বিজয়ের মাস ডিসেম্বর
লিখেছেন লিখেছেন শিব্বির আহমদ ওসমানী ০১ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৩:০৯:৩৮ দুপুর
শিব্বির আহমদ ওসমানীঃ আজ বিজয়ের মাস শুরু। এই ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙালি জাতির জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। হাজার বছরে বাঙালির জীবনে এই ডিসেম্বর অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ। এ জাতি কোনোদিন ভুলতে পারবে না মুক্তিযুদ্ধের সেই বীরত্বের কথা, স্বাধীনতার ঐশ্বর্য ও স্বজন হারানোর মর্মবেদনা।
সময়ের ভেলায় চড়ে আবারো এলো মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। প্রতিবছরই আসে দুর্নিবার আকাংকার বারতা নিয়ে। হেমন্তের নবান্ন আমোদন আর কুয়াশার চাদর জড়ানো এ মাসের সাথে জাতীয় জীবনের সম্পর্ক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আবেগের। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা, নিজস্ব মানচিত্র, নিজস্ব সত্তা-পরিচয় ও বিকাশের বীজ এ মাসেই পূর্ণরূপে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তাইতো যখনই ডিসেম্বর আসে তখন দেশপ্রেম ও দ্রোহের ফল্গুধারায় প্লাবিত হয় গোটা দেশ, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতিটি হৃদয়। আর এবারের ডিসেম্বর তার স্মৃতিময় জনপদে এসে শুনতে পাবে বন্দুকের গুলীবর্ষণের শব্দ, গোলাবারুদের ঝাঁঝালো গন্ধে চতুর্দিক বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রানত্মরে বাংলার আকাশে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল দুশত বছর পর হাজারো সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে আবার উদিত হয়েছে সেই অসত্মমিত সূর্য। এদেশের স্বাধীনতার জন্য এ জাতিকে বহুত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। মা-বোনের পবিত্র সম্ভ্রম ও ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে জাতি অর্জন করেছে স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে লাল সবুজের পতাকাবাহী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালির উপর। তারা মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে মেতে ওঠে এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞে। শাসকদের এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে সর্বসত্মরের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। শুরু হয় পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ। এ সময় এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী কিছু রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী পাক বাহিনীর সাথে আঁতাত করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। তারা পাক বাহিনীকে নিয়ে নীরহ মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে মেয়েদের সম্ভ্রম হানি করে।
সমকালীন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলে থাকেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মুক্ত করার উদ্যোগ-আয়োজন ছিল না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এ অঞ্চলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। আলোচনার নামে কথিত অগ্রগতির সংবাদ দিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়। এ অবস্থায় একাত্তরের ‘কালরাত’ পঁচিশে মার্চে নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। একাধারে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিধন শুরু হয়। এ সময় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। এমন এক উদ্বেগাকুল পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট) স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা পেয়ে দিকভ্রান্ত জাতি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এভাবেই পরাজিত পাকবাহিনীর রাহু থেকে বাংলাদেশ পৃথক দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয়।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি ছাত্রজনতা, কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ নানা পেশার মানুষ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বপ্নের স্বাধীনতার জন্য সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। সারা বাংলাব্যাপী মুক্তিবাহিনীর সাহসী সন্তানদের শ্বাসরুদ্ধ প্রতিরোধ যুদ্ধে ধরাশায়ী হয়ে পড়ে পাক বাহিনীর সৈন্যরা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধে পাক সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে বাঙালির বীর সন্তানদের কাছে এবং বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হয়। অর্জন করে স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চে জন্ম নেওয়া দেশটি এই মাসেই বিশ্বের মানচিত্রে একটা সার্বভৌম দেশ হিসাবে নিজের স্থান দখল করে। অন্তরের সকল শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করছি লক্ষ শহীদদের আর তাদের আত্নার মাগফেরাত কামনা করছি।
১৯৭১ এই সময়ে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সর্বাত্মক রূপ পেয়েছে। ১৯৭১ সালের এই দিনেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল শত্রু মুক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। সারাদেশে চলতে থাকে ব্যাপক যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের এই দিনে নিউইয়র্ক টাইমসের পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাবার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা পুনরায় গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার কতজন যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ের এই গ্রামটিতে অন্ততঃ ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী ও শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদে বক্তৃতাকালে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণের নির্দেশ দেয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণই সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। এই বক্তৃতায় তিনি ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
এদিন রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র জানান, অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার এখনও শেষ হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের চারটি রণাঙ্গনে যে আক্রমণাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।’ ৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন চালিয়ে ঢাকায় দুইজন মুসলিম লীগ কর্মীকে হত্যা করে। বাকী দুইজনকে বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা শেষরাতের দিকে সিলেটের শমশেরনগরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে। মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকবাহিনী এই এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার মুক্ত ঘোষণা করে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন অব্যাহত থাকায় পাকবাহিনী এই জেলার গারা, আলিরগাঁও, পিরিজপুর থেকে তাদের বাহিনী গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
এদিকে পিপলস পার্টির ঢাকা অফিস বোমা বিস্ফোরণের ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো দুমাস আগে এ অফিস উদ্বোধন করেন। রাঙ্গামাটিতে ব্যাপটিস্ট মিশন হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে চার্লস আর. হাউজার নামে একজন ধর্মযাজক এবং বহু বাঙ্গালী সন্ন্যাসী নিহত হন।
ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে আমরা স্মরণ করি জাতির সেসব বীর সন্তানদের, যারা এদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। স্মরণ করি যুদ্ধে পবিত্র সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের। শ্রদ্ধা করি যুদ্ধাহত সব মুক্তিযোদ্ধাদের।
এ বছর এমন এক ক্রান্তিকালে ডিসেম্বর এলো যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র বিপন্ন। বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর আজ দেশী-বিদেশী হায়েনাদের শ্যেনদৃষ্টি। কারো কারো রাজনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করার নিন্দনীয় মানসিকতায় দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধারা অব্যাহতভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। এতে যেন তাঁবেদার, ক্ষমতালোভীদের কিছুই যায়-আসে না। কিছু কিছু রাজনীতিকের সাম্প্রতিক বছরের কর্মকাণ্ডে দেশপ্রেমিক জনগণ নিজেরাই হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী। বিজয়ের মাসের আগমনে রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার দুর্জয় শপথের চেতনা আরেকটু শাণিত হবে বৈকি। সেই চেতনার প্রবল বাণে কূটচক্রের যতসব দুরভিসন্ধিমূলক আয়োজন ভেস্তে যাবেই যাবে।
http://amarbangla24.com/?p=18851
বিষয়: বিবিধ
২১৪১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন