লংমার্চে সরকারি হরতাল-অবরোধ; নাগরিকের চরম অধিকার লঙ্গন

লিখেছেন লিখেছেন শিব্বির আহমদ ওসমানী ০৪ মে, ২০১৩, ০৪:৩৭:২৫ বিকাল

শিব্বির আহমদ ওসমানী: নাস্তিক ব্লগার ও ইসলাম অবমাননাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের দুটি সম্পূর্ণ পৃথক রূপের প্রকাশ ঘটেছে। ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীনরা আসলে যে ন্যক্কারজনক প্রতারণাপূর্ণ কৌশল নিয়েছিলেন সে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়েছে। মুখে না বললেও সর্বান্তঃকরণে তারা ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিকদের পক্ষই নিয়েছিলেন। একদিকে সরকার সমাবেশের অনুমতি দিল আর অপরদিকে তাদের পালিত নাস্তিক ও মিত্রদের দিয়ে হরতাল-অবরোধ ডাকাসহ নিজস্ব উদ্যোগে সব যানবাহন বন্ধের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ইসলাম রক্ষার লংমার্চ ও মহাসমাবেশ বানচালের অপচেষ্টা চালাল। বাস-ট্রাক থেকে লঞ্চ-স্টিমার শুধু নয়, ট্রেন এবং বিভিন্ন ঘাটে নৌযান চলাচলও বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। তাছাড়া দেশের প্রতিটি এলাকায় পুলিশকে দিয়ে লংমার্চে অংশগ্রহণেচ্ছুদেরও সরকারই বাধাগ্রস্ত করেছে, ভয়ভীতি দেখিয়েছে। অবশ্য সরকারের এই অপচেষ্টাকে লক্ষ লক্ষ তৌহীদি জনতা ব্যর্থ করে দিয়েছে। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশস্থলে মানুষের ঠাঁই নেই। পিঁপড়ার মতো মানুষ ঢুকছে নগরীর বিভিন্ন প্রবেশ পথ দিয়ে। সব বাধা, সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাদের মিছিল এসে যোগ দিচ্ছে মহাসমাবেশে। এরই নাম গণজাগরণ। এই যে ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ইসলাম রক্ষার্থে রাজধানীতে জড়ো হচ্ছেন তারা কোনো সহিংসতায় বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন একমাত্র শান্তির পথ আল্লাহর পথ। আল্লাহ এবং রাসুল (সা.)-এ বিশ্বাসী এ মানুষগুলো স্বাধীনতা বিরোধী নয়। তারা শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে যেমন সর্বস্তরে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান তেমনি রক্ষা করতে চান অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। এরই নাম ইসলাম। এরই নাম শান্তি।

আওয়ামী লীগ সরকার মূখে সাংবিধানিক অধিকারের কথা বললেও বাস্তবে তারাই বেশী সাংবিধানিক অধিকার লঙ্গণ করছে। সরকারের দায়িত্ব হলো মানুষের নিরাপত্ত্বা দওয়া, মানুষকে নিরাপদে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেওয়া ও মানুষের সকল মৌলিক অধিকার সংরক্ষন করা। কিন্তু সরকার তা করছে না। বরং সরকার মানুষের নিরাপত্ত্বা না দিয়ে তার পালিত গোন্ডা ও সন্ত্রাস বাহিনী দিয়ে মানুষকে অত্যাচার করছে। আওয়ামী লীগ সরকার মানুষকে নিরাপদে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরিবর্তে তার গৃহপালিত ঘাদানিক, বাম, নাস্তিক ও শাহবাগীদের দিয়ে হরতাল-অবরোধ ডেকে মানুষের নিরাপদে চলাচলের অধিকারকে চরমভাবে লঙ্গন করছে।

হেফাজতে ইসলাম অভিযোগ করে বলছে, লংমার্চ ও মতিঝিলে মহাসমাবেশ থেকে ফেরার পথে বিভিন্ন স্থানে হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা, পুলিশের গুলি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওঁত্ পেতে থাকা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা হেফাজত কর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। অনেককে মারধর করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করার ঘটনাও ঘটেছে।

বিকালে রাজধানীর শিশুপার্ক এলাকায় ছাত্রলীগ ও শাহবাগি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের হামলা এবং পুলিশের গুলিতে হেফাজতে ইসলামের ১০ কর্মী আহত হয়েছেন। এ সময় তারা হেফাজতের কয়েকজন কর্মীকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আহতরা হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে গেলে সেখানেও হানা দেয় গণজাগরণ মঞ্চ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এই সবের মাধ্যমে সরকার দেশের ৯০ ভাগ নাগরিকের নিরাপদে চলাচলের অধিকারকে চরমভাবে লঙ্গন করছে। যেমন সংবিধানের ৩৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘Subject any reasonable restrictions imposed by law in the public interest, every citizen shall have t right to move freely throughout Bangladesh, to reside and settle in any place therein and to leave and re-enter Bangladesh.’’

সরকারের দায়িত্ব হলো সকল নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়’সহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করে দওয়া। অথচ নাস্তিক ব্লগার ও ইসলাম অবমাননাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের খাবার-দাবার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য মতিঝিল এবং এর আশেপাশের সব হোটেল-রেস্তরাঁ অগের দিনই বন্ধ করিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এমনকি ওয়াসার পানি পর্যন্ত সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। লংমার্চকারীরা যাতে একটু বসারও সুযোগ না পেতে পারেন সেজন্য মসজিদগুলোতেও তালা ঝুলিয়েছিলেন ক্ষমতাসীনরা। এর মাধ্যমে সরকার নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্গণ করেছে। যেমন সংবিধানের ১৫নং অনুচ্ছেদের (ক) তে বলা হয়েছে, ‘‘The provision of the basic necessities of life, including food, clothing, shelter, education and medical care;’’

সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। সকল নগরিক বা গোষ্ঠীকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা এবং সকলকে সমান অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদান করা। কিন্তু সরকার তা করছে না। সরকার দ্বৈত নীতি অবলম্বন করছে। সরকার একদিকে শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের দিনের পর দিন সভা-সমাবেশ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনকি দীর্ঘ দু’মাস পর্যন্ত এই নাস্তিক ব্লগাররা শাহবাগের মতো অত্যন্ত ব্যস্ত ও জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে জন-জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। স্বাভাবিক যানচলাচল তো বন্ধ হয়েছেই, গুরুতর অসুস্থ রোগীরা পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য বারডেম ও পিজি হাসপাতালে যেতে পারছেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাহবাগিদের উল্টো জামাই আদরে রেখেছে সরকার। তাদের জন্য প্যাকেটে প্যাকেটে বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও এবং হাজার হাজার বোতল মিনারেল ওয়াটার সরবরাহ করা হচ্ছে। স্থাপন করা হয়েছে মোবাইল টয়লেট। শুধু তা-ই নয়, বিজিবি, র্যা ব ও পুলিশকে দিয়ে সরকার চার স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে শাহবাগিদের জন্য। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ছাত্রলীগ ও বাম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। সরকারের ৭০ জন এমপি এবং বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী মঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শাহবাগিদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। অন্য সব পন্থায়ও সরকারের সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। সব রীতি ও নিয়ম লঙ্ঘন করে স্পিকার শুধু স্মারকলিপিই গ্রহণ করেননি, চা পানে আপ্যায়িত করার পাশাপাশি আন্দোলনের ব্যাপারে শাহবাগিদের পরামর্শও দিয়েছেন। জাতীয় সংসদও শাহবাগিদের নির্দেশে রাতারাতি আইন সংশোধন করেছে। এই প্রক্রিয়ায় সবশেষে ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নিজেও শাহবাগিদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেছেন। অথচ শাহবাগিরা জনগণের নির্বাচিত কোনো গ্রুপ বা গোষ্ঠী নয়। বড়কথা, তারা একদিকে দেশের আদালতকে চ্যালেঞ্জ করেছে, অন্যদিকে ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে নোংরা প্রচারণা চালাচ্ছে আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এবং ইসলামের বিরুদ্ধে। এমন এক অবস্থায় কর্তব্য যখন ছিল নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। সরকার তখন উল্টো প্রশ্রয় ও সহযোগিতা দিচ্ছে।

অপরদিকে, যখন শাহবাগিদের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন দেশের বিশিষ্ঠ আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। তারা শাহবাগের কথিত ব্লগারদের মঞ্চকে নাস্তিক মঞ্চ নামে আখ্যায়িত করে তা প্রতিহত করার ডাক দিয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে তাদের সমাবেশে ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। তখনি সরকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে অত্যাচার করছে। আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতিবাদ সমাবেশ করতে বাধা প্রদান করছে। এমনকি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আইনসম্মত লংমার্চকেও ভণ্ডুল করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছে সরকার। লংমার্চকে ভণ্ডুল করতে তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হয়রানী করছে। সরকারের এরকম দ্বৈত নীতি দেশের ৯০ ভাগ মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার চরমভাবে লঙ্গণ করছে। যেমন সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদের (১) এ বলা হয়েছে, ‘‘The State shall endeavour to ensure equality of opportunity to all citizens.’’

বাংলাদেশর মানুষ কতটা ধর্মভীরু কতটা ইসলামপ্রিয়—এই সমাবেশ তার প্রমাণ। অনেকে মনে করেন লক্ষ লক্ষ উপস্থিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যদি শাহবাগে থু-থু ফেলতো তাহলে ঈমানদারদের থু-থু’র বন্যায় নাস্তিকরা ভেসে যেত। গণজোয়ারের সামনে সরকারের বালির বাঁধ কত সহজেই ভেসে গেছে—তা দেখে সত্যিই আমি অবাক। এ দৃশ্য দেখে সরকার, শাহবাগী নাস্তিক, শাহরিয়ার কবির এবং তাদের দোসরদের জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, হে মান্যবরেরা আপনাদের এ গণজোয়ার রুখবার কি কোনো শক্তি আছে? এত চেষ্টা, এত বাধা—তারপরেও যে দৃশ্য তা দেখে আর কী বলবেন আপনারা? আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, প্রোটেকশন দিয়ে, ডোনেশন দিয়ে, বিরানী-পানি দিয়ে, ভাড়া করে লোক সাপ্লাই করে কোনো চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। চেতনার অনেক গভীরে। তার প্রকাশ ও বিকাশ পায় গভীরতা দিয়ে। যে ‘ইসলাম’, যে ‘নারায়ে তাকবীর’ আমাদের হৃদয়ে। তাকে বাধা দিয়ে এ দেশে অন্যকোনো ‘ফ্যাসিবাদী ও নাস্তিক্যবাদী স্লোগান’ প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ইসলামী চেতনার কোনো বিরোধ নেই। যারা প্রগতিশীলতার নামে ইসলাম বিরোধিতায় তৎপর হেফাজতে ইসলামের এই সমাবেশ তাদের জন্য একটি সতর্ক সঙ্কেত। বাঙালির সঙ্গে মুসলমানের সংঘর্ষ সৃষ্টি হলে তা হবে আমাদের জন্য একটি আত্মঘাতী বিষয়। আমাদের সবাইকে এটি উপলব্ধি করতে হবে। অন্যথায় বিপর্যয় অনিবার্য।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

E-mail:

বিষয়: বিবিধ

১২৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File