চেতনার ভূত -একটি আদর্শিক দ্বন্দ্ব ও বিপর্যয়
লিখেছেন লিখেছেন এম_আহমদ ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:৩৭:১৬ রাত
ভূমিকা
বিগত দেড় দশক ব্যাপী একটি মৈত্রীয়-গোষ্ঠী তাদের ব্যাপক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশকে সিভিল ওয়ারের মুখামুখি করিয়েছে। সামাজিক এই বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে তাদের সমাজ-দর্শন ও আদর্শগত বিষয় -যার রূপায়ন হচ্ছে ইসলামী সমাজ-দর্শন ও আদর্শের মোকাবেলায়। ইসলাম আল্লাহর আনুগত্যে নিয়ন্ত্রিত একটি সর্বাঙ্গীণ জীবন ব্যবস্থা কিন্তু এই মিত্র-গোষ্ঠী ইসলামকে ব্যক্তি ধর্ম হিসেবে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে তাদের জীবন পদ্ধতি ওদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এরা হচ্ছে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক পক্ষ, ইসলাম বিদ্বেষী হিন্দু সম্প্রদায়, ইসলাম বিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্য-চক্র (যাদের বিদ্বেষ ও ষড়যন্ত্র ঐতিহাসিক), ইসলাম পরিত্যক্ত মুরতাদ পক্ষ ও খাটি মুনাফেক পক্ষ।
এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ, একাত্তরের মূলধারা সম্বলিত চেতনার বাংলাদেশ, (যা কারো কারো দৃষ্টিতে লা ইলাহার বিরুদ্ধে), রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ (চল্লিশ বছর পরে শুরু হলেও তা আগামী চল্লিশ বছর জারি রেখে সেই উদ্দেশ্য সাধন); বাঙালী জাতীয়তাবাদের চিন্তা চেতনায় সামাজিক রূপায়ন (social engineering)। এই বৃহত্তর লক্ষ্যের সূচনা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের বিচার দিয়ে। অভিযুক্তরা পরিকল্পিতভাবে 'সুনিশ্চিত' অপরাধী; ‘জাতীয় স্বার্থে’ (সেই বৃহত্তর অভিলক্ষ্যে) এদের মত কিছু লোকের বলীতে প্রাথমিক পথ অতিক্রম হতে হবে।
ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার যে ঐতিহাসিক দীর্ঘ-সূত্রিতা রয়েছে এই পক্ষগুলোকে সেই ধারায় সব দিনই পাওয়া যাবে।
আজ দুঃখজনকভাবে সত্য যে তাদের কারণে জাতি এক চরম বিপর্যয়ের মুখামুখি –জাতি প্রধানত দুইভাবে বিভক্ত। এই বিভক্তিকেও তারা মৌলবাদী ও একাত্তরবাদী জন্ম-চেতনায় ব্যাখ্যা করে থাকেন। তাদের কারণে আজ সমাজের সর্বস্তরে চরম শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এগুলো ছিল অপ্রত্যাশিত। এই ব্লগ-প্রবন্ধে আমি বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনা করব। যে কয়টি বিষয় এখানে স্থান দেব সেগুলো নিম্নরূপ:
• আদর্শিক দ্বন্দ্ব: প্রতারণা ও বিপর্যয়
• কৌশল ও প্রতারণায় ইসলামী আদর্শ ও মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ
• শাহবাগের সো-ডাউন ও মিত্র-সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ
• সামাজিক বিপর্যয়সৃষ্টির কর্মকাণ্ড ও নমুনা
• ফাসাদীদের (বিপর্যয়কারীদের) মূল চক্রান্ত
• বিপর্যয় দমনে আইনের প্রয়োজনীয়তা
• কোরানের আলোকে সামাজিক বিপর্যয়
• সারাংশ
আদর্শিক দ্বন্দ্ব: প্রতারণা ও বিপর্যয়
বলার প্রয়োজন নেই যে একটি সমাজবদ্ধ জীবনে জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করতে হয়; এখানে ব্যক্তি ও সমাজ এক ধরণের অঘোষিত কন্ট্রাক্টের আওতাভুক্ত থাকেন। যদিও সবার ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে কিন্তু সেই স্বাধীনতা অপরের স্বাধীনতাকে খর্ব করে নয়। এই কন্ট্রাক্টবদ্ধ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে কিছু লোক হঠাৎ করে কোনো আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অপরের উপর তাদের আদর্শ কৌশলে অথবা বল প্রয়োগে চাপিয়ে দিতে পারবে না –সংগত হবে না। যদি তাদের আদর্শ গোটা জনগোষ্ঠীর স্বার্থের অনুকূল হয়ে থাকে তবে সেই আদর্শ ও আদর্শের অনুকূল ব্যাখ্যা দেখিয়ে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, তা প্রণয়নের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু সমাজের অপরাপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের মানবতা কেড়ে নিয়ে, মিথ্যাচার করে, মানুষের মধ্যে পারস্পারিক ঘৃণা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, প্রচার-প্রোপাগান্ডা করে তা করতে পারবে না। এতে সমাজকে বিপর্যয়-মুখী (ফেতনা) করা হবে, পারস্পারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হবে এবং সর্বোপরি সেই সমাজবদ্ধ জীবনের শান্তি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। অধিকন্তু যে সামাজিক কন্ট্রাক্টের আওতায় সামাজিক জীবন সম্ভাবনাময়ী হয়ে ওঠে, সেই সম্ভাবনা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পড়বে। যেহেতু এসব হবে ফেতনা/ফাসাদ এবং যেহেতু এগুলো সমাজবদ্ধ জীবনের প্রতিকূল তাই তাদের কর্মকাণ্ডকে সামাজিক আইনে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
কিন্তু ভূত যদি সর্ষেতেই স্থান পেতে নেয় তবে উপায় নেই –বামুন আর পৈতার ফিতনা হবে সাংঘাতিক। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে রাজনৈতিক হত্যাসহ, প্রত্যেক বৎসর হাজার হাজার হত্যা সংগঠিত হয়ে আসছে, কিন্তু বিচার পরিলক্ষিত হচ্ছে না; হাজার হাজার নারী ধর্ষিতা হচ্ছেন এবং হন কিন্তু বিচার দেখা যায় না। ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা লুট-পাঠ হয় কিন্তু বিচার পাওয়া যায় না। জনগণের বনসম্পদ ও মৎস্য-সম্পদ লুট হয় কিন্তু বিচার পাওয়া যায় না। জনগণের ভূমি-সম্পদ আত্মসাৎ হয় কিন্তু বিচার পাওয়া যায় না। ঘোষ, চুরি, ডাকাতি সর্বত্র বিস্তৃত। শিক্ষাঙ্গনে ঘোষ, সরকারি প্রতিষ্ঠানাদিতে ঘোষ, আদালতের অঙ্গনে ঘোষ, পুলিশে ঘোষ, আর্মিতে ঘোষ, রাজনীতিতে ঘোষ। এখানে ন্যায়-নীতি খুব দুর্লভ বস্তু। বিচার দুর্বলের জন্য অনুপস্থিত। নিরপরাধ ব্যক্তিকেও শক্তিধরের হাতে মিথ্যা মামলায় পড়ে সর্বস্বান্ত হতেও দেখা যায়। এগুলোর কারণ আইনি ব্যবস্থা ‘শক্তিধরদের’ ঊর্ধ্বে নয়। মানুষ নিরুপায় হয়ে এগুলো সহ্য করছে, শুধু বেঁচে থাকার জন্য। (এটাও গরীবের জন্য অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না -অনেক করুণ দৃশ্য দেখে মনে হবে ওরা যেন গৃহ-পালিত জন্তুর চেয়েও হীনমূল্যের!)
সর্বগ্রাসী ফিতনার বাস্তবতায় কেউ ‘বিচার চাই’ বললেই শেষ কথা হয় না। বরং এটাও ফিতনার অংশ কী না তা দেখার দরকার হতে পারে। দেখা দরকার, কারা বিচার চাচ্ছে; তাদের পরিচয় কী; কীসের বিচার, কীভাবে বিচার, কার মাধ্যমে। যাদের বিচার করবে তাদের সাথে ওদের কোনো দ্বান্দ্বিক পূর্ব-সূত্রিতা রয়েছে কীনা যা বিচারের চিৎকারে আঁচ করা যেতে পারে। এটা তো এমনও হতে পারে যে এখানে মুখামুখি পক্ষগুলো এই প্রথমবার মুখামুখি হয় নাই, এদের অতীত আছে, এরা বার বার মুখামুখি হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন রণাঙ্গনে –এবারের রূপ হয়ত ‘বিচার’।
কথাটি আরও বর্ধিত করি। আপনার ঘর চুরি হয়েছে আপনি বিচার চান। আপনার এই চাওয়ার বিপক্ষ কেউ নিতে পারে না। কিন্তু এখানেও সেই আগের কথা আসে। চোর কে; আপনি কে; জানেন কীভাবে; ধরবেন কার মাধ্যমে; সাক্ষী কে; বিচার কাকে দিয়ে করাবেন ইত্যাদি। এগুলো জরুরি প্রশ্ন, এগুলো জিজ্ঞাস্য। এটা তো একটি কন্ট্রাক্টবদ্ধ সামাজিক জীবন ব্যবস্থা –এখানে সবার স্বাধীনতা আছে, অধিকার আছে, চোরেরও। ধরুন, আপনি আপনার দুশমনকে সরাসরি হত্যা করতে চান। কিন্তু নানান জটিলতায় পারছেন না, তাই সেই প্রাচীন কৌশলের চিন্তা করছেন: জুডিশিয়াল কিলিং, আদালতের নাটক করে হত্যা। তাই প্রথমে অভিযোগ তৈরি; তারপর প্রোপাগান্ডা; তারপর সার্কাস। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে: ঢোল-ডফকি, পদ্য-গদ্য, নাট্য-চিত্র, নৃত্য-সংগীত ইত্যাদিতে ঢেলে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এটা সাক্ষাত ফাসাদ। ফিতনা/ফাসাদ আল্লাহর কাছে ‘হত্যার’ চেয়েও জঘন্য। এতে সামাজিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
সামাজিক বিপর্যয় কেবল চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, গুণ্ডামি, সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদিতে কেন্দ্রীভূত নয়। এর ফিরিস্তি ব্যাপক। একটি সভ্য সমাজে মানুষ একে অন্যের ধর্ম ও মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখানোও সেই কন্ট্রাক্টের অংশ। এখানে কেউ কারো প্রতি অন্যায়, অশ্লীলভাবে চড়াও হতে পারবে না, প্রোপাগান্ডা করতে পারবে না। কেননা এতেও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অনেক ফিতনার পিছনে ফিতনাবাজদের আদর্শিক উদ্দেশ্য নিহিত থাকতে পারে, অপর দলের আদর্শ ও অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করার পায়তারাও থাকতে পারে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে এই মিত্রপক্ষগুলো যা করে আসছে তা ছিল উপরোক্ত ধারার কাজ। নাটকীয় পায়তারা, আদর্শের প্রতিপক্ষকে নির্মূল। কিন্তু দৃশ্যত বিচার। ‘আমরা শুধু বিচার করছি।’ তারপর আলঙ্কারিক (rhetorical) প্রশ্ন, ‘আমরা কি বিচারও করতে পারবো না?’ কিন্তু অপরাধীর প্রেষণা (মোটিভ) কী? তারা যদি পাকিস্তানের ঐক্য চেয়ে থাকে তবে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে এসে গ্রামগঞ্জের নিরীহ কাউকে হত্যা করাতে কি সেই ঐক্য অটুক থেকে যায়? কি নারী ধর্ষণে সেই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়? কি নিরীহের ঘর পুড়িয়ে দিলে সেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়? ওরা কি পাগল? ওসব কাজে যে তাদের নিজ পায়ে কুড়াল মারা হয় তা কি তারা বুঝে না? বুঝ কি কেবল নাস্তিক, মুনাফিক, হিন্দু ও বিদ্বেষীদের একচেটিয়া (exclusive) বস্তু? আমরা যাদের কথা বলছি ওরা ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত লোক, এদেশের লোক, এদেশের নর-নারী তাদেরই মা-বোন, ওরা তাদেরই সমাজের লোক, আর এই সমাজের উন্নতির জন্য তারা রাজনীতি করে। উল্লেখিত অপরাধগুলোর মধ্যে কী পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি নিহিত ছিল? বিচার। হ্যাঁ, বিচার! এটা এক নতুন যুদ্ধ! লা ইলাহার জনগণ এটা বুঝে ফেলেছে। তারা প্রকাশ্যে কথা বলতে শুরু করেছে।
