ফিরে এসো অভিমানি (পর্ব-১)
লিখেছেন লিখেছেন জাহিদ পিয়াল ১২ অক্টোবর, ২০১৩, ০৭:০০:০১ সকাল
নীল কষ্টরা জমাট বেঁধেছে হিমেলের বুকে । দু'চোঁখের কিনারা বেয়ে অঝোরে কষ্টের ধারা বইছে। নিষ্পাপ মুখ খানা নিদারূন শূণ্যতা প্রকাশ করছে। অনার্স পড়ুয়া তরুণ ছেলেটা কাঁদছে। বড্ড বেমানান দৃশ্য। তবে কারনটা বেশ যথার্থ! হিমেল ওর কাল্পনিক নাম। মার্জিত রুচিবোধ, আধুনিক জীবন ধারা সহ শিক্ষা-দীক্ষায় ও খুব একটা পিছিয়ে নেই। নেই শুধু রাজকণ্যা মিথিলার ভালবাসা।
লাজুক প্রকৃতির মিষ্টি মেয়ে মিথিলা। আত্মীয়তার সুবাধে আগে থেকেই জানা-শোনা দু'জনার। দু'বোনের মধ্যে কনিষ্ঠ ও আদুরে কণ্যা মিথিলা।রুপ-লাবণ্যে, হাজারো গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ভালবাসার স্বর্গীয় প্রতিচ্ছবি। যেমনটা বিখ্যাত লেখক Charles John Dickens রচিত জনপ্রিয় উপন্যাস David Copperfield এর মুল চরিত্র David তার প্রেমিকা Agnes কে নিয়ে বলেছিলো "She was more than human to me. She was a Fairy, a Sylph, I don't know what she was - anything that no one ever saw, and everything that everybody ever wanted"
মিথিলা ওর আসল নাম না হলেও হিমেল এ নামেই ডাকে। বিধাতার আপন হাতে সূজিত অপরুপা এক রুপবতী। কাজল কালো চোখ, কোমর অবধি দীঘল-কালো কেশ। গোলাপি ঠোঁটের যাদুমাখা মিষ্টি হাসি যেন মাতোয়ারা করে তোলে ধরণীকে। বন্ধুরা বলে, প্রেয়সীর হাসি তড়কা রাক্ষসীর মতো হলেও মনে হয় তার মতো সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে না। তবে মিথিলার হাসি তড়কা রাক্ষসীর মতো নয়,তার হাসি নিখাদ সুন্দর। প্রকূতিও যেন হার মানে সেই বিমুগ্ধ হাসির কাছে।
হিমেলের বাল্য জীবনটা কেটেছে পল্লী মায়ের মেঠো পথ ধরে।কানামাছি,দাড়িয়াবান্ধা,হা-ডু-ডু ও লাঠি খেলায় ছিল বেশ পারদর্শী।নেশাগ্রস্থের মত বই পড়ত, কি দিন কি রাত?
শত ব্যস্ততার মাঝে “সম্পর্ক” নিয়ে ভাবেনি কখনোই। এমন কি কৈশরেও না। তবে সে সময় দৃঢ় এবং মজবুত সম্পর্কের বেশ গল্প শুনতো। ধীরে ধীরে দেখতে শুরু করলো সম্পর্কের নানা রুপ, রঙ ও বৈচিত্র্য।
কলেজ জীবনেও ছিল বই পোকা, সহপাঠী রমনীদের এড়িয়ে চলায় অহংকারী, বোকা আরো কত আজব বিশেষণে বিশেষায়িত হতে হয়েছে তাকে!
কিন্তু সময়ের স্রোতে সাতার না জেনেও মাইকেল ফেলেপস, ইয়ান থর্পদের মত ঝানু সাতারুদের পিছে ফেলে স্বপ্নের রাজকণ্যা মিথিলা কে জয় করার অভিযাত্রী আজ হিমেল।
"দূর দিগন্ত হতে
এ কোন অনুভূতি,
হদয়ের কাননে তুমি
ওগো নীল প্রজাপতি।
আশায় আশায় দিন যে
চলে যায় দু'জনার,
কবে আসবে সেইক্ষণ
একসাথে হারাবার"
ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতির সবুজ আঙিনা।কনকনে শীতে পলাশ, শিমুল ও কূষ্ণচুড়ার ডালে ডালে বসন্তের ছোয়া। বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ যেন জীবনকেও রাঙিয়ে যাচ্ছে। এমন-ই নিঝুম রাতে জোনাকীর আলো জানালা দিয়ে উকি মারছে। জানালার পর্দা টেনে বুকের উপর ম্যাক বুক টা নিয়ে শুয়ে পড়লো হিমেল। ফিজিক্সের উপর ডকুমেন্টারীর বাকীটা দেখবে বলে। নাহ! জোনাকীর আলোয় এটা ঠিক যাচ্ছে না। জোৎস্নার সাথে রোমান্টিক মুভি হলেই বা মন্দ কিসে!
মুভি শেষ না হতেই যথারীতি ঘুমিয়ে পড়লো আজো। অবচেতন হিমেল হারিয়ে গেল স্বপ্নের স্বর্গরাজ্যে। নিটোল পায়ে এক রমনীর রুনুঝুনু নুপুরের শব্দ বাতাসে। ক্ষীণ হয়ে আসছে পায়েলের ধ্বনি। পিন-পতন নীরবতা ভেঙ্গে হিমেলের হদয়াকাশে উদ্ভাসিত হল এক নক্ষত্রতুল্য স্বর্গীয় রমনী। নিঃসঙ্গ হিমেলের জীবনে রচিত হলো রঙ্গিন অধ্যায়। নব সঙ্গীনীর হঠাৎ আগমনে উদাসীন চোখে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাকিয়ে আছে হিমেল। খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে পরক্ষণেই পুলকিত বোধ করল। কারণ হিমেলের ভাগ্যাকাশে আজ সূর্য রশ্মির আলোকছটা। যাকে হিমেল ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করেনি বা করার কথাও নয়, সেই মিথিলাই আজ উকি দিচ্ছে এমন রুপে যা ছিল সত্যিই কল্পনাতীত। ঘুম ভাঙ্গলেও ঘোর কাটছে না হিমেলের। কী দেখলাম আমি!? নাহ! একি ভাবছি আমি!
রাত পৌনে তিনটা, ঝট-পট করে উঠে বসল হিমেল। সকালে ক্লাশ কিংবা অফিসের ঝামেলা নেই আজ। ইজি চেয়ারে শরীর এলিয়ে মিউজিক শুনছে। কখন যে নির্ঘুম একটা রাত কেটে গেল! সবকিছু ওলট-পালট হতে লাগলো। হিমেলের প্রতিটি ধমনীতে মিথিলার উপস্হিতি অনুভূত হচ্ছে, এ যেন জীবনের সর্বশেষ্ঠ পাওয়া!
কিন্তু তথাকথিত সমাজ ও পরিবারের কথাও ভাবতে হচ্ছে তাকে। নাহ! এ স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। কিছুদিন অনেকটা জোর করেই সংবরণ করলো নিজেকে।
কিন্তু,
"কপালের লিখন, না যায় খন্ডন" সকল কল্পনার অবসান ঘটলো আজ। বিধাতা মিথিলাকে আরো কাছে এনে দিল কোনো এক মাধ্যমে। শুরু হলো স্বপ্নচারী ও স্বপ্নচারিনীর কথা বিনিময়।
তখন রাত প্রায় দু'টা। প্রিয় শিল্পীর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে হিমেল।
হঠাৎ,
ঠক! ঠক! (শব্দ)
দরজা খুলেতেই অবাক হল হিমেল।
সে কি!!!
এতো রাতে তুমি?!
মিথিলার মুখটা ছিল বেশ গম্ভীর। চুলগুলো এলোমেলো। এক বুক অভিমান নিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে অপলক।
কী হয়েছে তোমার? জানতে চাইলো হিমেল।
কিছুই হয়নি! তোমার সাথে কথা নেই। আমাকে নিয়ে ভাবার সময় কৈ তোমার?
আহা! এমন করে বলছো কেন! মন খারাপ তোমার?
জানি না। তবে বড্ড একা লাগছে।
তাই বলো। আমি ভাবলাম অন্যকিছু। যাইহোক, এতো রাতে তুমি এখানে! কেউ দেখে ফেললে দু'জনকেই বকা খেতে হবে তো!
আমি কাউকে ভয় করিনা।
মিথিলার মুখে এমন কথায় অবাক হিমেল।কেনো এসেছো, বলো না প্লীজ!
কেন! আমি কি আসতে পারি না তোমার কাছে?
হুম, পারো। কিন্তু!
কিন্তু কি?
ও কিছু না! বাদ দাও তো। এবার বলো কি মনে করে এতো রাতে?
হিমেল আমি কি তোমার হাতটা ধরতে পারি?
আচ্ছা ধর! এবার বলো।
আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না। কি বলতে চাই তুমি জানো না?
হুম্ জানি তো। কিন্তু সে কি সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়? কি নেই তোমার? নাকি আমায় তুমি আপন করে পেতে চাওনা? তাছাড়া তুমি চাইলে সবাইকে ম্যানেজ করতে পারবা। জানো! ইদানিং তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছি না।
তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো? হিমেল জানতে চাইলো।
হ্যাঁ!
আমাকে ছেঁড়ে যাবে না তো?
তোমার এমন মনে হয়?
না।
তাহলে?
এবার হিমেল ও নিজেকে আর লুকাতে পারল না। মনের অজান্তেই বলে ফেললো হদয়ের গহীনে জমানো না বলা কথাগুলো।
তাহলে আমায় কথা দাও, শত ঝড়-বন্যায় ও আমাকে ছেড়ে যাবে না।
কথা দিলাম তোমার ভালবাসার কোনো অমর্যাদা হতে দেব না। তোমার স্থানটা শুধুই তোমার, সেটা কোনদিনও আর কারো হবে না।
হঠাৎ ঘড়ির এলার্ম বেজে উঠলো।
ঘুম ভেন্গে গেল হিমেলের। কেমন যেন লাগছিল!
কী দেখলাম আমি!!!
বাস্তবে মিথিলা ছিল একদম উল্টো।
শুরু হল ভাবনা আর শিহরণের। আসলেই কি মিথিলা আময় নিয়ে ভাবছে? নাহ! ওর কথা শুনে তো তা মনে হয় না! নিজেকে হারিয়ে ফেললো মিথিলার মাঝে। কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না হিমেল। বাড়তে থাকলো প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার অদম্য বাসনা। সবকিছু ভুলে সেই রাতেই শপথ নিল মিথিলাকে জয় করে ওর মুখে হাসি ফোটাবে বলে। বলিউডের রজনিকান্ত "Robot" মুভিটা নির্মাণ করে দেখিয়েছিলেন, নারীরা শুধু পুরুষদের না, মেশিনের মাথাও নষ্ট করে দিতে পারে সূতরাং হিমেলের-ই বা কি অপরাধ?
হিমেলের বর্ণহীন জীবনে কেবল মিথিলাকে পাওয়ার আশাটুকুই রঙ্গিন। রঙ্গিনের নেশায় কেটে গেল বেশ কিছু দিন। অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকলো হিমেল,ভালবাসার কথাগুলো প্রিয়জনকে জানাতেই হবে! নিরাপদ ভেবে সামাজিক মাধ্যমেই দু'জনার যোগাযোগ সীমাবদ্ধ ছিল । সকাল বিকাল মিথিলাকে নিয়েই যত ভাবনা আর মন বীণায় নজরুলের সূর,,,,,
"মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী
দেব খোঁপায় তারার ফুল ।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির,
চৈতী চাঁদের দুল ।
বিজলী জরীণ ফিতায় বাঁধিব,
মেঘ রং এলো চুল ।
জ্যোছনার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রং ছানি,
আলতা পরাব পায় ।
আমার গানের সাত-সুর দিয়া,
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া ।
তোমারে ঘেরিয়া গাহিবে আমার,
কবিতার বুলবুল ।"
হিমেলের ধারণা, মিথিলার হৃদয় হয়তো একদিন ওর প্রতি কোমল হয়ে উঠবে। বুঝতে পারবে কতটা ভালবাসে ওকে।ততক্ষণে মিথিলাও হয়তো কিছুটা আচ করতে পেরেছে।
কারন, হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন-
‘‘পৃথিবীর সব মেয়েদের ভেতর অলৌকিক একটা ক্ষমতা থাকে। কোন পুরুষ তার প্রেমে পড়লে মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারে।"
হিমেলের জীবন-ধারণটাও বেশ পাল্টে গেছে, সকালে ঘুম থেকে ওঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত মিথিলাই যেন হিমেলের ভাবনা।
একবার,
আফিস থেকে বাসায় ফিরে মিথিলার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে হিমেল। অপলক মায়াবী চাহনি দেখে খানিকটা লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসল মিথিলা। কৌতুকময় চোখে জিজ্ঞেস করলো,কি হচ্ছে এসব?! এই বয়সেও তুমি....!
শুনো প্রেমিকরা কখনও বুড়ো হয় না ! তারা সদা তরুণ, বলতেই হেসে দিল মিথিলা।
আজ মিথিলার মনটা বেশ ফুরফুরে, আপন হাতের মাধুরী মিশিয়ে পটল ভর্তা, বড় দেখে গলদা চিংড়ির দোপেঁয়াজা, টমেটো দিয়ে টেংরা মাছের ঝোল আর স্বর্ষে ইলিশ রান্না করে রেখেছে। এগুলো হিমেলের পছন্দের ডিশ।
খাবার টেবিলে এসে হিমেল তো অবাক!
সবগুলো পছন্দের মেনু!
মিথিলাকে আলতো ভাবে দু'বাহু বন্ধি করে ললাটে ঠোট দু'টো একে দিল। তোমাকে না বলেছি মনদিয়ে ষ্টাডি করতে? পরীক্ষায় ভর্তা, দোপেঁয়াজা আর টেংরা মাছের ঝোল কোন কাজে লাগবে শুনি?
মিথিলার সরল উক্তি,
একে অপরের চাওয়া-পাওয়া, ভাললাগা গুলোই যদি পূরণ করতে না পারি তবে সেই লেখা-পড়া করতে আমার বয়েই গেছে!
শুনে ভালই লাগল!অবাক নয়নে মিথিলার মুখপানে তাকিয়ে রইলো হিমেল। কতটা যতন করে পুষছে আমার ভাললাগাকে। আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলো মিথিলাকে। এতো সত্যিই জীবনের পরম পাওয়া কিন্তু সে পাওয়াটা শুধু স্বপ্নেই থেকে গেল। ঘুম ভাঙ্গলো হিমেলের।
চলবে,,,,,,,,,,
(একটি বাস্তব জীবনের অবলম্বনে রচিত)
লেখক; ব্লগার এমডি জাহিদুল ইসলাম
বিষয়: বিবিধ
৩৩৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন