বৈধ (রাজ)নীতি: সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ -পর্ব ১-

লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ১০ অক্টোবর, ২০১৩, ০২:১৫:৪৭ রাত

সংশ্লিষ্ট লেখা

(১) ইসলামের রাজনীতি: শাব্দিক উৎস ও ধারণা

(২) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিবন্ধক যুক্তি

(৩) কাল সাগরের ঢেউ (মন্তব্যসহ পড়বেন)

ভূমিকা

এই প্রবন্ধে, ‘ভাল কাজের সম্প্রসারণ ও মন্দ কর্মের অপসারণ কল্পে’ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার নীতি নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু আলোচনা করা হবে। এতে থাকবে শাব্দিক ও পারিভাষিক ব্যাখ্যা, কোরান ও সুন্নাতে এর অনুমোদন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ (উলুল আমর) এই নীতি কীভাবে ব্যবহারের অধিকার রাখেন -তা নিয়ে আলোচনা।

সামাজিক জীবনের নিরাপত্তা বিধান ও সামাজিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় উলুল আমরদের ভূমিকা এবং স্থান, কাল ও সমস্যার প্রেক্ষিত বিবেচনায় আইনের প্রয়োগ ও শাসনের রূপ নির্ধারণ এবং সমাজের সার্বিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহর স্থানও আলোচিত হবে।

অনেকের ধারণা যে কোরানে যে সংখ্যক আইনী আয়াত রয়েছে সেগুলো দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হবে? কিন্তু ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় যে ডাইনামিজম (dynamism) কাজ করে সেই প্রেক্ষিতে পদে পদে আইন জারির প্রয়োজন হয় না। পরিবর্তে, বিজ্ঞ কাজীর আইনী বিবেচনা ও শাসকের প্রজ্ঞাপ্রসূত আইনী পদক্ষেপ সামাজিক অনেক সমস্যার সমাধানে এবং একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কার্যকরি ভূমিকা রাখে। সামাজিক দুর্নীতি ও অবক্ষয় প্রতিরোধ করতে এবং নৈতিক ভিত্তিতে সামাজিক ব্যবস্থাপনা, সমাজিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক সাংস্কৃতি গড়ে তুলতে সিয়াসা শারয়্যিয়াহ মৌলিক এবং ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার উদ্দেশ্য, এর বিভিন্ন প্রেক্ষিতগত ধারণা এবং এক্ষেত্রে প্রাথমিক যুগের কিছু উদাহরণও আলোচনা করা হবে। শেষের দিকে আজকের সামাজিক পরিস্থিতির মোকাবেলায়, বিকল্প হিসেবে, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বিবেচনা করার আহবান করা হবে।

সার্বিকভাবে, সিয়াসাহ শারয়্যিয়ার অঙ্গনে এই প্রবন্ধটি যদি কিছু উৎসাহ সঞ্চার করে তবে আশা করা যায় অন্যরাও লিখতে আগ্রহী হবেন। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বাংলায় লেখা খুব কমই অনুভূত হয় এবং বাংলা নেটে কিছু দেখেছি বলে মনে হয় না, তাই লেখাটি সামান্য হলেও ক্ষুদ্র কিছু অবদান রাখবে বলে আশা করি। সকল বিদ্যায় যেমন, তেমনি এই বিদ্যায়ও উলামাদের চিন্তার কিছু দ্বিমত রয়েছে। এই লেখাটির বিভিন্ন ফাঁকে কিছু দ্বিমতকেও স্থান দেয়ার চেষ্টা করা হবে।

লেখাটি প্রথমে সদালাপ নামক একটি ব্লগে প্রকাশ করি। যেহেতু দীর্ঘ লেখা, তাই এটাকে কয়েকটি পর্বে এখানে দেবার চেষ্টা করব।

শাব্দিক অর্থ ও কোরান-সুন্নাহ

শাব্দিক অর্থে সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ হচ্ছে শারিয়াহ (আইন) অনুমোদিত বা শারিয়ার সাথে সামঞ্জস্যশীল ব্যবস্থা। এটা শাসন ও সামাজিক সুব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যার সমাধান-কল্পে শাসকদের গৃহীত নীতি ও পলিসির সাথে জড়িত। শাসন কার্যের মত সামাজিক ‘রাখালিতে’ অনেক ধরণের ডিসিপ্লিনের সমন্বয় ঘটতে হয় এবং এতে স্থান, কাল ও উপযোগিতা অনুধাবন করে রাষ্ট্র কার্য পরিচালনা করতে হয়। কোন রাখালের হাতে একখানা বই দিয়ে আক্ষরিক অর্থ খুঁজে খুঁজে রাখালির দায়িত্ব দিলে তার পক্ষে সেই কাজের সুষ্ঠু আঞ্জাম দেয়া সম্ভব হবে না। ‘রাখাল’ এর অবস্থান থাকতেই হবে। আল্লাহ শুধু কোরান নাজিল করেননি, তিনি একজন রাসূলও পাঠিয়েছেন যাতে করে তিনি অবস্থার প্রেক্ষিত অনুভব করে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন, উদ্ভূত জটিলতায় প্রজ্ঞা-প্রসূত নীতি প্রয়োগ করে সমাধান আনতে পারেন। রাসূলের পরে সেই ধারাবাহিক দায়িত্বে আসেন উলুল আমর বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ।

ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের আনুগত্যের কথা কোরানে আছে, নবীর (সা.) নির্দেশেও আছে। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তাদের। (৪:৫৯)

ইসলাম যেহেতু একই সাথে দ্বীন (ধর্ম) ও দাওলাহ (রাষ্ট্র) এবং নবীর পরে যেহেতু আর কোন নবী নেই তাই আনুগত্যের ধারাবাহিকতা অপরিহার্য। না হলে অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক পরিস্থিতিতে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন ফাসাদ হাজির হবে এবং অরাজতা, দুর্নীতি ও নৈতিক বিপর্যয় সামাজিক জীবন বিপন্ন করে দেবে। আনুগত্যের ধারা তাই পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত।

ইসলামী ব্যবস্থায় আনুগত্য হয় কেবল ভাল কাজের। মন্দ কাজে আনুগত্য নেই। আল্লাহ ও তার রাসূলের বিপক্ষেও আনুগত্য নেই। আবার আনুগত্যের ধারাবাহিকতার বাইরে সমাজিক ব্যবস্থার ধারণা নেই, দ্বীনের এহসাস নেই। রাসূল্লাহ (সা.) বলেন, যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। যে আমাকে অমান্য করল, সে আল্লাহকে অমান্য করল। যে আমীরের আনুগত্য করল, সে আমার আনুগত্য করল। যে আমীরকে অমান্য করল সে আমাকে অমান্য করল (আবিল ইজ্জ আল-হানাফি/শারহ আক্বীদাহ তাহায়ীয়্যাহ)। তিনি আরও বলেন, কেউ যদি আমীরের মধ্যে মন্দ কিছু দেখে তবে সে যেন ধৈর্য ধারণ করে। কেননা যে ব্যক্তি জামাত থেকে এক হাত সরে পড়ল (অর্থাৎ জামাত থেকে বেরিয়ে গেল) তারপর সে মারা গেল, তার মৃত্যু জাহেলিয়াতের উপরই হল (ইবন আব্বাস [রা.], প্রাগুক্ত)। অন্য রেওয়াতে এসেছে, সে যেন ইসলামের রজ্জু তার গলদেশ থেকে খুলে ফেলল (প্রাগুক্ত)। তিনি বলেন, যখন দুইজন খলিফার হাতে আনুগত্যের বাইয়াৎ এসে যায় (অর্থাৎ যখন এক ব্যক্তির পরে আরেক ব্যক্তি বাইয়াৎ নেয়া শুরু করে) তখন দ্বিতীয়জনকে হত্যা কর (প্রাগুক্ত)। এগুলোতে বুঝা যায় দ্বীনের পথে আনুগত্য ও শৃঙ্খলার বিষয় কী পরিমান গুরুত্বের স্থান পেয়েছে। কেবল সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে (সুনীতি প্রতিষ্ঠা হলে), যা ভাল, তার বিকাশের পথ উন্মুক্ত হতে পারে এবং মন্দ পথের ধারার প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে।

ইসলামী সিয়াসাহ (রাজনীতি) সমাজ জীবনের যে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবনের নিরাপত্তা (মানসিক জীবনসহ); ধর্মের নিরাপত্তা; নসবের নিরাপত্তা (অবৈধ শারিরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নসব নষ্ট হওয়া থেকে পরিবার পরিজনকে রক্ষা করা) এবং সম্পদের নিরাপত্তা। এগুলো ইসলামী আইনেরও (শারিয়ার) প্রধান আলোচ্য বিষয়। এই নিরাপত্তাগুলোই গড়ে তুলে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক ভিত্তি। সুতরাং এই মৌলিক ভিত্তির সংরক্ষণ হতে হবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, না হলে ফাসাদ ও দুর্নীতির সয়লাব ঘটবে। ভাল কাজের সম্প্রসারণ, নির্দেশনা ও তার উৎকর্ষ সাধন এবং মন্দের প্রতিহতি, অপসারণ ও নিষিদ্ধ করণ (৩:১১০) ব্যতীত সমাজে সুফল আসতে পারে না। তাই উল্লেখিত দায়িত্বসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্র প্রথমে ব্যক্তি থেকে শুরু হলেও রাষ্ট্রই মূলত এই দায়িত্বপালনের প্রধান এজেন্সি বিবেচিত হয়।

নৈতিক ভিত্তিতে চালিত সমাজ ব্যবস্থার দাবি হয় যে যারা এই ব্যবস্থার পরিচালনা পর্যায়ে উপবিষ্ট হবেন তারা খোদাভীরু হতে হবে; সামাজিক অধিকার, ব্যবস্থাপনা ও আইন (শরিয়াহ) সম্পর্কে সম্যক অবগত হতে হবে; বিশেষ করে রাষ্ট্র প্রধান অবশ্যই একজন মুজতাহিদের মত শারিয়া অভিজ্ঞ হতে হবে। কিন্তু কোনো মুসলিম সমাজ ব্যবস্থা যখন গায়ের জোরে দখল করে নেয়া হয়, তখন এসব শর্ত আরোপ অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদার পর রাষ্ট্র ব্যবস্থা যখন রাজকীয় হয়ে পড়ে তখন শাসকদের ইসলামী জ্ঞানের মাত্রায় অনেক আপোষ আসে এবং ক্ষেত্র বিশেষে আপোষের কোনো স্থানও বাকি থাকেনি। তবে একথাও সত্য যে অনেক শাসক রাজা হলেও বিপুল ইসলামী জ্ঞান রাখতেন এবং ইসলামী আইন (শরিয়া) মুসলিম সমাজে বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এমনকি এর প্রথম দুই দশক পর্যন্ত, পুরাপুরি না হলেও, সব সময়ই জারি ছিল এবং সামাজিক পরিবর্তনের নানান ডাইনামিজমের (dynamism) সাথে সাথে ইসলামী শাসন ব্যবস্থাও উৎকর্ষ লাভ করতে থাকে। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পেনীর বিজয়ের প্রায় অর্ধশতক পরও অর্থাৎ আটারোশো শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইসলামী শারিয়া প্রচলিত ছিল। ওসমান সাম্রাজ্য ১৯২২ সালে ভেঙ্গে দেয়ার আগ পর্যন্ত শরিয়া ব্যবস্থা জারি ছিল। তাই নৈতিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ধারা কোনো ‘সেকেলে, ক্লাসিক্যাল’ আমলের বিষয় নয়, যেটা সেক্যুলার আদর্শের লোকজন না বুঝে বলে থাকেন। আবার এই বাস্তবতাও লক্ষণীয় যে খোলাফায়ে রাশেদার পতনের পর থেকে খিলাফত আলা মিনহাজ আন-নব্যুয়াহ, নবী-চালিত রাষ্ট্রের নমুনা মোতাবেক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জারি থাকে এবং তা আজও চলছে এবং এর উপর গবেষণা, অধ্যয়ন ও চিন্তার উপস্থাপনা সব সময়ই অক্লান্ত ধারায় বিকাশ লাভ করে আসছে।

বিষয়: বিবিধ

১৫৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File