যৌনদাসী -একটি মিথ্যাচার
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ১১ জুন, ২০১৩, ০১:৪২:২৪ রাত
যৌনদাসী প্রসঙ্গ আলোচনা করার আগে ইসলাম বিদ্বেষীদের কয়েকটি প্রকার নিয়ে দুটি কথা বলি। বর্তমানে ইসলাম বিদ্বেষী পক্ষগুলোকে সাধারণভাবে ছয় প্রকার হিসেবে দেখতে পাই। (১) ইসলাম বিদ্বেষী হিন্দু (২) ইসলাম বিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্যচক্র (৩) ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকমহল (৪) পথভ্রষ্ট কোরান-অনলি কিছু লোক (৫) ইসলাম বিদ্বেষী খৃষ্টীয়ান ও মিশনারি সম্প্রদায়, (৬) ইয়াহুদী চক্র (৭) এবং মাথা ঘুলিয়ে-যাওয়া মুসলিম নামের কিছু কলঙ্ক –আলট্রা সেক্যুলার মুসলিম। এরা ইউরোপীয় ইসলাম বিদ্বেষী সাহিত্য এবং আরব-খৃষ্টীয়ান ও ইসরাইলী সাহিত্য থেকে ইসলাম বিদ্বেষী লেখা বাংলায় আমদানি করে। বিশেষ করে নাস্তিকগণ যেহেতু সাধারণতভাবে ধর্মমূর্খ, তাই অন্যান্য ইসলাম বিদ্বেষী সূত্র থেকে তথ্য আমদানি করতে হয়। মুসলিম সম্প্রদায়কে আক্রমণ করতে কোরান-অনলিরাও একই তথ্য ব্যবহার করে।
ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে খৃষ্টীয়ান চার্চের বিপক্ষে যেসব লেখা তৈরি হয়েছে, ইসলাম বিদ্বেষীরা না বুঝে সেগুলো ইসলামের মোকাবেলায় ব্যবহার করে থাকে। তারা যখন ‘মধ্যযুগের’ কথা বলে তখন নিতান্ত মধ্যযুগের চার্চের সামাজিকতা ও রাজকীয় প্রথার সাথে চার্চের সম্পর্কের বিষয় না বুঝে এনে থাকে। ইউরোপে যখন অন্ধকার যুগ চলছে, তখন মুসলমানরা ‘আলোর’ যুগে। ইউরোপীয় মধ্যযুগ খৃষ্টীয়ানিটির সাথে যেভাবে সম্পর্কিত ছিল, ইসলাম ধর্ম তার সামাজিক প্রথা এবং রাজকীয় প্রথা সেভাবে ছিল না। অর্থাৎ বিষয়গুলো সমান্তরাল নয় এবং ইউরোপের উদাহরণ ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যশীলও নয়। মূর্খদের এই জ্ঞান নেই। তাছাড়া পরবর্তীকালে ইউরোপীয় নাস্তিক ও আল্ট্রা সেক্যুলারিস্ট লেখগণ মধ্যযুগকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন –তা অনেকাংশে সঠিক নয়। তারা মধ্যযুগকে ক্যারিকেচার করেছেন। তাছাড়া সব যুগেই কিছু ভাল এবং কিছু মন্দ জিনিস দেখতে পাওয়া যায়। তারা এক্সক্লুসিভলি সকল মন্দের কাল হিসেবে মধ্যযুগকে দেখেন অথচ আমাদের কেবল গেল বিংশ শতাব্দীর ও এই একবিংশ শতাব্দীর অনেক হিংস্রতা, হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন মধ্যযুগকেও অতিক্রম করে। কিন্তু বিদ্বেষীরা এসব বুঝার ধারে কাছেও নেই। তারা মূর্খামিকেই দাম্ভিকতার সাথে জ্ঞান মনে করে। কেউ হয়ত বিজ্ঞানের কোন বিষয়ে পড়াশুনা করছে আর অমনি ধরে নিয়েছে বিশ্বের সব বিদ্যায় সে 'শিরকিত' (শিক্ষিত) হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় সাহিত্যে ‘ধর্ম’ (religion) শব্দটি পটভূমির দিক দিয়ে খৃষ্টীয়ান ধর্ম হয়, কিন্তু মূর্খমণ্ডলি তা না বুঝে আমভাবে শব্দটি ইসলামের সাথে জড়িয়ে ফেলে। তবে বিংশ শতাব্দীর অনেক সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন-পুস্তকে ধর্মকে ক্ষেত্র বিশেষে খৃষ্টিয়ানিটির বাইরেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এখানেও যখন ইসলাম আনা হবে তখন দ্বিমত করার ব্যাপ্ত পরিসর থাকে।
প্রোপাগান্ডিস্টরা সাধারত ইতিহাস-মূর্খ, দর্শন ও যুক্তি-মূর্খ। কোন ধারণা অতীতে কোন কোন প্রেক্ষিতে পড়ে ওঠেছে তা অবগত নয়, কোন সামাজিক প্রথা কীভাবে প্রাকটিস করা হত সে সম্পর্কেও অবগত নয়, কোন প্রথার সাথে অন্যান্য প্রথা ও আর্থ-সামাজিকতার সম্পর্ক জড়িত ছিল সেগুলো সম্পর্কেও অনবগত। এই মূর্খরা সিন্ডিকেটে কাজ করে। একটা উত্থাপিত বিষয়কে কেউ ব্যাখ্যা করে দিলেও, দুই একদিন চলে যাবার পর, তারা আবার সেই একই কথা বলতে থাকে। কারণ তাদেরকে এভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বা ইমেইলে ও আলোচনায় এভাবে করতেই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের কয়েকটি এমন যে তারা অসংখ্য ‘নিক’ ব্যবহার করে এবং সম্ভবত একজন অন্যজনের আইডেন্টিটি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। অর্থাৎ এক দেশে যখন এক প্রোপাগান্ডিস্ট অন্য কাজে ব্যস্ত, তখন অন্যজন তার প্রক্সি দেয়। এবারে চলুন যৌনদাসী ধারণায়।
যৌনদাসী
যৌনদাসীর কোন ধারণা ইসলামে নেই। সেকালে দাসদাসী ছিল। মনে রাখতে হবে, মানব সমাজে অনেক ধরণের প্রথা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা থাকে। এগুলো সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আর্থিক, পারিবারিক ও বৈক্তিক সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে গড়ে ওঠে। বিবাহ একটি প্রতিষ্ঠান এবং এটির সাথে অনেক ধরণের দায়িত্ব আসে এবং বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কাদি জড়িত হয়। স্ত্রী স্বামীর সংসারে অনেক দায়িত্বের ভূমিকায় আসেন, স্ত্রীর সাথে সেই পরিবার ও সংসার অনেকভাবে সম্পর্কিত হয়। তবে এসবের মধ্যে তার স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কও থাকে। কিন্তু এই সম্পর্কের কারণে কোনো সমাজ স্ত্রীকে ‘যৌন-স্ত্রী’ বলে আখ্যায়িত করেনি। সেদিনের সমাজে মালিকের দাসীও তার পারিবারিক অনেক দায়িত্বে আসে। মালিকের জীবন সংসার সেই দাসীর সাথে সম্পর্কিত হয়। এসব সম্পর্কের মধ্যে আরেকটি বিষয় ছিল যে মালিক তার সাথে যৌন-সম্পর্কও রাখতে পারত। এটাও ছিল সামাজিকভাবে অনুমোদিত একটি প্রথা, ইসলাম আবিষ্কার করেনি। স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক থাকার কারণে স্ত্রী যেমন ‘যৌন-স্ত্রী’ হন না, বা স্বামীও ‘যৌন-স্বামী’ হন না, তেমনি দাসীও যৌন-দাসী হয়ে পড়েন না। এটা হচ্ছে বিদ্বেষী পক্ষের মূর্খতা।
যৌনদাসীর ধারণা হচ্ছে মূলত রোমানদের বেশ্যালয় থেকে এবং ইউরোপের যেসব বেশ্যাকে নিছক এই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত, সেখান থেকে। অসংখ্য যুদ্ধলদ্ধ নারীকেই তারা এই বেশ্যা বৃত্তিতে ব্যবহার করত। ইসলামে এই কাজটি ‘হারাম’। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী মূর্খরা ইউরোপীয় সাহিত্যে ‘যৌন-দাসীর’ উল্লেখ দেখেই ভাবে ‘ইউরেকা’ –পেয়ে গেছি! এবং এভাবে মুর্খামির মাধ্যমে তারা এই পরিভাষাটি ইসলাম ও মুসলমানদের উপর চালিয়ে যায়। সাধারণ মুসলিম ছেলে-মেয়েরা যেহেতু এসব ঐতিহাসিকতার সাথে ও সমাজ-বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত নয়, তারা বিব্রত হয়ে পড়ে। আর এটাই হচ্ছে প্রোপাগান্ডিস্টদের ‘শিকারের’ স্থান। এই বিদ্বেষীদের মায়ের সাথে যেহেতু তাদের বাপের যৌন-সম্পর্ক রয়েছে তাই তাদের মা-গণ কী ‘যৌন-মাতা’? কেবল বিকৃত-মনারাই এসব নিয়ে মূর্খতা দেখাতে পারে।
আগেই বলেছি, দাসীদের সাথে যৌন সম্পর্কের সামাজিক বৈধতাও ইসলাম আবিষ্কার করেনি, দাস-প্রথাও নয়। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করে ইসলাম দাস-প্রথা তুলে দিতে পারত না। তাই সাধারণ মানুষ ও বিশ্বাসীগণকে বার বার বিভিন্নভাবে দাস/দাসী মুক্ত করতে উৎসাহিত করেছে। দাস/দাসীর মুক্তিকে অতীব সওয়াবের কাজ করে দিয়েছে এবং পরকালীন মুক্তির কথাও বলেছে। অনেক পাপের কাফফারা স্বরূপ দাস/দাসীর মুক্তির কথা বলেছে। আচরণে, ভরণে-পোষণে ন্যায্যতা, মানবতার দিকে খেয়াল রাখার কথা বলেছে। এদের প্রতি আচরণে মান উন্নত করেছে। এগুলো আগে ছিল না।
ইসলাম দাস প্রথার মুক্তির পথ পর্যায়ক্রমে স্থাপন করেছে। আজকের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যদি পরিবেশ দূষণের কারণে সকল ট্রান্সপোর্টেশন (বাস, গাড়ী, বিমান ইত্যাদি) নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে জীবন অচল হয়ে পড়বে। দাস-দাসীদের সাথে সেদিনের অর্থ-সামাজিকতাও এভাবে হাজার হাজার বৎসরে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সারা বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত এই প্রাচীন প্রথাকে হঠাৎ করে কোন এক স্থানে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু কোরান ও হাদিসের এবারতের এহসাসের দিকে তাকালে স্পষ্টই বুঝা যায় যে ইসলাম দাস প্রথা তুলে দেবার পথেই ভিত্তি স্থাপন করে যাচ্ছে। কোরানের ৪:৩ আয়াতে দাসীদেরে বিবাহ করার কথা বলা হয়েছে। এতে মর্যাদা বৃদ্ধি এসেছে। ৪:২৬ আয়াতেও দাসীদের উল্লেখ করার পাশাপাশি এই কথাটিও এসেছে যে যেসব গরীব লোক স্বাধীন নারীকে বিবাহ করতে পারবে না, এবং যাদের নিজেদের দাসী নেই তারা অন্যের দাসীকে তাদের মালিকের অনুমতিতে ‘বিবাহ’ করতে পারবে, গোপনে গোপনে কোন কাজ করতে পারবে না। ৪:৩৬ দাসীদের প্রতি ভাল ব্যবহার ও করুণার আচরণ করার কথা বলা হয়েছে। ১৬:৭১ দাসীদের প্রতি অর্থদান/উপহার ইত্যাদি দিতে উৎসাহিত করা হয়েছে। ২৪:৩৩ আয়াতে দাস/দাসীদের মধ্যে যারা মুক্তি পেতে লিখিত চুক্তি চায়, তাদের সাথে সেই চুক্তিতে যাবার কথা উল্লেখ হয়েছে। এই একই আয়াতে দাসীদেরে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োগ না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ইসলামের বই পুস্তক তছনছ করে কোথাও ‘যৌন-দাসীর’ ধারণা পাওয়া যাবে না। কেবল বিদ্বেষের কারণে মূর্খরা আর কিছু না পেয়ে এই কথা উচ্চারণ করে।
বিষয়: বিবিধ
৩৭৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন