ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও প্রতিবন্ধক যুক্তি
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ২৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:৫৮:২৪ রাত
বাংলাদেশে কয়েকটি ইসলামী দল রয়েছে। তারা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতক ব্যবস্থাপনাকে নৈতিক মূল্যবোধের উপর স্থাপন করতে ময়দানে কাজ করছন। তাদের কাজ-কর্ম ও প্রচারনায় যেসব পরিভাষা ব্যবহার করেন তা হল: ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, খিলাফত প্রতিষ্ঠা, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। শব্দে যা’ই থাকুক কাজ একটিই: নৈতিক ভিত্তির উপর শিক্ষা, শাসন, সামাজিক প্রথা ও প্রাতিষ্ঠানিকতার রূপায়ন -সর্বোপরি নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নানান মত-পার্থক্য থাকলেও নৈতিক ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থার রূপায়নের চিন্তায় দ্বিমত নেই। আমি বলব, একটি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মুসলমানদের কয়েকটি দল থাকাতে কোনো সমস্যা নেই; এক দল আরেক দলের মোকাবেলায় অধিক যোগ্য বলাতেও কোনো সমস্যা নেই; একে অন্যের মোকাবেলায় নিজেরদের পার্থক্য তুলে ধরাতেও কোন সমস্যা নেই, কেবল একে অন্যে শত্রুতায় না নামলেই হয়।
তবে একথাও সত্য যে কিছু সংখ্যক লোক ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিপক্ষে। তাদের এই বিপক্ষ নেয়ার পিছনে অনেক বাহানা রয়েছে। প্রথম বাহানা হয় জামাতে ইসলাম নিয়ে। তাদের অভিযোগ, এই দল ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার যোগ্য নয়। আপনি বলুন, ঠিক আছে। জামাতের পরিবর্তে আপনি খেলাফতে মজলিসে যোগ দিন। কিন্তু দেখবেন এটা তার মনঃপুত হচ্ছে না। এবারে বলুন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এ যোগদান করুন। কিন্তু দেখবেন এটাও তার পছন্দ হয় নি। তারপর আরেকটি বিকল্প দিন, দেখবেন সেই একই অবস্থা। যখন সে কোনো বিকল্প মানবে না, তখন বলুন, ভাই, কেউই যখন যোগ্য নন, তখন আপনি নিজেই একটা দল গঠন করুন এবং সেই কাজে অগ্রসর হোন। এই পর্যায়ে এসে দুই ধরণের লোকের দুই ধরণের উত্তর পাবেন।
যারা খাটি সেক্যুরারিস্ট এবং কাফিরদের সহযোদ্ধা তারা বলবে, ধর্মকে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে আনতে নেই, বাংলাদেশ মুসলিম দেশ নয়, হিন্দু-মুসলিম একজাতি, এখানে ইসলাম টানা ঠিক নয়, এটা পাকিস্তানীদের কাজ, এটা জিন্নাহর ধাপ্পাবাজি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো হচ্ছে নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের কাছ থেকে ধার-করা ফালতু বক্তব্য। এগুলো মূলত এনলাইটনম্যাণ্টের মডার্নিষ্ট ধারণা-প্রসূত যেগুলোর সাথে যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানবাদের সম্পর্ক, ঐশীক সম্পর্ক বাদ দিয়ে দেশ ও সমাজ গড়ার রাষ্ট্র দর্শন। এখানে মুসলিম নামধারী আলট্রা-সেক্যুলারিস্ট, বামপন্থী নাস্তিক, কমিউনিস্ট নাস্তিক, ও তাদের সহযোগী কিছু মুসলিম নামের কলঙ্ক, এবং হিন্দু সম্প্রদায় একমত পাবেন।
খিলাফত প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে আরেকটি দলের একাংশ রয়েছে। ওরা এই যুগে ইসলামী খিলাফত চায় না, বরং কোনো এক অজানা, অনাগত কালে অমনি অমনি খিলাফত কায়েম হওয়ার ধারণায় বিশ্বাসী। এটা অনেকটা কার্ল-মার্ক্সের ডায়ালেক্টিক মেটেরিয়েলিজমের প্রক্রিয়াগত ধারণায় কোনো অনাগত কালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হওয়ার মত। তাদের যুক্তির সাধারণী রূপ এইভাবে:
খিলাফত জোর কায়েম করা যাবে না (যেন কেউ জোরের কথা বলছে!)। মানুষের ঈমান আখলাক প্রথমে ঠিক-টাক হোক। যারা নামাজ রোজা করে না, তাদেরকে দিয়ে দিয়ে জোরে (!) ইসলামী খিলাফত কায়েম করা ঠিক নয়। আগে ওরা নামাজী হোক, ঈমান আখলাক ঠিক হোক, তারপর খিলাফত নিয়ে চিন্তা। এই হচ্ছে যুক্তি এবং এটা মার্ক্সিস্ট প্রগতিবাদের মত খোঁড়া।
যেসব ইসলামী দল খিলাফত প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন তারা কী বেনামাজি? অথবা তারা কী বেনামাজি লোক দিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন? নামাজ তো মুনাফিকরাও পড়ে। নামাজ মুনাফিক ও মুসলমানদের মধ্যে কোন পার্থক্যের প্রমাণ নয়, বরং প্রকাশ্যভাবে ইসলাম ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যের রূপক (figurative) উদাহরণ। মনে রাখা দরকার, নামাজ না-পড়ার কারণে কোনো মুসলমান অমুসলমান হয়ে যায় না, অধিকন্তু নামাজ পড়েও মুনাফিক মুনাফিক থেকে যেতে পারে। আবার কোনো বেনামাজিকে কী খিলাফত প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে দেয়া হবে না? সুতরাং এখানেই তাদের যুক্তির অসারতা। এই যুক্তির লোকদের সাথে বিতর্ক না করাই ভাল। তাদেরকে তাদের অবস্থানে ছেড়ে দিয়ে বাকীরা অগ্রসর হওয়া উচিৎ। কেননা বিতর্কে কাউকে পক্ষে আনা সহজ হয় না। মূল কথা, মানুষ গড়া ও রাষ্ট্র গড়ার কাজ পাশাপাশি চলতে হয়। ইতিহাস থেকে উদাহরণ নেয়া যাক।
জাহেলী যুগের কোরেশ প্রধানরা এবং অপরাপর গোত্র প্রধানরা জানত লা ইলাহার মূলমন্ত্রে কী রয়েছে। এটা বর্তমান যুগের জাহেলরাও বুঝে, তাই তাদের অনেকের যুদ্ধ হয় লা ইলাহার বিপক্ষে। জাহেলী সমাজ সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এই কলেমার স্বীকৃতিতে সামাজিক কর্তৃত্বের অঙ্গিকার মুহাম্মদের (সা.) হাতে চলে যায়, মুহাম্মদই (সা.) হয়ে পড়েন অনুসরণের মূল ক্বিবলাহ। অসংখ্য দেবতার প্রতিনিধিত্বে (representation) প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা এই কলেমার সাথে সাথে ‘অস্বীকৃত’ হয়ে পড়ে। একই সাথে কোরান জুলুমের উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার অযৌক্তিতার সমালোচনা করে যাচ্ছিল। পরিপ্রক্ষিতগত এই বাণী গ্রহণ করলে গোটা আরবের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হবে –এই ধারণা কারও কাছে গোপন ছিল না।
ইসলাম প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে তার আপন স্থানে প্রতিষ্ঠিত রেখে কেবল জিকির আযকার ও তসবিহ তাহলিলে সীমিত ছিল না। এই বাণী বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছিল। মাক্কী মুশরিকরা মুহাম্মদের (সা.) সাথে বার বার সমঝোতা (compromise) করতে চেয়েছিল যাতে মুহাম্মদ (সা.) তাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রতীকী মূর্তিদের সমালোচনা (criticism) বন্ধ করেন, তাঁর ধর্ম-কর্ম যেন কেবল সালাহ আর আল্লাহ আল্লাহ করাতে সীমিত রাখেন, এতে তাদের আপত্তি থাকবেনা। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) তাঁর একহাতে চন্দ্র আর অপর হাতে সূর্য পেলেও তাঁর মূল বাণীতে সমঝোতা (comprise) আনবেন না বলে জানিয়ে দেন। আল্লাহর তরফ থেকে এই সমঝোতার অবকাশ ও নির্দেশ থাকলে মুহাম্মদ (সা.) সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু কলেমা, সালাহ ও তাওহীদী দাওয়াতে সীমিত থাকতেন। দাওয়াত দিতে দিতে একদিন আরববাসী মুসলমান হয়ে গেলে কিল্লাহ ফতেহ হত। বিজয় নিশ্চিত হত – আল্লাহর দ্বীন অমনিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেত। কিন্তু এমন সমঝোতায় দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয় না। কখনও হয়নি। নবীর (সা.) যুগেও তাওহীদবাদী হানাফিরা ছিল। এরা যুগ যুগ ধরে অস্তিত্বে ছিল। কিন্তু তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে, সেই ব্যবস্থার নিয়ম-নীতি ও প্রথার সাথে মিলে-মিশে এবং বিশেষ করে তাগুতকে তার আপন স্থানে রেখে এমন কাজ হয় না। এগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে হয়; এগুলোর বিকল্প তৈরির জন্য কাজ করতে হয়; এর জন্য মানুষ তৈরি করতে হয়; মানুষের মধ্যে যোগ্যতা তৈরি করতে হয়; এই কাজ করতে গিয়েই সেই যোগ্যতা হাসিল হয়; তাগুতি শক্তি যখন মার-ঢালতে আসবে তখন তার মোকাবেলা করার মানসিকতা, সাহস ও যোগ্যতা তৈরি হতে হয়। এই সবগুলো চলতে হয় পাশাপাশি (hand in hand)।
আজকে কী নামাজীদের অভাব আছে? যে সংখ্যার মানুষ নামাজ পড়ে কেবল ওরাই সৎ, ভাল লোক হলে দেশের অবস্থা অন্যরূপ হত। পাঁচ ওয়াক্তের বাইরে নফল নামাজীদেরও অভাব নেই। তারপর জুমার দিনে মসজিদগুলোতে স্থান সংকুলান হয় না। কিন্তু দেশের নৈতিক বাস্তবতার অবস্থা কী? এই দেশেই চলছে ঘোষ, চুরি, ধর্ষণ, বদমাশি, হত্যা। এই প্রতিষ্ঠিত প্রথার লোকজনই আবার জাতিকে একাত্তরের বদমাশি, হত্যার কলঙ্কমুক্ত করার কথা বলে! কেবল একাত্তরেই কি ঐ কাজগুলো কলঙ্ক ছিল? গত চল্লিশ বৎসর ধরে যে এগুলো চলছে –এতে কি কলঙ্ক নেই? যা মন্দ তা কী স্থান কালে ভেদে মন্দ হবে না? এই প্রচলিত মন্দের প্রকৃতি কী দেখা হবে না? সূত্র দেখা হবে না? সামাজিক এই বিপর্যয়সমূহ ও দূরাবস্থার প্রতিকার কোথায় -তা কী দেখা হবে না?
এগুলোর প্রতিকার হচ্ছে নৈতিক শিক্ষায়, নৈতিক নেতৃত্ব গঠনে, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনে, নৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠতায়, নৈতিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত আইন ব্যবস্থায়। মোনাফেকগণ কর্তৃক একাত্তরের চেতনায় নৃত্য-কীর্তনে ‘জাতীয় স্বার্থের’ নামে কিছু লোককে যেকোনোভাবে হত্যা করাতেই আসবে না; বাঙালীত্বের নামে ফালতু আবেগ তৈরি করাতে আসবে না; মুসলিম জাতি অস্বীকার করাতে আসবে না, বাংলাদেশ মুসলিম রাষ্ট্র নয় –এই সব অস্বীকার করাতেও আসবে না। মোনাফিকদের দল এই সমাজ ব্যবস্থাকে তার নৈতিক বিপর্যয় ও অধঃপতন থেকে কীভাবে বাঁচাবে তার কোনো বিকল্পে যাচ্ছে না বরং চলতি-ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত রেখে, দিন দিন দেশ ও জাতিকে অধঃপতনের দিকে চালিয়ে নিচ্ছে। ইসলামকে নামাজীর চতুর্দেয়ালে বন্দি করে ফেললেই কী প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা আপনাতেই সুচারু হয়ে ওঠবে? এই দূরবস্থার জন্য কী ইসলাম দায়ী? ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক সম্প্রদায়, কাফির সম্প্রদায় এবং তাদের বঙ্গালগণ বাঙালীয়ানা দেখিয়ে ইসলামকে অপসারণের ইজারা কে দিয়েছে?
উপরের কথাগুলোর সারাংশ এভাবে হতে পারে:
• ঈমানের কলিমা হচ্ছে প্রশস্ত অর্থবহ। এই কলিমা একদিকে আল্লাহর উপর ঈমান আনার কথা বলে, তার আদেশ-নির্দেশ মানার কথা বলে এবং একই সাথে যে তাগুতি শক্তি সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে অস্বীকার করার কথাও বলে
• যে বিশ্বাস, সামাজিক প্রথা ও ব্যবস্থা আল্লাহ নির্দেশিত নয় নয়, সেই সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে নৈতিক ভিত্তির উপর নির্মিত ব্যবস্থা প্রবর্তনের কাজ চালিয়ে যাবার আবেদন সেই কলিমা থেকে আসে আর তা হতে হয় একই সাথে, হাতে হাত ধরে, hand in hand
• বর্তমানে যারা ইসলামী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে কাজ করছেন তারা বেনামাজি লোক দিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহবান জানাচ্ছেন না। তাই কোনো একটি দল অন্য কোনো দলের ব্যাপারে patronising কথাবার্তা বলা ঠিক হবে না। আজ যেসব দল নৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন তারা নামাজী লোক, শিক্ষিত লোক, তাদের দলগুলোতে যত ভিন্নতাই থাকুক না কেন। তারাও নামাজের ওয়াজ করেন, নামাজ শিখান, ধার্মীকতার সম্প্রসারণ করেন, তসবীহ তাহলীল করার কথা বলেন। আদব-আখলাক তৈরি করার কথা বলেন, অধিকন্তু শিক্ষাও দেন। যদি কোনো দিন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তবে এর ফলে দ্বীনের দাওয়াতী কাজ বন্ধ হয়ে যাবে না। বরং সেই কাজের সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাবে
• ইসলামী আদর্শের রাষ্ট্র গড়তে বেনামাজি কোনো অবদান রাখতে পারবে না–এমন অযৌক্তিক কথা বলার দরকার নেই। যারা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে পিছনে থাকতে চান, তাদের সাথে ঝগড়া করে লাভ নেই। যে যতটুকু পারবেন ততটুকুই করবেন। কাজ করার আগে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি শুরু করা কৌশল ও প্রজ্ঞার পরিপন্থি।
________________________
ভাল লাগলে আমার আরেকটি লেখা পড়তে পারেন:
সর্ষের ভূত -আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও বিপর্যয়
http://www.bdtomorrow.net/blog/blogdetail/detail/5698/M_Ahmed/13490#.UX6K2rVwrp4
বিষয়: বিবিধ
২২৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন