ইসলামের রাজনীতি: শাব্দিক উৎস ও ধারণা
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ২৯ আগস্ট, ২০১৩, ০৪:৪৯:২৫ রাত
রাজনীতির আরবি শব্দ 'সিয়াসাহ'। আমরা শব্দটির উৎস, অর্থ ও সংশ্লিষ্ট ধারণা নিয়ে কিছু আলচনা করতে যাচ্ছি।
আরবি ‘সিয়াসাহ’ শব্দ সাসা/ইয়াসুসু (ساس/يسوس) ক্রিয়াপদ (verb) থেকে উৎসারিত। শব্দগুলোর ধাতুগত উৎস ও প্রাচীন ব্যবহারিক স্থান হচ্ছে ঘোড়ার প্রতিপালন, ব্যবস্থাপনা (husbandry) ও প্রশিক্ষণ (training)। এই স্থান থেকে সিয়াসাহ উপমা হিসেবে এসে কালের সুদীর্ঘ যাত্রায় কোথাও তার উপমার স্মৃতি লয়-প্রাপ্ত হয়েছে। তবে সিয়াসার উপমা অতি-প্রাচীন আরবি নয়। [১] কেননা ঘোড়া প্রাচীন আরবের জন্তু নয়, যদিও নবীর জন্মের হাজার খানেক বৎসর আগ থেকে তার প্রচলন হয়। আরব অঞ্চল প্লেইস্টোসিন (Pleistocene: ২.৬ মিলিয়ন বৎসর থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগ পর্যন্ত সময়) কালের কোন এক পর্যায়ে মরুভূমিতে পর্যবেশিত যাওয়ার এক সুদীর্ঘ কাল পরে অর্থাৎ প্লেইস্টোসিন সময়ের শেষের দিকে, প্রায় ৩৫ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলে উট ও খেজুরের আবির্ভাবের কারণে মানব বসতির উপযোগী স্থানে রূপান্তরিত হয়। খেজুর ও উট এই দুই উপাদান এমন যে এগুলোর উপর ভিত্তি করে স্বয়ং-সম্পূর্ণ (independently) জীবন ধারণ সম্ভব হয় (মু’নিস, ২০০২:২৩)। আদম সন্তানের যে অংশটি এই উপাদানগুলোর ভিত্তিতে পূণরায় বিভিন্ন মরুকিনারায় ও উপযোগী অভ্যন্তরে জীবন গড়তে শুরু করেন এবং যাদের নাম কালের এক দীর্ঘ পরিসরে ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায় হলেন ঐতিহাসিক ‘আল-আরাব আল-বায়িদাহ’ (বিলুপ্ত আরব) যেমন প্রথম-আদ, থসম, জিদ্দিস, উমাইম, ইরাম, আসহাবুল আইকাহ, আহলুস রাসসি ইত্যাদি। মু’নিসের ধারণায় নূহের (আ.) তুফান ঐ আসে ঐতিহাসিক কালের শেষ প্রান্তে। এই বিষয়ের ঐতিহাসিকতা নিয়ে অন্য কোন দিন হয়ত লিখব।
মরুর যে কঠোর পরিবেশ এবং সেখানে যে ধরণের কাঁটাযুক্ত উঁচু উঁচু গাছপালা জন্মে তা দিয়ে অপরাপর অনেক জন্তু জানোয়ারের জীবন ধারণ সহজ ছিল না। কেবল উটই তা খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারত। উট অত্যন্ত সহিষ্ণু প্রাণী এবং সে যে কেবল মরুতে বিচরণই করতে পারে তা নয় বরং প্রায় ১৭ দিনের পানির সাপ্লাই তার দেহে আত্মিভূত (absorb) করে রাখতে পারে। উট অত্যন্ত লাজুক ও ভীতু প্রাণী। উঠের লোমসহ তার প্রতিটি বস্তু যেমন জীবন ধারণের সহায়ক, তেমনি খেজুর ও খেজুর বৃক্ষ। এগুলোর সবকিছু জীবন ধারণের উপযোগী এবং এই দুয়ের পারস্পারিক সমন্বয়ই মানুষের জীবন-ধারণকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে তোলে।
উটের সাথে পাহাড়-পাদদেশে কিছু ভেড়ির বিচরণও আসে এবং মানব বসতির সাথে সাথে ভেড়ির এবং অপরাপর কিছু প্রাণীর পোষণ (domestication) শুরু হয়। নবীর (স.) সময় পর্যন্ত ঘোড়া, ভেড়ি ও উট পাওয়া গেলেও, ঘোড়া ছিল ধনী শ্রেণীর এবং বিশেষ করে যোদ্ধাদের ব্যবহৃত প্রাণী। ভেড়ি আর উট ধনীদের অধিকারে থাকলেও সেগুলো সর্বসাধারণের অধিকারেও ছিল। আরবদের রাখালি উপমা তাই সর্বসাধারণের পালিত জন্তু থেকেই আসে।
ভেড়ি ও উটের চারণ-কর্মের প্রধান শব্দাবলী হয় রা’আ/ইয়ারআ (رعي/ يرعي), রায়্যিয়াহ অর্থাৎ রাখালি করা, এবং যে ব্যক্তি এই কাজ করে সে হয় রাইন (راع) বা রাখাল (shepherd)। আমরা যে জন্তুগুলোর কথা বলছি সেগুলো দলীয় প্রাণী। প্রকৃতি জগতে ঘোড়া-পাল ও উট-পালের সর্দার হয়; একটা জন্তু নেতৃত্ব দেয়। কখনো কোনো জন্তু দলীয় আচরণ লঙ্গণ করলে তাকে লাথি দিয়ে বের করা হয়। তারপর সে ফিরে এসে বশীভূত আচরণ দেখালে আবার দলে স্থান দেয়া হয়। মানুষ এগুলো প্রকৃতি জগতে অবলোকন করেছে। তারপর তাদের নিজেরদের স্বার্থে যখন এই ধরণের জন্তুর রাখালি শুরু করেছে তখন রাখালের উপর প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত এবং নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক দায়িত্ব সংযোজিত হয়। রাখাল তার দায়িত্বে ব্যর্থ হলে জন্তুগুলোর ক্ষতি হয়। এখান থেকেই আরবরা তাদের দায়িত্বের সমঝ গ্রহণ করে। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, ‘কুল্লুকুম রায়িন ও কুল্লুকুম মাসউল আন রায়্যিয়াতিহি, (كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته ) তোমারা প্রত্যেকই রাখাল (অর্থাৎ নিজ নিজ পরিসরে দায়িত্বশীল, নেতা) এবং প্রত্যেককেই তার রাখালির (দায়িত্বের) ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ রাখালের কাজ হচ্ছে তার দায়িত্বের আঞ্জাম দেয়া। এক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের (সা.) আরও অনেক কথা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘জনগণের নেতা (কাওম-প্রধান) তাদেরই খাদেম (ভৃত্য/সেবক), (سَيِّدُ الْقَوْمِ خَادِمُهُمْ)’। রাখালের দায়িত্ব উট বা ভেড়ি পেটানো নয়, ওদের পরিচর্যা করা, হেফাজত করা। একটু গভীরে নজর দিলে দেখা যাবে এই পরিসরের বাদবাকি দায়িত্বসমূহ কী। সেখানে পাওয়া যাবে এডমিনিস্ট্রেশন; পরিকল্পনা; মাসলাহাত এবং আস্তে আস্তে অপরাপর অনেক দায়িত্বের দিগ্বিদিক।
কোরানে সিয়াসাহ শব্দের ব্যবহার আসেনি কিন্তু আরব সমাজে এই শব্দের ব্যবহার ছিল। যেমন বলা হয় وسَوَّسَه القومُ: جَعَلوه يَسُوسُهم. সাওয়াসাহুল কাওমু অর্থাৎ গোত্র (কাওম) তাকে সিয়াসাতের দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের বিষয়-আশয় পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। سُوِّسَ فلانٌ أَمرَ بني فلان أَي كُلِّف سِياستهم. অমুক ব্যক্তিকে অমুক গোত্রের ব্যবস্থা পরিচালনার ‘সাইস’ করা হয়েছে, অর্থাৎ তাদের সিয়াসাতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের পরিচালক করা হয়েছে। (লিসানুল আরব) হাদিসে এই শব্দটির ব্যবহার আছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘বনি ইসরাইলের নবীগণ তাদের নেতৃত্ব (تسوسهم الأنبياء) দিতেন, (তাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতেন), এক নবীর ওফাত হলে তার স্থলে আরেক নবী আসতেন। কিন্তু আমার পরে আর কোনো নবী নেই’ (বোখারি/মুসলিম)।
আরবের নবীরা রাখালি করেছেন এবং সেখানে প্রকৃতিতে তাঁরা প্রাণীর বিভিন্ন আচরণ নীরবে এবং একান্তে লক্ষ্য করেছেন, এদের নানান আচরণ সহ্য করেছেন, এদের হেফাজত করেছেন, দায়িত্ব বহন করেছেন। তাই এই পরিসর থেকে, এই অবর্ধিত প্রাথমিক (rudimentary) লেভেল থেকে, নগরজীবন ও রাষ্ট্রের রাখালি করার ধারণা ভাল করে অনুধাবন করেছেন।
সিয়াসার তাৎপর্য
সিয়াসাহ হচ্ছে এমন পরিচালনা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে জনগণকে তাদের স্বার্থে ও কল্যাণে পরিচালনা করা হয় (নাজ্জার, ১৯৮৪:৯২)। শাব্দিক অর্থের ব্যাখ্যায় উইলিয়াম লেন (১৯৬৯) বলেন, ‘siyasa (سياسة) signifies the managing a thing (قيام على شيء) in such a manner as to put it in a right, or proper state –অর্থাৎ ‘সিয়াসাহ’ কোনো জিনিসকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা বুঝায় যাতে করে তা আইনানুগ, সৎ, সঠিক ও মানানসই দেখায়।’ শাব্দিক অর্থে সিয়াসা পলিসি অর্থেও ব্যবহৃত হয়, যেমন সিয়াসাতুল মাল বা অর্থনৈতিক পলিসি। সিয়াসাতুল জাইশ, মিলিটারি পলিসি ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এডমিনিস্ট্রেশনও সিয়াসাহ। ইসলামের সিয়াসার ধারণায় কিতাব ও সুন্নাহর তাৎপর্য নিহিত থাকে। এই সিয়াসার মাধ্যমে দ্বীন ও দুনিয়ার হেফাজত আসে।
ইমাম গাজ্জালীর (র.) মতে ধর্মীয় জ্ঞানের বাইরে কোন সিয়াসাহ নেই, (অর্থাৎ এর বৈধতা নেই)। তিনি ধর্ম-জ্ঞানকে দুইভাগে ভাগ করেন। প্রথম ভাগ হচ্ছে দুনিয়ার সাথে জড়িত জ্ঞান। দ্বিতীয়টি আখেরাতের সাথে জড়িত জ্ঞান। উভয় জ্ঞানই পরস্পরের সম্পূরক –উভয় জ্ঞানের উদ্দেশ্য শেষ বেলায় একই কেন্দ্রে ধাবিত হয়। এখানেই আসে ইসলামের সিয়াসাহ ও ফিকহের আলোচনার স্থান, যা দুনিয়ার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, এবং যা মানুষের কাজ-কর্ম ও দায়িত্বকে আল্লাহর সাথে, সমাজের সাথে, তার নিজের সত্তার সাথে সংযুক্ত করে। এই সিয়াসাহ দুনিয়ার জীবনের স্থিতি ও উন্নতি দানে সহায়ক হয় এবং পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করে। এখানে বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক বিষয়, (দ্বীন ও দুনিয়া), ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইমাম শাফেয়ী বলেন, শারহের সাথে সামঞ্জস্যহীন হয়ে কোন সিয়াসাহ হতে পারে না। শরিয়ার বাইরের সিয়াসাকে ফাসাদ হিসেবে দেখা হয় (নাজ্জার, ১৯৮৪)।
আমরা এখানে যা পাচ্ছি তা হল সিয়াসা ইসলাম বহির্ভূত কোনো জিনিস নয়। সিয়াসা রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে জড়িত বিষয়। ফকিহগণদের (আইনবিদ) কাছে ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আসে আল্লাহর ইচ্ছার (তার আদেশ নিষেধের) বাস্তবায়ন ঘটানোর ‘মাধ্যম’ হিসেবে। আল্লাহর আইন, তাঁর হুদুদ ইত্যাদি অর্থবহ হয় না যদি সেগুলো বাস্তবায়নের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা না থাকে, যদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদি, শিক্ষা, বিচার ও আচার-আচরণ সেই ক্ষমতার আওতাভুক্ত না হয়। ইসলাম হচ্ছে একটি ধর্ম এবং রাষ্ট্র (Islam is a religion and a state)। এর একটি অপরটি থেকে আলাদা করা অকল্পনীয়। মানুষের জীবন ও তার কর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর মহিমা কীর্তন করা। নাজ্জার (১৯৮৪:১০১) বলেন যে এই ধারণাটি ইবন তাইমিয়ার বর্ণনার চেয়ে অন্য কোথাও অধিক সুচারুরূপে ব্যক্ত হয়নি। তিনি কথাটি এভাবে উদ্ধৃত করেন, It is a duty to consider governorship (imara) as an act of religion, and as one of the acts by which man draws near God; for to draw near God through the exercise of power, i.e., by obeying Him and His Apostle, is the most excellent form of drawing near God. তাইমিয়াহ বলেন, ইমারাহ (إمارة) বা রাষ্ট্রপরিচালনার কাজকে ধর্মীয় কাজ বিবেচনা করা একটি ‘কর্তব্য’ বা বাধ্যবাধকতা (duty)। এটি এমনই এক কাজ যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিকটবর্তী হয়, কেননা ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া, (যেমন এক্ষেত্রে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্যলাভের), অতি উন্নতমানের এক অবলম্বন’ (প্রাগুক্ত)।
সিয়াসাকে ইবন কাইয়্যিম দুইভাগে ভাগ করেন: সিয়াসাহ জালিমাহ (জালিম সিয়াসাহ) এবং সিয়াসাহ আদিলাহ (ন্যায়পরায়ণ সিয়াসাহ)। প্রথমটি ইসলামী শারীয়ায় অবৈধ এবং দ্বিতীয়টি ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহৃত হয় (কামালী, ১৯৮৯:৬১)। ইসলামী সাহিত্যে, বিশেষ করে ইসলামী আইনে দ্বিতীয়কে সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ (السياسة الشرعية-শরিয়া-সম্মত সিয়াসাহ) বলে আখ্যায়িত করা হয়। আমার পরের লেখায় সিয়াসাহ শারয়্যিয়াহ ও দ্বীন ও রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা করা হবে, ইনশাল্লাহ।
References
(1). Kamali, M. S. (1989). Siyasah Shariyah or the Policies of Islamic Government. The American Journal of Islamic Social Sciences, Vol. 6, (1989), 59-81. Available at http://www.hashimkamali.com/index.php/publications/item/44-siyasah-sharciyyah-or-the-policies-of-islamic-government
(2). Lane, E. W. (1968). An Arabic English Lexicon, Vol.7 Beirut: Librairie Du Liban
(3) Mu’nis, H. (2002). Tarikh Quraish, Dar al Manahil: (city/country not printed).
(4) Najjar, F. M. (1984). Siyasa in Islamic Political Philosophy. In: Marmura, M. E. Islamic theology and Phylosophy. New York: State University of New York. p92-110.
(6) Ibn Manzur () Lisān al-ʿArab. [Online Dictionary] Available at: http://www.baheth.info/index.jsp
নোট: [১] আমরা এখানে ‘আরবী’ কথাটি আরবী ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছি। প্রমিত আরবী ভাষা রাসূলুল্লাহর সময় পর্যন্ত দেড় শো দুই শো বছরের ব্য়সে ছিল।
বিষয়: বিবিধ
১৫৪২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন