বাংলা নববর্ষ; নব জীবনের হাতছানি- শিব্বির আহমদ ওসমানী

লিখেছেন লিখেছেন শিব্বির আহমদ ওসমানী ২৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০৮:৪৫:৩৮ রাত

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

ঐ নূতনের কেতন ওড়ে

কালবোশেখীর ঝড়।’


দেখতে দেখতে আবরো আকাশে কালবোশেখীর আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। আরেকটি নতুন বছর উকি দিচ্ছে আমাদের খোলা জানালায়। আজ থেকে বলা হবে ১৪২০ সাল। পুরনো দিনের সব স্মতি পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি নতুন দিগন্তের দিকে। নুতুন এক বছরের উঠোনো। সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা আমাদের বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এভাবেই ঘুরে আসে পহেলা শৈাখাখ বা নতুন বছরের জয়গান। সবার জন্য রহিল বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছ। স্বাগতম বাংলা নববর্ষ ১৪২০।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর তিনটি নববর্ষ পালন করে থাকি। এইতো সাড়ে তিন মাস আগে ২০১২ সালকে বিদায় জানিয়ে উদযাপন করলাম ইংরেজি ২০১৩ সালের ১লা জানুয়ারী, ইংরেজি নববর্ষ। সারাবিশ্বে অবশ্য একইসাথে ইংরেজি নববর্ষ পালন করা হয়েছিলো। সব ভাষার, সব ধর্মের ও সব বর্ণের মানুষ ঐদিনটি ঘটাকরে উদযাপন করেছিলো। ৩১ শে ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে শুরু হলো Happy New Year 2013.

একইভাবে সারাবিশ্বের সব মুসলমানগণ পালন করেছি হিজরী নববর্ষ। আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হিজরী নববর্ষ শুরু হয় পহেলা মহররম। ১৪৩৩ হিজরী শেষ হলো ২৯ শে জিলহজ। পহেলা মহররম থেকে শুরু হলো আরবি নববর্ষ ১৪৩৪ হিজরী।

বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে দু'টি মত চালু আছে৷ প্রথম মত অনুযায়ী- প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খৃষ্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন৷ সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন৷ আধুনিক ভারতের বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অধিকাংশ এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ অনুমান করা হয় যে, জুলিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১২ এপ্রিল ৫৯৪ এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের সোমবার ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল৷

দ্বিতীয় মত অনুসারে, ভারতে ইসলামী শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরর চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। একারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর চাষাবাদ ও এজাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য ভারতের মোগল সম্রাট আকবারের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জীকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ওমর ফতুল্লাহ্ শিরাজির সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জীর অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খৃস্টাব্দে সম্রাট আকবার হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জীর প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্চির প্রথম মাস ছিল চৈত্র মাস। কিন্তু ৯৬৩ হিজরী সালের মুহাররাম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। বর্তমানে বাংলা নববর্ষ ইংরেজি বছরের নির্দিষ্ট এক দিনে হয়। ১৪ এপ্রিলই পহেলা বৈশাখ। এটি একদিক থেকে ভাল।

নবর্ষের এই দিনে ‘পুরনো কথা, কেউ ভূলে আর কেউ ভূলে না।’ জীবনের চাকা ঘুরতে ঘুরতে সামনে চলতে থাকে। পুরনো দিনকে পেছনে ফেলে আমরা সামনে চলি। গেয়ে উঠি নতুনের গাণ, সৃষ্টির গাণ, জবনের জয়গাঁতা। নতুন বছরকে বরণ করার এ আয়োজন কিন্তু নুতুন নয়। প্রাচীন গ্রিসবাসীও নতুন বছরকে সাড়ম্বরে উদযাপন করতো। ইরানের মানুষ বিগত আট হাজারেরও বেশী বছর ধরে প্রতি বছর পালন করে ‘নওরোজ’।

আমাদের এই দরিদ্র জনপদের মানুষও শত অভাব-অভিযোগের মাঝেও নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারী ইংরেজি নববর্ষের ও পহেলা বৈশাখের আগমনকে সামনে রেখে নিরাপত্ত্বার জন্য পুলিশ এমনকি সৈন্য নিয়োগ করতে হয় শহরের বড় বড় শড়কে এবং অভিজাত এলাকায়। হিজরী নববর্ষে তেমন কোনো আয়োজন করতে দেখা যায় না। কিন্তু বেশ ঘটা করে হৈই-চই করে পালন করা হয় পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ।

বছরের শুরুতে নারীপুরুষ সবার মাঝেই থাকে বর্ষকে বরণ করে নেয়ার অন্যরকম ব্যস্ততা। ব্যবসায়ীরা তাদের হাল খাতার মাধ্যমে পুরনো সব হিসাব নিকাশ আদায় করে নতুনভাবে বছর শুরু করেন। হাল খাতার দিন মহাজন/দোকানি টাকা পয়সা বুঝে নিয়ে মিষ্টি মূখ করায় এমনকি কেউ কেউ মা-ঝিদের জন্য মিষ্টির হাঁড়ি উপহার পাঠিয়ে দনে। গৃহিণীদের মধ্যে বিভিন্ন আয়োজনে সাথে থাকে নানারকম নাস্তা ও খাবার তৈরির প্রস্ত্ততি।

নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ হলো বৈশাখী মেলা। মেলায় নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপসহ থাকে নানাধরণের আয়োজন। এসবের পাশাপাশি চলে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলার খাবারের মধ্যে বাতাসা, বুন্দি, লুচি, জিলাপি, রসগোল্লা, ছানা, ক্ষীর, বিন্নিধানের খৈ, প্রভৃতি প্রধান। কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্প সামগ্রীসহ নানান ধরণের খেলনা রেশমিচুড়ি, রকমারি চুলের ফিতা ও প্রসাধনী মেলায় কিনতে পাওয়া যায়। এই দিনটি এলে শৈশবে বাবার আঙ্গুল ধরে মেলায় ঘুরে বেড়ানো, নাগরদোলায় চড়ে দোল খাওয়া বা ঘূর্ণিপাংখা নিয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে সেই দিনটিতে ফিরে যেতে কার না মন চায়। আবার দরিদ্র চাষির চেলেটি কিছু কিনতে না পরার বেদনায় মূখভার করে বসে থাকতেও দেখা যায়। সস্তা আলতা, চুরি কিন্তে না পেরে গরিবের মেয়ের চোখের পানি ঝরার ছবিও দেখা যায়।

নববর্ষে আমরা অনেকেই অনেকভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করি। ব্যাক্তিগত উপায়ে ইদানিং সব জায়গাতেই নববর্ষের কার্ড, হোক তা ছাপানো কিংবা নিজে বানানো, এই কার্ড বিনিময় হয় খুব। হৃদয়ের সব মাদূরী মিশিয়ে লিখা হয় এইসব কার্ডের ভাষা। কাছের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, স্নেহ-মমতা ঝরে পড়ে এইসব কার্ডে। ছড়া/কবিতা বা বন্ধুত্বের অকৃত্রিম ছোঁয়া জড়ানো আঞ্চলিক কথামালা- এসব থাকে নববর্র কার্ডে। অনেকে কার্ড ছাড়াও অন্যান্ন উপহার প্রদান করে থাকেন। তবে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম হলো কার্ড।

‘ভূলোনা আমায়, মায়ের স্মৃতি, বড় ভাইয়াকে’-তুলি এসব সুন্দর সুন্দর লেখা তোলা হাতপাখা, বালিশের কাবার এখনও বিনিময় হয় আবহমান বাংলায়। নববর্ষের সূচনা থেকেই গরমের যে যন্ত্রনা শুরু তার আগেই মায়েরা, বোনেরা, স্ত্রীরা তাদের প্রিয়জনদের জন্য স্মৃতি জাগানিয়া নববর্ষের উপহার ঠিক করে রাখেন যাতে বাতাষের প্রতিটি প্রশ তাদের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এভাবেই ঘুরে আসে নতুন বছর। নতুন দিন। আসে একের পর এক ‘গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত ও বসন্ত’। ছয় ঋতু ছয়টি রৃপে এসে আমাদের উঠানে ডাকাডাকি করে। জীবনে আমরা নানাভাবে নানা রঙ্গে দেখতে পাই। প্রতিটি নতুন বছরই আমাদের জন্য বয়ে আনে নব জীবনের বার্তা।

‘‘ঝরে গেছে ঝরার যা তা

ফুটবে আবার নতুন পাতা।’’

আমাদের জীবনের শাখে শাখে নতুন পাতা গজানোর দিন যেন এই পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ। অনেকেই নববর্ষে নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। নববর্ষের সিদ্ধান্ত অনেকের জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিতে পারে।

আমরা যারা বাংলা নববর্ষে হইচই করে, বাসন্তী শাড়ী-পাঞ্জাবী পরে, টোপর লাগিয়ে, সং সেজে, বটমূলে পান্তা-ইলিশ খেয়ে একদিনের বাঙ্গালী উৎসবে মেতে উঠি, তাদের কিন্তু এখনই ভাবনার দিন এসে গেছে। একদিনের বাঙ্গালী না সেজে সারা বছরের জন্য আদর্শবান ও নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন বাংলাদেশী হওয়ার শপথ নেয়ার এটাই সময়। আমরা শপথ নিতে পারি- ‘বাংলায় কথা বলার, বাংলাদেশকে ভালবাসার, দেশের সুস্থ পরিস্থিতি বজায় রাখার, বাংলাদেশকে শোষণমুক্ত করার, সবুজ ধ্বংস না করার, মা-বাবা ও বড়দের কথা শুনবো এবং শ্রদ্ধা করবো, অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার, ছোটদের আদর-স্নেহ করবো ও সকল মানুষকে ভালোবাসবো।’ তবে হ্যাঁ, কাগজে শপথ নয়, প্রয়োজন বাস্তব আয়োজনের।

এসো এবার নববর্ষে আমরা গ্লানিমুক্ত ও সুন্দর জীবনের স্বপ্নে মেতে উঠি। জীবনকে সাজাই সব নতুন স্বপ্ন ও সৃষ্টির প্রত্যয়ে। নতুনের আহবানে প্রতিদিনই হৃদয়ে বাজতে থাকুক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সেই অমর পংক্তিমালা ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক ঝরা/ অগ্নিস্নানে গুচি হোক ধরা/ থাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভূলে যাওয়া গীতি। যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।’ শুভ হোক নববর্ষ।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।

E-mail:

বিষয়: বিবিধ

২২৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File