপস্থিত হয় নি, আমি গিয়ে ওদের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেই,’ (আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ/মুসলিম, নোট ২ )। এমন তাম্বিহ আরও অনেক ক্ষেত্রে এসেছে। ‘সাহাবী’ কথাটিতে দুই ধরনের ধারণা রয়েছে -একটি আম ও অপরটি খাছ। খাছ হচ্ছেন নবীর (সা.) সেই সব সঙ্গি-সাথী, যারা তাঁর একান্ত সুহবত লাভ করেছিলেন, জীবনে-মরণে তাঁর সঙ্গি ছিলেন, যারা মুজতাহিদ ও ফক্বীহ ছিলেন। ‘আমার সাহাবীরা আকাশের তারকার মত, তোমরা যারই অনুগমন করবে, হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে’ –এই হাদিসটি যদি সহীহ হওয়ার নিকটবর্তীও হয় তবে এর মর্মার্থে হয়ে থাকবে দ্বিতীয় অর্থের সাহাবীগণ। ওমরের (রা.) সময়েও মদ পাওয়া হত এবং খাওয়া হত বলেই তিনি মদ্যপানের শাস্তি ৪০ বেত্রাঘাত থেকে ৮০ বেত্রাঘাত করেন। (‘সাহাবী’ বিষয়ে মৎপ্রণীত একটি ছোট প্রবন্ধ এখানে পড়া যেতে পারে

বিষয়: বিবিধ

১৪৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File