পৈতাধারীপক্ষ যখন বিচার বিচার বলে অগ্রসর হচ্ছিল তখন অবস্থা সঙ্গিন দেখে কয়েকটি বিদেশি আইনি সংস্থা সাহায্য করতে প্রস্তাব করেছিল এবং তাদের দলের বাইরের অনেক আইনবিদও সেই একই ধরণের প্রস্তাব করেছিলেন যাতে করে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণীয় বিচারিক প্রক্রিয়া তৈরি হয় –কিন্তু ঢোল-ডফকি ও নৃত্য উল্লাস তখন তুঙ্গে তাই তোয়াক্কা করা হয়নি। কেন করা হবে? তাদের মূল কাজ তো এখানেই সীমিত নয়, মূল কাজ হচ্ছে দেশকে রাজাকারমুক্ত করা, পদক্ষেপকে বর্ধিত পরিসরে দীর্ঘস্থায়ী করা। বিষয়টি এখানেই ব্যাহত হলে সাম্প্রদায়িকতা-মুক্তির লক্ষ্যে রাজাকার বানিয়ে বানিয়ে বাকী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদীদেরকে আনা হবে কীভাবে? পথ অনেক দীর্ঘ। কিন্তু দিল্লি অনেক সময় দূরেই থেকে যায়। আজ বাংলাদেশ এক চরম সংঘাতময় বিপর্যয়ের মুখামুখি। যারা এই সংঘাত সৃষ্টি করেছে তারা এটা তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্বের কৌশল হিসেবেই করেছে। এই দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক।
কৌশল ও প্রতারণায় ইসলামী আদর্শ ঠেকানো
আমি বিগত ৩ বৎসর ধরে ব্লগ জগতের সাথে পরিচিত হয়েছি। ২০০৯ সালের ২৯ শে ডিসেম্বর আমারব্লগে প্রথম ঢুকি এবং সেখানে দেখতে পাই একাত্তরের নামে কিছু উগ্র লোক ঘৃণা-বিদ্বেষের মাধ্যমে একাত্তরের যুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীতে এসে করছে। সেখানে ইসলাম বিদ্বেষ চলছে; নবী রাসূলকে নিয়ে কটাক্ষ ও বিষোদগার হচ্ছে; কোরান নিয়ে অজ্ঞ-মূর্খরা বিষোদগার চলছে। সেই হুলুস্থলের মধ্যে চলছিল জামাত বিদ্বেষ ও বিষোদ্গার। ওদেরকে ‘নির্মূল’করতে হবে। ওরা একাত্তরের হত্যা ও ধর্ষণের জন্য দায়ী। ওদের নেতাদের ছবি কুকুরের পিছনে, শোয়ারের পিছনে, জন্তু-জানোয়ারের পিছনে এঁকে বিষোদগার হচ্ছে। কুকুর, শোকর ও অন্যান্য জন্তু জানোয়ারের মুখে দাড়ি এঁকে এবং ছবির নিচে জামাতের কারো নাম লিখে চলছে অমানবিক ক্রিয়াকাণ্ড (dehumanisation), পৈচাশিক আক্রমণ। গোটা দলের উপর বিষোদগার। আইনি দৃষ্টিতে অভিযুক্তরা তখনও নিরপরাধ। বিচার তো তখন শুরুই হয়নি। অথচ এই দলটি বাংলাদেশের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এবং ইলেকশন কমিশনের সাথে নিবন্ধিত একটি জাতীয় দল। প্রায় নয়/দশ শতাংশ জনগোষ্ঠী এর সাথে জড়িত। একটি অন্যতম ও প্রধান রাজনৈতিক দল ছাড়াও এরা আরও কয়েকটি দলের সাথে জোটবদ্ধ। এমন একটি জনগোষ্ঠীর প্রতি এই ঘৃণার প্রচার, বিদ্বেষের প্রচার, গালাগালি এগুলো ছিল ফাসাদী কর্মকাণ্ড, অসভ্য তো বটেই। যদি বিচারের কথা হবে তবে গালাগালি কেন; ঘৃণা বিদ্বেষ কেন; পাকিস্তানে পাঠানোর কথা কেন; ফাঁসীর কথা কেন; নির্মূলের কথা কেন; সমূলে বিনাশ কেন –এগুলো ছিল চরম ফ্যাসিস্ট, সামাজিক ফিতনা। এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়ার কথা। ব্রিটেনে কোনো দল এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলে তাদেরকে সহজেই আদালতে হাজির করা যাবে।
এই অসভ্য কাজগুলো যারা মিলিতভাবে করে যাচ্ছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন: রাজাকারমুক্ত দেশ, সাম্প্রদায়িকতামুক্তি, মৌলবাদ ঠেকানো, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মীয় আদর্শের অসারতা দেখানো, বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্ব থেকে আলাদা করা, কেননা ওরা একাত্তরে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, এবং দেশকে তার ইসলাম ও মুসলিম বৈশিষ্ট্য ছিন্ন করে বাঙালী জাতীয়তাবাদে প্রতিষ্ঠিত করা। জামাতকে পিটিয়ে বাকীদের সামনে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যে, ‘সাবধান’! লোম নাড়াবে না, বেছে ফেলব’। আমি প্রথম দিন যখন আমারব্লগে ঢুকি তখন আরিফ জেবতিককে বলেছিলেম:
I am flabbergasted by your patriotic feeling which seems to centre around partisan and marginal attitude, falling far below the nation and its totality. This attitude doesn’t seem part of patriotism but of arrogance, egocentrism, jingoism and dangerously discriminatory to what is holistically ‘national.’ Consider the total number of Jamaatis, their supporters, their well-wishers, their sympathisers which might reach millions who are not within your scope; The political reality of Bangladesh has evolved over the decades in such a way that half of the nation has reconciled with the Jamaatis; they are being taken into ‘formal alliance’ in addressing national elections and, when won, they are forming government in joint persuasion; (here I refer to BNP-Jamaat jote). ... Are you truly a patriot trying to embrace the nation? What about the fact that Jamaat is a political party within the framework of the nation’s constitution? When the constitution allows a provision as legal within itself, and you stand against with a vehement disapproval, denial or perhaps disregard to it, how should your position be realised, as that of a ‘patriot’ or a ‘traitor?’
এইসব ফাসাদ যে অচিরেই জাতিকে বিভক্ত করে দেবে, দেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে, একথা তখনই অনুভূত হয়েছিল। এটা যে কেউই বুঝতে পারতো। আমি তাদের এই যুদ্ধকে “একাত্তরকেন্দ্রিক জাতীয় বিভক্তির চক্রান্ত” হিসেবে দেখেছিলাম এবং এই শিরোনামে একটি ব্লগও দিয়েছিলাম। কিন্তু চক্রান্তকারীদের ভাল লাগে নি (আমি সবেমাত্র বাংলা টাইপিং আত্মস্থ করে কোনো রকমে লিখতে শুরু করেছি এবং অনেক গালিবাজ ফ্যাসিস্টদের চরম হিংস্র ইতরি রূপ পরে অনুভব করে থাকবো)।
সেদিন যে বিপর্যয়ের কথা ভেবেছিলাম, সেই বিপর্যয়, সেই বিভক্তি তারা বাস্তবে এনে হাজির করেছে। কিন্তু শাহবাগ চত্বর তাদের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছতর-মুক্ত করে দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যের পরিধিকে কৌশলমুক্ত করেছে।
শাহবাগের সো-ডাউন ও মিত্র-সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ
শাহবাগী আন্দোলনই মিত্র-সম্প্রদায়ের বৃহত্তর উদ্দেশ্যাবলী সর্ব-সাধারণের দৃষ্টিতে আনে। সেখানে কাদের মোল্লার ফাঁসী থেকে শুরু করে মঞ্চে আল্লাহ রাসূলের বিরুদ্ধে কথা, সকল অপরাধীর ফাঁসীর দাবী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধের আহবান, (অর্থাৎ সকল ইসলামী রাজনীতি); মাদ্রাসার কারিকুলাম নিয়ন্ত্রণ, ইসলামী ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, ইসলামী সেবা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানাদি বন্ধের দাবী –এগুলোতেই বৃহত্তর উদ্দেশ্য প্রকাশ পায়। দেশি বিদেশি নাস্তিকগণের সংহতিতে উদযাপিত হয় ঈদের মত উৎসব। আর সংখ্যার আতিশয্যে বিমোহিত হয়ে মৈত্রীয়-গোষ্ঠীর লোকজন যার যার উদ্দেশ্য প্রকাশ করতে শুরু করে।
শাহবাগে মিলিত মিত্র-সম্প্রদায়কে সুদূর অতীতের এক পৌত্তলিক মিত্রবাহিনীর সাথে খানিক তুলনা করা যেতে পারে। সেই মিত্রবাহিনীতে দশ হাজার সেনা-শক্তি থাকলেও তারা সেদিন কোনো নির্দিষ্ট একক নেতৃত্ব গঠন না করেই সবাই যার যার এলাকা থেকে মুসলমানদেরকে “নির্মূল” করতে এসেছিল এবং নিজেদের সংখ্যাধিক্যে আত্মপ্রতারিত হয়ে পড়েছিল। এটা ছিল পৌত্তলিকদের আহযাব বা মিত্রবাহিনী। খন্দক যুদ্ধ। শাহবাগের মিত্রপক্ষে ছিল ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক পক্ষ, ইসলাম বিদ্বেষী হিন্দু সম্প্রদায়, ইসলাম বিদ্বেষী ব্রাহ্মণ্য-চক্র, ইসলাম পরিত্যক্ত মুরতাদ পক্ষ ও খাটি মুনাফেকগণ। আর এর বাইরে ছিল তামাশা দেখতে আসা সাধারণ গণ-ঢল। ওখানে সংগঠিত হয়েছিল এক বিপুল যুবক যুবতির মহড়া: গান, বাজনা, নৃত্য ইত্যাদি। চার বেষ্টনীর নিরাপত্তার ভিতরে এমন নাটকীয় সার্কাস বাংলার ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম (হয়ত বিশ্বের ইতিহাসেও) এবং ওখানে গিয়ে বিনা-টিকেটে রঙ-তামাশা উপভোগ করার বয়স যাদের ছিল তারাই গিয়ে হাজির হয়েছিল। তাদের সংখ্যা ছিল বেশি। ওখানে ভোগ-উপাদানের কমতি ছিল না বরং বাড়তি ছিল প্রচুর। ছিল চৌকস সামগ্রী। অনেককিছু সংবাদ-মাধ্যমে ও মৌখিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। (অপকর্মের উপাদান-জনিত কারণে এটাকে নাস্তিক চত্বরের পাশাপাশি ইন্টারনেট মন্তব্যাদিতে প্রজনন-চত্বর হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়েছে)!
ওখানে ন্যায়-পরায়ণ বক্তব্যের অনুপস্থিতি ছিল। একটা একটা জামাতি ধর/ধরে ধরে জবাই কর, একটা একটা শিবির ধর/ধরে ধরে জবাই কর –এগুলো কী বিচারের মহাকল্লোল? জাফর ইকবাল যখন একটা একটা করে নাম উচ্চারণ করছিল, আর তার সাথে সাথে পাগলপারা যুবক যুবতিরা সমস্বরে, ‘তুই রাজাকার, তুই রাজার’ বলে গর্দভের-মত চিৎকার করে যাচ্ছিল, তখন সেখানে বিমূর্ত হয়ে উঠেছিল ঘৃণা-বিদ্বেষ, সেকি দৃশ্য! সেকি রূপ! ওগুলো কি বিচার? ওরা কী শিক্ষিত লোক? মঙ্গল-প্রদীপে প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল ফ্যাসিবাদের মহাসমারোহ! ওরা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল। গোটা পরিস্থিতি পরাজয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিভিন্ন দেশের মিডিয়ায় তা বীভৎস ও বিস্ময় হয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে রাজীব নামক এক দুর্মুখ নাস্তিক অক্কা পেলে সুযোগ যায় কই? নানান উদ্দেশ্যবাদীদের সাথে জড়িত একাংশ তড়িৎ বেগে দৌড়ে যায় লাড্ডু গিলার রাজনৈতিক অভিলিপ্সায়! ঐ নাস্তিককে ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের’ ‘প্রথম শহীদ’ আখ্যায়িত করে সেকি দৃশ্য! প্রধানমন্ত্রীর হস্ত প্রসারিত হয়েছিল রাজীবের তপ্ত-খ্যাতির পুষ্প-কানন থেকে সামান্য ধন্য কুড়াতে। এসব ছিল বিস্ময়, কলঙ্ক। ওখানের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীরা নিজেদের আচরণে যে শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিচয় দিয়েছিল, ওঠা কী কোন জাতির জন্য প্রত্যাশিত হতে পারে? ইসলাম ছেড়ে কী মানুষ এই শিক্ষা সংস্কৃতি গ্রহণ করবে?
ফাসাদীদের মূল চক্রান্ত
যে পক্ষটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে ইসলামকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে সরিয়ে ব্যক্তি সীমায় নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ তারা জানে যে মুসলমানগণ এটা সহজে মেনে নেবে না, কেননা ইসলাম ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। এর অনুসারীগণ পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হতে নির্দেশিত। (২:২০৮) এখানে ব্যক্তির আল্লাহর আনুগত্য তার বৈক্তিক সত্তা, পারিবারিক সত্তা, তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সত্তা নিয়ে। তার আধ্যাত্মিকতা যেমন ব্যক্তিতে তেমন সমাজে ও রাষ্ট্রে। তার জীবন খণ্ড খণ্ড নয়: ঘরে ঢুকার পর পর তার আনুগত্য শুরু হয় না। তার সত্তাগত জীবন সর্বত্র ব্যাপৃত। সে সর্বত্র মুসলিম। সে লেনিনের পোলা নয়, সে ইউরোপীয় ধনতান্ত্রিক নয়, তবে সে অযথা কারও দুশমনিতেও নয়। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষী পক্ষ তাকে চার দেয়ালে বন্দী করে তাদের আদর্শিক আনুগত্য করাতে চায়। তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট মুনাফিকগণ ওদের পক্ষ হয়ে বুঝাতে চায় যে চার দেয়ালের ভিতরেই ইসলাম সুমহান; ইসলামে কোনো রাষ্ট্র নেই, এটা মৌলবাদীদের বানানো। মৌলবাদীরা সাম্প্রদায়িক। হিন্দু, মুসলিম, নাস্তিকগণ ও মুরতাদগণ এক জাতি, যার যার বিশ্বাসে থেকেই ছেলে মেয়েরা বিয়ে-শাদি করতে পারবে, আইন করে সব বাধা দূর করতে হবে এবং এই সামাজিক প্রকৌশলেই (by social engineering) জন্ম হবে একজাতিত্ব! সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে হবে, যারা সাম্প্রদায়িক আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করতে আসবে তাদেরকে অঙ্কুরেই ‘নির্মূল’ করতে হবে। ইসলাম বিদ্বেষী যেসব আচরণ রয়েছে, সেগুলো না দেখলেই হয়, যারা দেখিয়ে দিতে আসে তারা অপরাধী, মৌলবাদী, জামাতি, সাম্প্রদায়িক।
কিন্তু মিত্র-সম্প্রদায়ের সমস্যা সঙিন –গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ই তো সাম্প্রদায়িক! পার্থক্য কোথায়? এই যুদ্ধ কীভাবে হবে? এখানে কৌশলের প্রয়োজন এবং এই কৌশলে জামাতের নাম আসে প্রথমে। এদেরকে সামনে রেখে বৃহত্তর সাম্প্রদায়িকতা রুখা হবে। জামাত পিটিয়ে বাকীদেরকে সতর্ক করা হবে। এতে কাজ না হলে, আজ এটাকে কাল সেটাকে পিটানো হবে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের অভিযোগে প্যাঁচানো হবে। সন্ত্রাসের দায় তো আছেই। সেটা খাটি মিরিকিন কৌশল। কিন্তু জটিল পরিস্থিতিতে অনেক সময় কৌশলী ভাষা তার আপন কেন্দ্র হারিয়ে ফেলে, মূল প্যাচ প্রকাশ পেয়ে যায়। নানান ধরণের উত্তাল তরঙ্গে, হাঙ্গায়-দাঙ্গায় পার্থক্যের সব চিহ্ন মুছে গিয়েছে। আজ তাদের কাছে সবাই এক। তাবলীগী, চরমোনাই, খেলাফত, হেফাজত সবাইকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, জামাতি আখ্যায়িত করার পর তাদের সব ছলচাতুরীর কোনো বৈশিষ্ট্য অবশিষ্ট থাকেনি। তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তারা যে এক অতি প্রাচীন যুদ্ধ নতুন নামে করছে তা দিবালোকে উদ্ভাসিত। তাদের দ্বন্দ্বের জের ১৯৪৭ সালে পাওয়া যেতে পারে, ১৮৫৭ পাওয়া যেতে পারে, ১৭৫৭ সালে পাওয়া যেতে পারে এবং মধ্যবর্তী সময়েও সেই সূত্রাদি দেখা যেতে পারে।
আমরা আজ এক ঐতিহাসিক সত্যের দ্বারপ্রান্তে। ঐতিহাসিক যুদ্ধের মুশাহিদ। এখানে যে বিভক্তি প্রকাশ পেয়েছে, সেই বিভক্তির দুই অংশের ঐতিহাসিকতা, দুই পাশের লোকদের সার্বিক ধার্মিকতা, সার্বিক দ্বীনি-চরিত্র, তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, জীবন যাপন পদ্ধতি ইত্যাদির দিকে তাকান। এখানে সত্য প্রতিভাত হওয়ার কথা। এখানে এই দোয়া করা উচিত, আল্লাহুম্মা আরিনাল হক্কা হাক্কা, ওয়ারজুকনা ইত্তেবাআ, ওয়া আরিনাল বাতিলা বাতিলা ওয়ারজুকনা ইজতিনাবাহু ইয়া রাব্বাল আলামিন –হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে সত্যকে সত্যরূপে দেখিয়ে দাও ও সেই সত্যকে অনুসরণ করার তৌফিক দাও এবং আমাদেরকে মিথ্যাকে মিথ্যারূপে দেখিয়ে দাও ও তাত্থেকে সরে থাকার তৌফিক দাও, হে পরওয়ারদিগারে আলামিন। তাপর যার মন যেদিকে যায়, অর্থাৎ যে দলের সাথে যার হাশর নশর হওয়া পছন্দের, তিনি সেদিকেই যেতে পারেন।
বিপর্যয় দমনে আইনের প্রয়োজনীয়তা
নাস্তিক পক্ষের কেউ কেউ বলছেন, ‘আল্লাহ রাসূলকে গালি দিলে ইসলামে শাস্তির বিধান নাই’। তারা মনে হয় জঙ্গলে বাস করেন। জঙ্গলে গিয়ে আল্লাহ রাসূলকে গালাগালি করলে কারও কিছু বলার নাই, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় আসার পর তাদের সেই ‘ ঘৃণ্য আগ্রহ’ মিটানোর অবকাশ থাকবে না, তাদেরকে সাজা পেতে হবে।
আল্লাহ রাসূলকে গালাগালি করা, ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রকাশ করা জঘন্য কাজ –ফিতনা, শাস্তিমূলক অপরাধ। আজ যারা ফিতনার মাধ্যমে জাতিকে এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করিয়েছে, তাদেরকে সনাক্ত করা দরকার, তাদেরকে বিচারের আওতাভুক্ত করা দরকার। যারা জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও মানবতাহানীকর কার্যকলাপ চালিয়েছে তাদেরকেও। তাদের যুদ্ধস্বদৃশ সামাজিক বিপর্যয়ের কারণে এপর্যন্ত অনেক প্রাণহানি হয়েছে; আরও হওয়ার হুমকি আসছে; অনেক আহত হয়েছেন; অনেকের ধন-সম্পদ নষ্ট হয়েছে এবং এগুলো আরও বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যারা এইসব ফেতনার হোতা, তারা অমনিতে নিবৃত্ত হবে না। এটা তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব, প্রত্যয়ে উদ্ভূত বিষয়, এটাকে তারা যুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাদের আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। সুতরাং এখানে আইনি প্রক্রিয়া হাজির হতে হবে, না হলে সামাজিক সুস্থতা ঠিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
সাধারণভাবে ফাসাদী অপরাধের বিচার ইসলামে আছে। আর যারা মুরতাদ হয়ে অপরাধ করছে তাদের ব্যাপারেও ইসলামী শরিয়া স্পষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছে। রিদ্দাহ বা মুরতাদ হওয়া যদি ইসলামের বিপক্ষে ষড়যন্ত্রমূলক হয়, কোনো প্রোপাগান্ডা ও আন্দোলনরূপী হয়, তবে তার চূড়ান্ত শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু-দণ্ড। তবে তাকে অবশ্যই তওবা করার সুযোগ দেয়া হবে, ফিতনা থেকে ফিরে আসার অবকাশ দেয়া হবে এবং এতে শাস্তি রহিত হবে।
তবে বাংলাদেশ ইসলামী শারিয়া শাসিত কোনো দেশ নয়। সুতরাং ইসলামী আইনের কথা উল্লেখ করা হলেও তা অমনিতে প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু প্রচলিত বিধানেও তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার সরকারী উদ্যোগ ও সদিচ্ছা থাকলে ইসলামী আইনকেও আদালতি প্রক্রিয়ায় বা সংসদীয় প্রক্রিয়ায় (যেটি অধিক শুদ্ধ ও বিধিবদ্ধ) বৈধতা সৃষ্টি করে সেই ভিত্তিতেও বিচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা ইসলামী শারিয়া বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি শারিয়া কাউন্সিল সৃষ্টির মাধ্যমে আসতে পারে।
ফিতনা ফাসাদ ও সামাজিক বিপর্যয় নিয়ে কোরানে অনেক বক্তব্য আছে। এখানে কোরান থেকে কয়েকটি আয়াত বিবেচনার জন্য সামনে আনা হবে। তবে এগুলো আপাতত (tentative) হিসেবে, কারণ এই পরিসরে নেমে আলোচনাকে যে বৃহত্তর রূপ দেয়ার প্রয়োজন, সেই অবকাশ এখানে নেই। মনে রাখতে হবে কোনো আইন কেউই তার নিজ হাতে নিতে পারবে না এবং আইনী অঙ্গনের বাইরে এককভাবে যা-তা বলতে পারবে না, আইনের স্থান হচ্ছে আদালত, বিচারকই এগুলো বিবেচনা করেন।
কোরানের আলোকে সামাজিক বিপর্যয়
সামাজিক ফাসাদের মোকাবেলায় যে শব্দটি পরিভাষা হয়ে ব্যাপক অর্থ গ্রহণ করে সেটি হচ্ছে দ্বীন। ধর্মীয় ও পরকালীন অর্থ এক পাশে রেখে, দ্বীন হচ্ছে শাসন ব্যবস্থা ও জীবন ব্যবস্থা। আর এই ব্যবস্থাদ্বয় হচ্ছে ফাসাদের মোকাবেলায়। যে সমাজে দ্বীন ভেঙ্গে পড়ে সেই সমাজ ফাসাদে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, অর্থাৎ সেখানে আইন তার আপন স্থানে বলবৎ না থাকার কারণে মারামারি রাহাজানি থেকে শুরু করে ঠকা-ঠকি, জোর-জুলুম, জোর যার মুল্লুক তার ইত্যাদি বাস্তবতা হয়ে ওঠে। এমন সমাজে জীবন যাপনের রূপই (life style) ক্রমান্বয়ে মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক ফাসাদপূর্ণ সমাজকে তাই ন্যায়-পরায়ণ সমাজে ফিরিয়ে আনতে আল্লাহ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং বলেছেন তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠা কর, অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া বিধানকে কায়েম কর, যাতে করে ফাসাদ দূর হয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহ বলেন, তিনি সেই সত্তা যিনি তার রাসূলকে দ্বীনে-হক (সঠিক জীবন ব্যবস্থা) সহকারে পাঠিয়েছেন যেন এই ব্যবস্থা অপরাপর (ফাসাদী) ব্যবস্থাসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যদিও পৌত্তলিকগণ তা অপছন্দ করবে। (৬২:৯) আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যতক্ষণ পর্যন্ত না ফেতনার অবসান হয় এবং আল্লাহর দ্বীন [আল্লাহ প্রদত্ত সার্বিক শান্তির ব্যবস্থা] প্রতিষ্ঠিত হয়। (২:১৯৩)
মুসার (আ.) আহবানে ফিরাউন বুঝেছিল যে মুসার (আ.) হাতে শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যাবে তাই সে বলেছিল, তোমরা আমাকে ছাড়, মূসাকে হত্যা করতে দাও, ডাকুক সে তার পালনকর্তাকে! আমি আশংকা করি সে তোমাদের দ্বীনকে (শাসন ও সমাজ ব্যবস্থা) পরিবর্তিত করে দেবে অথবা সে দেশময় বিপর্যয় (ফাসাদ) সৃষ্টি করবে (৪০:২৬)। লক্ষণীয় যে যারা সমাজে ফাসাদের উদ্ভব ঘটায় এবং তা প্রতিষ্ঠিত রাখে, তারাই আবার সংস্কারকদেরকে ফাসাদের তোহমৎ দেয়। এখানে ফিরাউনও মুসাকে তা’ই বলেছিল। আমাদের দেশের সন্ত্রাসী দলগুলো ধর্মীয় দলকে দৌড়ের উপর রাখে কিন্তু ওরা ফিরে দাঁড়ালে ওদের উপর সন্ত্রাসের অভিযোগ দেয়।
এই আয়াতগুলোতে স্পষ্ট যে ফাসাদ ও দ্বীন দুটি সাংঘর্ষিক বস্তু। প্রথমটির ধারণায় আসে বিপর্যয় ও ফেতনা আর দ্বিতীয়টিতে আসে সুশাসন ও শান্তি। আমাদের দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা ও জীবন ব্যবস্থা ফাসাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে গণজীবন দুর্বিষহ। এই ফিতনার ব্যবস্থা আল্লাহ পছন্দ করেন না। আল্লাহর কাছে ফিতনা হচ্ছে হত্যার চেয়েও জঘন্য (২:১৭,১৯১)। কেননা এতে সর্বসাধারণ নিষ্পিষ্ট হয়। মানুষের জান-মালের, ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা থাকে না। হত্যা, ধর্ষণ,গুম, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি ‘নিয়ম’ (norm) হয়ে ওঠে। এই কাজগুলো (ফাসাদ) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করার মত। এভাবেই তা কোরানে এসেছে এবং কড়া শাস্তির কথা এসেছে। যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের সাথে যুদ্ধ (সংগ্রাম) করে এবং দেশে ফাসাদ (হাঙ্গামা) সৃষ্টি করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলীতে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি (৫:৩৩)। কিন্তু মনে রাখতে হবে এগুলো ইসলামী আদালতের দায়িত্ব। আইনকে কেউ নিজ হাতে তুলে নিতে নেই।
আজকে মুসলমানগণ কাফির নাস্তিকদের ফাসাদী জীবন ব্যবস্থার অধীনে বাস করছে। মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত করে তাদের আপন সাম্প্রদায়িক শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে। এর চেয়ে সাংঘাতিক ধাপ্পাবাজি আর কী হতে পারে? ইসলামী শাসন ব্যবস্থার কথা বললেই ওরা বলে ওঠে, আমরা এটা মানতে যাব কেন? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তাদেরটা আমরা মানতে যাব কেন? ওঠা তো ফাসাদ। তাদের এই ব্যবস্থায় একটি ফাসাদ দূর করতে গেলে আরও দশটি ফাসাদের সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই ফাসাদের ফিরিস্তি গগনচুম্বী হচ্ছে। কায়েমি স্বার্থের লোকজনই হচ্ছে এই ব্যবস্থার ধারক ও বাহক (ফিরাউন)। যারাই এই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে চাইবে, তাদেরকে এই ফিরাউনগণ ফাসাদী আখ্যা দেবে।
পরিশেষে দোয়া করি, হে আমাদের প্রভু, তুমি আমাদেরকে কাফিরদের ফিতনায় নিপতিত করো না। হে আমাদের প্রভু, আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও, নিশ্চয় তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৬০:৫)
সারাংশ
সারাংশে যে কয়টি আনতে চাই তা হল এই:
বাংলাদেশ হচ্ছে আদর্শিক দ্বন্দ্বের এক উর্বর ভূমি যেখানে দেশি বিদেশি দালাল ও এজেন্টরা কাজ করে। তবে নিম্ন শ্রেণীতে বেশির ভাগই প্রতারিত বলে মনে হয় –যারা খুলুসিয়্যাতের সাথে দলালদের সাথে দেশ গড়ার নামে কাজ করেন। এই ভূমিতে বিরোধী দলগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের উপর সব দিনই ঢিল দিতে আসে। তারা চায় ইসলামকে মুসলমানদের সামাজিক জীবন থেকে সরিয়ে দিতে এবং কৌশলে ইসলাম থেকেও। বিদ্বেষীরা নানান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেও মৈত্রীয়-ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ। তারা সংখ্যায় কম হলেও কৌশলে বলিয়ান। তারা মুসলমানদের বিভেদকে কেন্দ্র করে কাজ করে, প্রয়োজনে বিভেদের নতুন ফ্রন্ট তৈরি করে। ওরা মুসলমানদের উপর তাদের জীবন পদ্ধতি কৌশলে চাপিয়ে রেখেছে। কিন্তু এসব একটি কন্ট্রাক্টবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিক সমাজে ফলদায়ক হয় না।
ইসলামী রাজনীতি তথা ইসলামী শাসনতান্ত্রিক ও সমাজ সংশোধনীর স্বপ্ন উল্লেখিত মিত্রসম্প্রদায়ে মোটেই পছন্দের নয়। দ্বন্দ্ব এখানেই এবং তা আদর্শিক। যারাই এই ময়দানে আসবে তাদেরকে ওরা ‘নির্মূল’ করার প্রয়াস চালাবে, by hook or crook. কিন্তু এভাবে একটি বহু-জাতীয়, বহু-দলীয় সমাজ চলতে পারে না। রাজনৈতিক যুদ্ধ রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। গণতন্ত্র বললে গণতান্ত্রিক পথে হতে হবে। গণতন্ত্র চাই কিন্তু ইসলাম আসতে পারবে না –এটা তো হতে পারে না। ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে কাউকে তাড়ানোও যেতে পারে না। এটা সুস্থ সমাজের বৈশিষ্ট্য নয়। যারা অপ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদেরকে সনাক্ত করতে হবে, আদালতে হাজির করতে হবে। তাদের কর্ম-কাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। তা না হলে পৈতার ভূত সর্ষেতেই থেকে যাবে। বামুন শুধু ধোঁয়া তুলবে আর যার তার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করবে। দেশ আজ বিভক্ত, সময় কমিয়ে এসেছে।
বাংলার এই ভূখণ্ডটি সকল জাতি-গোষ্ঠীর ভূখণ্ড। বাঙালীয়ানার নামে সকল বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্য বিলিয়ে দিতে হবে না। আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের আপন আপন বৈশিষ্ট্যে রঙ-রূপ দিয়েছেন। কিন্তু সবাইকে সামাজিক প্রকৌশলে (by social engineering) এক করে ফেলাতে কোনো দূরদৃষ্টি নেই –বাগানের সব ফুল যদি লাল হয়ে ওঠে তবে সেই বাগানটি হবে ভীষণ বিরক্তিকর (boring)। একটি কন্ট্রাক্টবন্ধ সামাজিক জীবন ব্যবস্থায় এই বাঙালীয়ানার প্রকৌশল নিন্দনীয়, জাতির আওয়াল ও আখির এতেই কেন বিলীন হতে হবে? এটা কী? এর উপাদান কী? এগুলো কী চিরন্তন কিছু? এতে মানবতার কোন কোন কল্যাণ নিহিত? কি কারণে সকল রঙ কেবল লালেই আত্মাহুতি দেবে? আজ মুসলমানগণ নানান প্রতারণার ফাঁদে আবদ্ধ। আজকে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
কথা হচ্ছে যারা দেশের ৯০% মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপক্ষে হীন প্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালায় তারা সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে। এদেরকে সরকারী উদ্যোগে সনাক্ত করতে হবে, আদালতের আওতাভুক্ত করতে হবে। কিন্তু ভূত যদি তেলেই আশ্রয় নেয় তবে মুস্কিল – অর্থাৎ যদি তারা সরকারী শাড়ীর আঁচলে গাঁটটি বেঁধে থাকে যায় তবে এই ফাসাদ থেকে পরিত্রাণ নাই।
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন