শবে বরাতের পক্ষে -পর্ব ২/২
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ১৪ জুন, ২০১৩, ০৮:৫৭:৫৬ রাত
প্রথম পর্ব এখানে আমরা প্রথম পর্বে যে কয়টি হাদিসের উল্লেখ করেছি সেখানে জাল হাদিসের বিষয় নেই বরং সেগুলো স্পষ্টভাবে মধ্য শাবানের রাতের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে; সেগুলো আল্লাহর মার্জনার কথা বলে, আর মানুষের পাপ-জীবন থেকে মুক্তি লাভের সুযোগের কথা বলে -এগুলো ধর্ম জীবনের মূল বিষয়। এগুলোর সাথে বিশ্বাসের সম্পর্ক সুনিবিড়। এবারে আমরা বিষয়টিকে অন্য আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে যাব।
স্থান ও কালীন মহিমা, গুরুত্ব ও পবিত্রতা
ধর্মের অনেক বিষয় স্থান ও কালের পবিত্রতা ও গুরুত্বের সাথে সম্পর্কিত। বিশ্বাসেই এমনসব ধারণা নিয়ন্ত্রিত হয়। একটু বর্ধিত অর্থে দেখতে গেলে স্থান ও কালের পবিত্রতা সম্বলিত ধারণা সকল ধর্মেই পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মে পাবেন গয়া ও কাশী, আমাদের ধর্মে পাবেন মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেম, অন্যান্য ধর্মের অন্যান্য স্থান। মসজিদ পবিত্র, মন্দির পবিত্র, গির্জা পবিত্র –এগুলো স্থানের পবিত্রতা নির্দেশ করে। দিন ও কালের মধ্যে আছে আমাদের শুক্রবার, ইয়াহুদীদের শনিবার ও খৃষ্ট-ধর্মে রবিবার। কিন্তু এই স্থান কালের পরিধীর ভিতরেও আছে পবিত্রতার অনন্য স্থর, যাকে অন্তঃবৃত্তও বলতে পারেন। মক্কা শহরের এক বড় পরিধি হচ্ছে হারাম। তার ভিতরে অবস্থিত আল্লাহর ঘর, পবিত্র ‘কাবাহ’। এভাবে সকল মাসের মধ্যে আছে সর্বাধিক পবিত্র মাস: রমজান মাস। কিন্তু তার ভিতরের শেষ দশদিন হচ্ছে সর্বাধিক উত্তম। কিন্তু এই দশ দিনের ভিতরেও রয়েছে একটি বিশেষ রাত, ক্বদরের রাত। এই রাতটি শেষ দশ দিনের বেজোড় তারিখে ধরা হলেও সাতাইশের রাতই অতি পবিত্র, হাজার মাসের চেয়েও উত্তম মানা হয়।
শাবান ও তার মধ্য রাত
মাস হিসেবে শাবান মাসের মহিমা সহীহ হাদিসে প্রতিষ্ঠিত। এই মাসের ব্যাপারে যদি দ্বিমত না থাকে, তাহলে আমরা আসতে পারি তার অন্তঃবৃত্তে। এর মধ্যে কী কোন বিশেষ মর্যাদাবান সময় থাকতে পারে যেমনটি ধর্মীয় অপরাপর স্থান ও কালে পাওয়া যায়? যদি অপরাপর নিয়মের সাথে এর সঙ্গতি থেকে থাকে, তাহলে বিতর্কের স্থান কমে আসে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে আমরা মূলনীতির সাথে শুধু সঙ্গতিই পাচ্ছি না, বরং মধ্য শাবানের রাত সম্পর্কে অনেক হাদিসের বর্ণনাও পাচ্ছি। এই বর্ণনা মাত্র একটি বা দুইটি নয়, বরং অনেক। ব্যাপক বর্ণনার কারণে অনেক বড় বড় মুহাদ্দিসও, ইবন তাইমিয়্যাসহ, শবে বরাতের মর্যাদা ও মহিমার কথা আমলে নিয়েছেন।
অন্যান্য পবিত্র স্থান ও কালের মত এখানকার অন্তঃবৃত্তের কাল নিয়ে যা বলা হয়েছে, তা ইসলাম ধর্মের মূল বাণীর সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিশীল। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দিতে ও তাদের উপর রহমত দান করতে অনেক ধরণের সুযোগ দিয়ে থাকেন। এমন নানান সুযোগের মধ্যে এই রাতটিও একটি।
ধর্মে স্থান ও কালের মহিমা এবং পবিত্রতা মানুষেরই জন্য, আল্লাহর নিজের জন্য নয়। স্থান, কাল ও দিবসের সাথে সম্পর্কিত পবিত্রতার যে বিষয় রয়েছে সেই পবিত্রতার বেশি বেশি যৌক্তিকতা আরোপণ ও একটি পবিত্র অবস্থার সাথে অন্য পবিত্রতার চুলছেড়া যুক্তি, পার্থক্যের নানান প্যাচ সৃষ্টি ইত্যাদিতে ধমীয় কাজ-কর্মের খুব একটা লাভ সাধিত হয় না। বরং বিতর্কের দুয়ার খোলে দিতে থাকলে এর শেষ মাত্রা মন্দের দিকেই যাবে। ধরুন শুক্রবার হচ্ছে সাত দিনের একটি দিন । এটি সোমবার থেকে ভাল হবে কেন? একান্তভাবে, তা কোন যুক্তির কোন বিবেচনায় হবে? রাতের শেষ অংশ প্রথম অংশ থেকে ভাল হবে কেন? এসব ক্ষেত্রে বিতর্ক ও অত্যাধিক যুক্তি সরিয়ে রাখলে আমরা যা পাই তা হল আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদেরকে এভাবে বলেছেন -এতটুকুই। আল্লাহ আমাদেরকে পুণ্য-ধারণায় এবং পুণ্য পথে চলার এক মাধ্যম হিসেবে অনেক বিষয়ে পবিত্রতার স্বীকৃতি দিয়েছেন যাতে করে আমরা তার ইবাদত করে পূণ্য অর্জন করতে পারি। পূণ্যের ধারণা আমাদের পূণ্য জীবনের সম্পূরক হয়। এজন্য আল্লাহ স্থান-কালের সাথে পবিত্রতার মূল্য সংযোজন করেছেন। তার এগুলোতে মূল্যের স্বীকৃতি দানের কারণেই এগুলো আমাদের কাছে মূল্যবান হয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে অনেক রূপক কথা বলেন, আমরা সেগুলোকেও বিশ্বাসে ধারণ করি এবং আমল করি। এসব কাজে বেশি বেশি যুক্তি চালাতে নেই। না হলে বাছতে বাছতে কম্বল খালি হয়ে যেতে পারে।
আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং তার বান্দাদের আর্জি শুনেন, তাদেরকে দোয়া করতে আহবান করেন, তাদের মাগফিরাতের কথা বলেন। কিন্তু যুক্তির বিচারে তিনি তো সব সময়ই দুনিয়ার আকাশে থাকার কথা। বাংলাদেশের ভরা-দুপুরে অন্য দেশে যখন শেষ রাত্র, তখনও তো তিনি দুনিয়ার আকাশে আছেন। এসব হচ্ছে রূপক কথা। এসব কথায় আমাদের রূহানিজাত ও মানসিক তায়াজ্জুহের বিষয় বিশ্বাসের মাধ্যমে বহন করা হয়। আধ্যাত্মিক পথ ও পুণ্য জীবনের ব্যবস্থাপনায় বছর, মাস, দিন ইত্যাদিকে এবং বিভিন্ন স্থানকে আল্লাহ আমাদের জন্য সাজিয়ে দিয়েছেন। আমাদের মতো পাগল-ছাগলদেরকে মাফ করে দেয়ার বিভিন্ন জরিয়া সৃষ্টি করেছেন, যাতে পরিত্রাণের আশায় তার দিকে রুজু হই এবং আমাদের মনের জগতে এই ধারণায় উপনীত হই যে 'আমরা মার্জিত হয়ে গেয়েছি, পুণ্য লাভ করেছি’ -এমন ভাবধারা আমাদের মনের সুস্থতার বিকাশ করে। এসব জরিয়ার মধ্যে শাবানের রাতটি এক মহিমাময় রাত, এক ফজিলতের রাত। এটা আমরা বিশ্বাস করি।
কোরানের ইঙ্গিত, মহিমাময় রাত
এবারে কোরান থেকে এই বিষয়ে কিছু বলা যাবে কী যাবে না –তা দেখা যেতে পারে। কোরানে ব্যবহৃত “লাইলাতুল মোবারাকাহ” বাক্যাংশটি অনেকে উল্লেখ করেন। এই বাক্যাংশটি সূরাহ দোখানে এভাবে এসেছে, إِنَّآ أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ -আমরা এই কোরানকে এক মহিমাময় (বরকতময়) রাতে নাজিল করেছি। আমরা অবশ্যই সতর্কদান করি (৪৪:৩)।
এখানে উল্লেখিত আয়াতটি শবে ক্বদর হিসেবে আমরা জানি। তবে যারা আয়াতটির অর্থধারাকে শবে বরাতেও প্রসারিত করেন, তাদের ব্যাখ্যাও শুনতে পারি। এই ব্যাখ্যা-ধারার তারতিব (ক্রম) হচ্ছে এই যে মধ্য শাবানের রাতে গোটা কোরান বাইতুল মা’মুর থেকে দুনিয়ার আসমানে আসে এবং এতে এক কালীন গুরুত্ব প্রকাশ পায়। তারপর, লাইলাতুল ক্বদরের রাতে, খণ্ডাকারে, প্রথম অংশ নাজিল হয় এবং তাৎপর্যের দিক দিয়ে এটাই বৃহত্তর এবং মূল তাঞ্জীল। ঐ রাতেই (অর্থাৎ শবে ক্বদরের রাতে) আল্লাহর নির্দেশে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আর এভাবেই তাঁরা এই দুই রাত কেন্দ্রিক বর্ণনার সমন্বয় দেখেন।
কয়েকজন তফসীরকারের কথা
আল-কুশাইরী (মৃ. ৪৬৫ হি.) তাঁর তফসীর, ‘লাতাইফুল ইশারাত’-এ বলেন, শ’বে ক্বদরের রাতকে ‘লাইলাতুল মুবারাকাহ’ বলা হয় আবার শা’বানের ১৫তম রাত্রিকেও বলা হয়। ইবন উজাইবাহ (মৃ. ১২২৪ হি.) তাঁর ‘বাহরুল মাদিদ ফি তাফসীরিল কোরানিল মাজিদ’-এ বলেন ‘এটা লাইলাতুল ক্বাদর হতে পারে আবার মধ্য শা’বানের রাতও হতে পারে। তবে অধিকাংশ মতই প্রথমটির উপর।’ আল-বাইদাবী (মৃ. ৬৮৫ হি.) তাঁর ‘আনওয়ারুত তানজিল ওয়া আসরারুত তা’উইল’-এ এ কথাও বলেন, ‘এটা ক্বদরের রাত, তবে বারা’আতের রাতও (শা’বানের) হতে পারে যখন কোরানে নাজিলের সূচনা হয় -লাওহে মাহফুজ থেকে গোটা কোরান একত্রে দুনিয়ার আসমানে নাজিল করা হয়।’
আছ-ছা’লাবী (মৃ. ৪২৭ হি.) তাঁর তাফসীর ‘আল-কাশফ ওয়াল বাইয়ান’-এ লাইলাতুল ক্বাদরের পাশে মধ্য-শা’বানের রাতের মতও উল্লেখ করেন। তারপর, আলী (রা.) থেকে এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করেন যে নবী (সঃ) বলেছেন, ‘শা’বানের মধ্য-রাত যখন হাজির হয়, তখন তোমরা রাত জেগে ইবাদত কর এবং এর পরের দিন রোজা রাখ। নিশ্চয় সূর্যাস্তের পর আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে এসে বলতে থাকেন, ‘আছো কী কেউ ক্ষমা প্রার্থী, আমি ক্ষমা করে দেব। আছো কী কেউ রিজিক প্রার্থী, আমি রিজিক দান করব। আছো কী কেউ বালা-মুসিবতে, আমি উত্তরণ করব। এভাবেই বলতে থাকবেন ফজর পর্যন্ত।’ আছ-ছা’লাবীও ইকরামার (র.) সেই মধ্য-শা’বানের হাদিসের কথা উল্লেখ করেন।
আল-বাগাঁয়ী (মৃ. ৫১৬ হি.) তাঁর তফসীরে লাইলাতুল ক্বাদরের প্রাসঙ্গিকতার দিকে মত প্রকাশের পাশাপাশী মধ্য-শা’বানের রাতের মতটিও উল্লেখ করেন। আল-ক্বাসিম বিন মুহাম্মাদ তার পিতা (মতান্তরে তার চাচা) থেকে বর্ণনা করেন যে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’লা মধ্য-শা’বানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। তিনি প্রত্যেক নফসকে (ব্যক্তি) মাফ করেন, তবে, সেই ব্যক্তি ব্যতীত যার অন্তরে ঘৃণা-বিদ্বেষ রয়েছে, অথবা যে আল্লাহ সাথে শরীক সাব্যস্ত করে। আল-বাগাঁয়ীও ইকরামার (র.) পূর্বোক্ত বর্ণনার উল্লেখ করেন।
আল-মাওয়ার্দী (মৃ. ৪৫০ হি.) তাঁর তফসীর ‘আন-নাকতু ওয়াল উয়ূন’-এ লাইলাতুল মোবারাকার দু’টি অভিমত তুলে ধরেন। প্রথমটি মধ্য-শা’বানের রাত আর দ্বিতীয়টি লাইলাতুল ক্বাদর। প্রথমটির সূত্রে ইকরামার কথা উল্লেখ করেন। ইবন আতিয়্যাহর (মৃ ৫৪৬ হি.) তফসীর ‘আল-মুহাররারুল ওয়াজিজ ফী তাফসীরিল কুতুবিল আজিজ’ –এ লাইলাতুল ক্বাদরের কথা বলার পর একথাও সংযোগ করেন, ‘ইকরামা ও অন্যরা বলেন ইহা মধ্য-শা’বানের রাত।’
লক্ষণীয় যে যা বর্ণনাকারী ইকরামা (রা.) এক্ষেত্রে একক বর্ণনাকারী নন, "অন্যরাও" রয়েছেন। আল-ইতফিশ (মৃ. ১৩৩২ হি.) তাঁর তফসীর, ‘তাইসীরুল কোরান’ -এ লাইলাতুল ক্বাদরের অভিমত ব্যক্ত করেন এবং মধ্য-শা’বানের কথাটি উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর ‘অবতরণের’ অর্থ হল তাঁর রহমত নাজিল করা। আর এই রাত্রে কোরান নাজিলের অর্থ হল গোটা কোরানকে ‘বাইতুল মা’মুর’ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল করা, স্থানটি কাবার ঊর্ধ্বাকাশের স্থান। সেখান থেকে জিবরীল (আ খণ্ডাকারে নিয়ে আসেন। এও বলা হয় যে ওহী প্রথমে রবিউল আওয়াল মাসে নবীর (সঃ) নিদ্রায় শুরু হয়। তারপর কোরানের প্রথম অংশ নাজিল হয়,’ইক্বরা বিসমি রাব্বিক’ দিয়ে।’ আল-মাহাল্লী (মৃ. ৮৬৪ হি.) ও সূয়ূতী (মৃ. ৯১১ হি.) প্রণীত প্রসিদ্ধ জালালাইন শরীফে আছে, “এটি (এই রাতটি) ক্বদরের রাত অথবা মধ্য-শা’বানের রাতও হতে পারে যখন (কোরানকে) সপ্তাকাশের ‘লাওহে মাহফুজ’ (উম্মুল কিতাব) থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল করা হয়।” (উপরে, যেসব তফসীরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেই তফসীরগুলো আল-তাফসীর ডটকমে পাওয়া যাবে [১])
শেষ কথা
আমাদের কথা হচ্ছে, আল্লাহ যদি এই রাতে দুনিয়ার আকাশে আসেন, যদি তিনি তার বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন, যদি অসংখ্য পাপীতাপী লোক তার কৃপা লাভ করেন, যদি তারা গ্লানি নিঃশেষে মুক্তচিত্তে পুণ্যপথে অগ্রসর হন –তবে সেখানে মানুষগুলোকে কেন বাধা দিয়ে সরানো হবে? খামাখা কোনো ভাল জিনিসে জটিলতা সৃষ্টি করায় কী কোনো লাভ হয়? যেকোনো বিষয় নিয়ে প্যাঁচা-প্যাচি করতে গেলে জট কেবল বাড়তেই থাকবে। জট বাঁধাতে ইচ্ছে করলে অনেক বিষয়ে ‘সহীহ হাদিস’ টেনেও বাঁধানো যেতে পারে -ঝামেলা সৃষ্টি করা যেতে পারে। অধিকন্তু, হাদিস না মানার অভিযোগ অভিযোগ আনা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কুতর্কে আল্লাহ নেই। তিনি সুতর্ক ও বিশ্বাসে ধরা দেন। যেসব সাধারণ মানুষ এতকাল ধরে শবে বরাত পালন করে আসছে, তাদের সামনে বিদ্যার প্যাঁচ মেরে, শবে বরাতের গুরুত্ব ও মহিমা খেটো করে, ব্যাখ্যা হাজির করা যাবে বটে কিন্তু এতে ধর্মের কোন উপকার হবে না। শুধু এই একটি রাতে কত শত সহস্র লোক আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে ইবাদত বন্দেগী করে, আল্লাহর নাম নেয়, নামাজ পড়ে, জিকির আযকার করে। এই সুবাদে তাদের ছেলেমেয়েরাও ইবাদতের এহসাস লাভ করে –কান্নাকাটি করে। কিন্তু বিদ্যার ঠাকুর এসে যদি সে রাতের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেন তবে সর্বসাধারণ কী করবে?
মনে রাখা দরকার যে যেখানে বিদআতের স্থান নেই, সেখানে খোঁজে খোঁজে বিদআত আবিষ্কার করা ঠিক নয়। মধ্য শাবানের রাতে যদি কেউ বিদআত করে, তবে সেই বিদআতের বিপক্ষেই কথা বলা উচিৎ, সেই দুষ্কর্ম দূর করা করা উচিৎ। এই রাতে নামাজ পড়া, কোরান পড়া, মাসনূন দোয়া-দরুদ করা ও জিকির আযকার করা –এসব ঠিক আছে। কিন্তু যারা রাসূলের তরিকার বাইরে গিয়ে নানান গদবাধা প্রথা তৈরি করেন -সেসব থেকে মানুষকে সতর্ক করা যায়।
লেখার উদ্দেশ্য
অবশেষে আমার লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। আমি অনুভব করেছি যে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ রয়েছেন। এক পক্ষ শবে বরাত পালন করতে গিয়ে এমন সব কাজ করেন যা কোরান হাদিসের দৃষ্টিতে গ্রহণীয় হতে পারে না। অপর দিকে দেখা যায় আরেক পক্ষ যেন এটাকে একদম ছুড়ে ফেলার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন। আমি শুধু বলতে চেয়েছি যে এই রাতের গুরুত্ব আছে এবং এই রাতের ইবাদত পুণ্যের কাজ। আমি কারও ঝগড়া-ঝাটিতে নেই।
আমরা মানুষ হিসেবে অনেক ধারণা ও ভাবনাকে সঠিক বলে মনে পোষণ করি, কিন্তু আদপে তা সঠিক নাও হতে পারে। লেখার পূর্বে এই বিবেচনা আমার মনেও ছিল। আমি এর পক্ষে কখনো লিখতাম না যদি এর পক্ষে অনেক রেওয়ায়েত না থাকত, যদি তাবেঈনদের একাংশ এর পক্ষে না থাকতেন, যদি মুহাদ্দিসীনদের একাংশ এর পক্ষে না থাকতেন, যদি যুগপৎ ধরে চলে আসা অসংখ্য আলেম-উলামা এর পক্ষে না থাকতেন। সর্বোপরি আল্লাহ আমাদের মুক্তির জন্য নানান বাহানা তৈরি করেন, তিনি পরম করুণাময়, অত্যন্ত দয়াবান। তিনি অনেক কবুলিয়্যাতের সময় নির্ধারণ করেছেন, অনেক স্থানকে পবিত্র করেছেন, অনেক কর্মের প্রতিফল দশ থেকে সত্তরগুণ বেশি দেয়ার কথা বলেছেন। এসব কিছু সামনে রেখে মধ্য শাবানের রেওয়ায়েতগুলো বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে এদের ইসনাদ ভিত্তিক সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও এবারত সহীহ।
সর্বশেষে ইমাম ইবন তাইমিয়্যার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে সমাপ্তি টানছি। তিনি বলেন, “মধ্য শাবানের রাত, এই রাতের ফজিলতের উপর অনেক অনেক হাদিস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তীদের (সলফে-সালেহিনদের) একাংশ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তাঁরা ঐ রাতে নামাজ পড়তেন। তবে প্রত্যেক ব্যক্তির নামাজ একা একা ছিল [অর্থাৎ জামাতবদ্ধ বা দলীয় নয়]। পূর্ববর্তীরা এতে (অর্থাৎ ইবাদত সংক্রান্ত আমলে) অগ্রবর্তী ছিলেন। এই ইবাদতের পিছনে তাদের দলিল (হুজ্জাহ/যুক্তি) ছিল সুতরাং এটাকে নিষেধ করা যাবে না, এনকার করা যাবে না।” [২]
রেফারেন্সেস
_________________
[১] আল তাফসীর, [অনলাইন, আরবী], প্রাপ্তব্যস্থান, http://www.altafsir.com/)
[২] উইকিপিডিয়া, লাইলাতু মিনতাসিফি শাবান [আরবী], অনলাইন। প্রাপ্তব্যস্থান:
http://ar.wikipedia.org/wiki/%D9%84%D9%8A%D9%84%D8%A9_%D9%85%D9%86%D8%AA%D8%B5%D9%81_%D8%B4%D8%B9%D8%A8%D8%A7%D9%86 [Accessed on 18/06/2012]
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন