টিফা চুক্তি, মিষ্টির মোড়কে বিষ

লিখেছেন লিখেছেন জাহিদ পিয়াল ০৫ জুন, ২০১৩, ১০:০৪:৩২ রাত

লাল-সবুজে ঘেরা ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ।যা কিনা বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে সাগরসম রক্তের বিনিময়ে। কিন্তু শকূনের লোলুপ দৃষ্টি আজও শংকিত করে তোলেছে এ দেশটাকে।বিশ্ব শকূনের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’ বা ‘টিকফা’ চুক্তির মোড়কে ছোঁ মারতে একের পর এক ফন্দি এটে যাচ্ছে। কখনো বাণিজ্য সুবিধা, পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, কৌশলগত স্বার্থ ইত্যাদি নানান মিষ্টি প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশকে টিফার বিষাক্ত ক্যাপসুল গেলানোর জন্য চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি। বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠিগুলো নিজেদের অপকর্মকে ঢাকতে, হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে এ বিষয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতেও কুন্ঠাবোধ করে না।

‘টিফা’/‘টিকফা’ চুক্তি কী ?

মূলত ‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreement বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় বলা যায়— ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operation Framework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।



গত কয়েকদিন আগে সাভারের মর্মান্তিক দূর্ঘটনার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা নিয়ে এ সংক্রান্ত একটা রিপোর্ট পড়ি, তারপর এ নিয়ে কিছু স্টাডি করার চেষ্টা করেছি, যতই এগুছি ততই এর ভয়াবহতা স্পষ্ট হতে লাগল।

নামে এটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি হলেও মূলত এটি মিষ্টির মোড়কে মোড়ানো বিশ্ব মোড়ল কর্তূক শোষণের প্রাথমিক একটি অনুমতি পত্র, এক কথায় মিষ্টির মোড়কে বিষ।

গত ২০ মে, ২০১৩ প্রথম আলো রিপোর্ট করে, "কার্যত জিএসপির সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তির (টিকফা) সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও এটি সই হলে জিএসপি অব্যাহত রাখাটা নিশ্চিত হবে বলে একটি মহল মনে করছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। গত এপ্রিলে টিকফার ব্যাপারে একটি সারসংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রী সই করেন। জিএসপির ব্যাপারে আগামী জুনে যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। তার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইতিবাচক বার্তা দিতে টিকফা সইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে সূত্র জানায়"

সূত্র লিংক: http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-05-20/news/353603

এর আগে এফ মরিয়ার্টি মার্কিন রাষ্ট্রদূত থাকাকালে বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে টিফা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। শুনে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, "তবে তাই হোক। কাগজপত্র তো তৈরিই আছে। আর তার পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আসলে টিফা থেকে আমাদের অনেক লাভবান হবার সুযোগ আছে।" সংবিধানের ১৪৫(ক) ধারা অনুসারে বিদেশের সাথে চুক্তি করতে হলে জাতীয় সংসদে আলোচনার যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটা পালন করার ব্যাপারে অন্যান্য জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তির মতো টিফা/টিকফা চুক্তির ক্ষেত্রেও সরকারের কোন উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই।

কিন্তু, বর্তমান দিন বদলের সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশিত ছিল অন্যরকম বক্তব্য। যদি কথাটা হত এরকম যে- মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রস্তাব দিয়েছেন, ঠিক আছে, আমরা সংসদে আলোচনা করি, দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ-রাজনীতিবিদদের-জনগণের মতামত নিই। তারপর আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব। কিন্তু গত সরকারগুলোর আমলে যেমন হয়েছে, এবারও তাই হল। সংসদ বা জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বদলে সেই একলা চলো নীতি-ই অবলম্বন করল।

আবার বুঝি বেজে উঠলো সেই ঢোল, গতকাল একটা রিপোর্টে আসলো ২৪ জুন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারতে এক সফরে আসবেন। এই সফরেরই অংশ হিসাবে তিনি সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা ঘুরে যাবেন বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।এমন এক সময়ে কেরি ঢাকা আসছেন যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি (টিকফা) স্বাক্ষর থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা (জিএসপি) থাকা না থাকার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই মূহুর্তে এত সংক্ষিপ্ত সফরের হেতু কি? তারা মূলত বাংলাদেশের সামনে মূলা ঝুলিয়ে/কেক প্রদর্শন করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়।



২০০৫ সালে বাংলাদেশের সাথে প্রস্তাবিত টিফা চুক্তির একটা কপি bilaterals.org ওয়েবসাইটে ফাস করে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওয়েবসাইট থেকে সহজেই দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র টিফা’র একটা সাধারণ ফরমেট বজায় রাখে যে ফরমেটের মূল ধারাগুলো এ পর্যন্ত যে ৬১ টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র টিফা স্বাক্ষর করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে মোটামুটি একই রকমের।

সূত্র লিংক: ১, http://www.bilaterals.org/spip.php?article1361

২, http://www.ustr.gov/trade-agreements/trade-investment-framework-agreements

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ টিফা চুক্তির খসড়া:

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০/০১/২০০৫ সালে সম্পাদিত সম্ভাব্য TIFA চুক্তির খসড়া।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-

১) দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বের বন্ধন ও সহযোগিতার চেতনা উন্নত করার আকাঙ্খা পোষণ করে;

২) ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এর মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের বৃহত্তর কল্যানের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ;

৩) উভয় দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক আন্ত:সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়ার আকাঙ্খা পোষণ করে;

৪) আন্তর্জতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির আকাঙ্খা পোষণ করে;

৫) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অবাধ পরিবেশ তৈরীর গুরুত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

৬) উভয় পক্ষের জন্যই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যক্রম বৃদ্ধি লাভজনক এবং সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উভয় পক্ষকেই এইসব সুফল থেকে বঞ্চিত করে- এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

৭) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায়(WTO) উভয় দেশের সদস্য পদের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে এবং WTO এর প্রতিষ্ঠাতা চুক্তি Marrakesh Agreement এবং অন্যান্য চুক্তি ও সমোঝাতা এবং এর সাথে সম্পর্কিত ও এর পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় থাকা অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট ইত্যাদির আওতার মাঝে প্রত্যেক পক্ষের নিজস্ব অধিকার ও বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে;

৮)প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাণিজ্য বিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করা ইত্যাদির জন্য দেশী এবং বিদেশী ঊভয় ধরণের বেসরকারী বিনিয়োগের আবশ্যিক ভূমিকার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

৯) দুই দেশের মধ্যকার বেসরকারী খাতের কণ্ট্রাক্ট কে উৎসাহিত করা এবং সুবিধাদি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে;

১০) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক সমস্যাগুলোর যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের আকাঙ্খাকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

১১) বিনিয়োগ বিষয়ে পারস্পরিক অনুপ্রেরণা এবং সংরক্ষণের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাঝে মার্চ ১২, ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরকৃত চুক্তির (Bilateral Investment Treaty) স্বীকৃতি প্রদান করে;

১২) এই চুক্তি প্যারাগ্রাফ ১১ তে উল্লেখিত চুক্তির আওতায় উভয় পক্ষের অধিকার ও বাধ্যবাধকতাগুলোকে অস্বীকার করে না;

১৩) দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ও উভয়ের অর্থনীতিতে সেবা খাতের বাণিজ্য বৃদ্ধির গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;

১৪) উভয় দেশের বাজারে প্রবেশের সুবিধাদি বৃদ্ধি করার জন্য অ-শুল্ক বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এর ফলে পারস্পরিক সুফল পাওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে;

১৫) বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার বা intellectual property rights (Trade-Related Aspects of Intellectual (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights (TRIPS) বিষয়ক চুক্তি বা অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষার প্রচলিত নীতি ) এর পর্যাপ্ত এবং কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে।

১৬) প্রত্যেক দেশের নিজ নিজ শ্রম আইনের পর্যাপ্ত ও কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত শ্রমিক ব্যবস্থাপনা (labor standards) আরও ভাল ভাবে মেনে চলা গুরুত্ব স্বীকার করে;

১৭) টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক এবং পরিবেশবিষয়ক নীতি মালা নিশ্চিত করতে ইচ্ছা পোষণ করে

১৮) আকাঙ্খাকা পোষণ করে যে এই কাঠামোগত চুক্তি (Framework Agreement ) দোহা উন্নয়ন এজেন্ডা সফলভাবে পরিপূর্ণ করার লক্ষে যৌথ প্রচেষ্টা জোরদার করার মাধ্যমে বহুপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করবে; এবং

১৯) উভয় দেশের বাণিজ্য উদারীকরণ ও নিজেদের মধ্যকার বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্বি-পাক্ষিক প্রকৃয়া প্রতিষ্ঠা উভয় দেশের জন্য লাভজনক- এই বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে।

এ লক্ষ্যে উভয় পক্ষ নিম্নোক্ত বিষয়ে একমত পোষণ করছেঃ

আর্টিকেল একঃ চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় এই চুক্তির আওতায় নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা খাত সম্প্রসারিত করবে। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চাহিদা মোতাবেক সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের লক্ষ্যে পণ্য ও সেবা খাত অধিকতর নিরাপদ ও দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য সহজতর করার উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

আর্টিকেল দুই: চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করবে। কাউন্সিলে দুই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বাংলাদেশ পক্ষের সভাপতি থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী হবে United States Trade Represntative (USTR)। দুই পক্ষই তাদের যথাযথ পরিস্থিতি ও প্রয়োজনানুযায়ী সরকারের অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারবে। কাউন্সিল নিজ কাজের সুবিধার্থে ঐকমত্য সহকারে অথবা আলাদাভাবে Joint Working Group প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।

আর্টিকেল তিনঃ কাউন্সিলের উদ্দেশ্যাবলী হবে নিম্নরূপঃ

১·বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্র সনাক্তকরণ এবং যথাযথ ফোরামে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

২·চুক্তির আওতার বাইরে বিশেষ বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয়কে চুক্তির নিয়মাবলী অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা।

৩·দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে বাধাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও অপসারণ

৪·কাউন্সিলের সাথে যুক্ত বিষয়ে চুক্তিকারী পক্ষদ্বয়কে যথাযথ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর থেকে প্রয়োজনীয় উপদেশ গ্রহণে সাহায্য করা।

আর্টিকেল চারঃ দ্বি-পাক্ষীয় এই চুক্তির আওতার বাইরে কোন পরিস্থিতির উদ্‌ভব হলে কাউন্সিল পক্ষদ্বয়ের যে কোন একটির অনুরোধে সুবিধাজনক সময়ে ও স্থানে আলোচনায় বসতে পারে। কোন অবস্থাতেই কোন পক্ষ এককভাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না যা দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

আর্টিকেল পাঁচঃ এই চুক্তিটি কোন পক্ষের প্রচলিত অভ্যন্তরীণ আইন এবং কোন পক্ষের স্বাক্ষরিত অন্যকোন চুক্তির ফলে প্রাপ্য অধিকার ও দায়বদ্ধতাকে ব্যাহত করবে না।

আর্টিকেল ছয়ঃ চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকেই এটা দুই দেশে কার্যকর বলে গণ্য করা হবে।

আর্টিকেল সাতঃ এই চুক্তি দ্বি-পাক্ষীয় সম্মতিতে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কিংবা এক পক্ষ দ্বারা অপর পক্ষকে ছয় মাসের পূর্ব নির্ধারিত নোটিশ ব্যতিরেকে, য়থাশক্তিতে বলবৎ থাকবে।



টিফা কি শুধুই বাণিজ্য চুক্তি?

এখানেই রয়েছে বিশাল এক দূরভিসন্ধি, টিফা চুক্তির প্রস্তাবনা কিংবা ধারায় ব্যাবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি কথা থাকলেও চুক্তির ব্যাবহার কিন্তু স্রেফ বাণিজ্যিক নয়। উল্ল্যেখিত উইকিলিকস প্রকাশিত বার্তা থেকে দেখা যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের সাথে টিফা স্বাক্ষরের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন:

“I would like to stress our compelling political, economic, and potentially commercial reasons for securing a TIFA with Bangladesh….We have important strategic reasons for helping Bangladesh succeed, politically and economically, and approving the Bangladesh TIFA would be a significant step in thatdirection.”

সূত্র লিংক: http://wikileaks.org/cable/2005/06/05DHAKA2799.html

কাজেই দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থই নয়, সেই সাথে রাজনৈতিক ও কৌশলগত কারণেও বাংলাদেশের সাথে টিফা স্বাক্ষরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বাস্তবে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে স্বল্পন্নোত দেশগুলো জোট বাধতে থাকায় মার্কিনযুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে তার স্বার্থ হাসিল করা ক্রমশ কঠিন হয়েপড়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার লক্ষ হলো বহুপাক্ষিক ফোরামে তার স্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বন্ধ ওদুর্বল দেশগুলোর সাথে আলাদা আলাদা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে একদিকে অধিকতর বাণিজ্য সুবিধা আদায় অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে প্রাধান্যবিস্তার। এই প্রেক্ষিতে একটা বিষয় লক্ষণীয়। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যতগুলো দেশের সাথে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তার কোনটির সাথেই কিন্তু তার সম্পর্ক স্রেফ বাণিজ্য কেন্দ্রিক নয়। সবচেয়ে বাণিজ্যিক লেনদেন যেসব দেশের সাথে যেমন: কানাডা, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ইত্যাদির সাথে কিন্তু আমেরিকার কোন টিফা নেই। টিফা আছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সাথে,দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্তমহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের সাথে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, বাহরাইন, মিশর, জর্জিয়া, আইসল্যান্ড, ইরাক, কুয়েত, লেবানন, ওমান, কাতার, সৌদিআরব, টিউনিশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেনের সাথে, আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে ক্যারীবিয়ান দেশগুলো ও উরুগুয়ের সাথে এবং আফ্রিকা অঞ্চলের মধ্যে অ্যাঙ্গোলা, ঘানা, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশের সাথে। সূতরাং টিফা নামের এই বাণিজ্য চুক্তিটি আসলে যতটা না বাণিজ্য বিষয়ক তার চেয়ে অনেক বেশি আমেরিকার রাজনৈতিক-সামরিক কৌশলগত অস্ত্র।

সূত্র লিংক: http://www.ustr.gov/trade-agreements/trade-investment-framework-agreements

শ্রমনীতি ও জিএসপি প্রসঙ্গ:

টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র দুটি বিষয়কে সামনে টেনে এনেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমমান কার্যকর করতে হবে এবং টিকফা স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি (অগ্রাধিকারভুক্ত পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার) সুবিধা পাবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এর মাধ্যমে শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতের চেয়ে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ছড়ি ঘুরানোর ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে। বাংলাদেশ চাইলেও সহসা শ্রমমান নিশ্চিতের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত পণ্যের প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে এটা বাধা হিসেবে কাজ করবে।

তথাকথিত জিএসপি সুবিধা ও বাজার উন্মুক্তকরণ:

অনেকেই মনে করেন যে, টিফা হল মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের পূর্ব ধাপ। আমেরিকা যত দেশের সাথে টিফা স্বাক্ষর করেছে পরবর্তিতে তাদের তিন ভাগের এক ভাগের সাথে ইতোমধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরও করেছে। বাংলাদেশের বেলায়ও যে তা হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন এর আগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সফরে আসা আমেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধি ডিলানি। তিনি বলেছেন:

“Tifa can be a stepping stone to future trade agreements between our nations, but at its heart Tifa is simply an agreement in which both sides agree to meet regularly and explore opportunities to expand economic relations.”

সূত্র লিংক: http://www.thedailystar.net/newDesign/news-details.php?nid=110612

আর এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তার যে কোন দিকে যাবে তার ইঙ্গিত পরিস্কার ভাবে টিফা চুক্তির ১৪ নং প্রস্তাবনায় উল্লিখিত অশুল্ক বাধা দূর করণ ও প্রস্তাবণা ১৯ এ উল্লিখিত বাণিজ্য উদারীকরণের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব আরোপ করা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এর আগের বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার চুক্তি অনুসারে আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলোতে বাংলাদেশের মতো সল্পোন্নুত দেশ গুলোর মোট ৯৭% পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেয়ার কথা। অর্থাৎ কোন স্বল্পোন্নত দেশ ১০০টি পণ্য রপ্তানি করলে ৯৭ টি বিনা শুল্কে রপ্তানি করতে পারবে এবং বাকি ৩ টি পণ্যের ক্ষেত্রে তাকে শুল্ক দিয়ে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে হবে। আমেরিকা বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পন্য যেমন: গার্মেন্টস পণ্য, চামড়াজাত পণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যকে এই ৩% এর মধ্যে ফেলে দেয়ায় বাংলাদেশ কার্যত এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্য শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই পাচ্ছে না। উল্টো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গড় শুল্কহার ১২% হলেও বাংলাদেশকে আমেরিকার বাজারে ঢুকতে হলে ১৬% শুল্ক দিয়ে ঢুকতে হয়।

প্রশ্ন হলো টিফা হলে কি বাংলাদেশের গার্মেন্টস বা অন্যান্য পণ্য এই ৩% এর বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে? টিফা চুক্তিতে এ বিষয়ে কোন কথাই নেই। চুক্তিতে অ-শুল্ক বাধা বা নন ট্যারিফ ব্যারিয়ার উভয় দেশেরই তুলে নেয়ার কথা থাকলেও ট্যারিফ বা শুল্ক মুক্ত বাজার সুবিধার কিছুই নেই। টিফার আওতায় বাংলাদেশ যে এ ধরণের কোন কিছুই পাবেনা তা ডিলানির নসিহত থেকেও স্পষ্ট, তিনি মনে করেন:

”শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার চেয়ে বরং শুল্ক হ্রাস এবং অগ্রাধিকার সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ চালিয়ে যাওয়া উচিত — আর তৃতীয় বিকল্প হতে পারে দ্বিপক্ষীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি(এফটিএ)।”

অর্থাৎ ভয়ংকর ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকার বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশের কোন সুযোগ যে নেই সেটা স্পষ্ট। আর জিএসপি সুবিধা রক্ষার বিনিময়ে টিফা/টিকফা চুক্তি জায়েজ করার জন্য যেসব কথা বলা হচ্ছেতা ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।

অভিজ্ঞাতার আলোকে টিফার রুপ:

বিভিন্ন দেশে টিফা চুক্তির রয়েছে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডকে নিয়ে আলোচনা করা যাক।২০০২ সালের অক্টোবরে থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে টিফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই থাইল্যান্ডকে বাধ্য করা হতে থাকে আমেরিকার কর্পোরেট মনোপলির স্বার্থে এর বিভিন্ন সেবা খাত বেসরকারী করে দিতে। Electricity Generating Authority of Thailand (EGAT) বেসরকারী করণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, EGAT বিক্রির পরমর্শক দের মধ্যে অন্যতম কর্পোরেশন Morgan Stanley, Citigroup and JP Morgan Chase and Co. অন্যান্য রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান যেমন: Metropolitan Waterworks Authority, Provincial Waterworks Authority, the Government Pharmaceutical Organization, the Port Authority of Thailand, the Expressway and Rapid Transit Authority of Thailand ইত্যাদি বিক্রি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়।জনগণের তীব্য আন্দোলন সংগ্রাম এর কারণে এগুলো এখন বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সাল থেকে থাইল্যান্ড জেনিটিক্যালী ইঞ্জিনিয়ারড বীজ আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, মুক্ত বাণিজ্যের নামে মনসান্টোর বিটি কটন আর রাউন্ড আপ রেডি কর্ন থাইল্যান্ডের বাজারে ঢুকানোর জন্য আমেরিকা ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করছে। আবার ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস এর আওতায় থাইল্যান্ডের সুগন্ধি চাল জেসমিন এর ও পেটেন্ট করার চেষ্টা চলে। আবার শ্রীলঙ্কার সাথে ২০০২ সালে টিফা চুক্তির সময় আমেরিকা গার্মেন্টস পণ্যের কোটা মুক্ত সুবিধার কথা বললেও বাস্তবে তা না দেয়ার জন্য নানান শর্ত চাপিয়ে দেয়-যেমন রুলস অব অরিজিনের এমন শর্ত যে শ্রীলঙ্কার উৎপাদিত গার্মেন্টস পন্য তেরী হতে হবে আমেরিকান ফ্যাব্রিক্স ব্যবহার করে, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস বাস্তবায়ন ইত্যাদি। ২০০৩ সালে পার্লামেন্ট এ ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সম্পর্কিত আইন পাশ করতে গেলে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয় এবং এক পর্যায়ে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয় এবং আদালত মামলাকারীর পক্ষেই রায় দেন। এটি মাত্র একটি উদাহরণ। সূতরাং সময় থাকতে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার।

সূত্র লিংক: http://www.idrc.ca/uploads/user-S/11129779261NSFTA.doc

যে কারনে বাংলাদেশ ওদের মূল টার্গেট:

ভূ-কৌশলগত দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগর মার্কিন প্রভাবে রাখার জন্য টিফার সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের পরই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যায়। মার্কিনদের চীন ঘেরাও নীতির ফলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক স্থান। বাংলাদেশ স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে যুক্তরাষ্ট্র সিয়াটো-সেন্টো চুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রাচ্যমুখী নীতি অব্যাহত রেখেছিল। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মার্কিনবিরোধী শক্তি কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তাদের চীন ঘেরাও নীতি বাস্তবায়নে সফল হয়নি। অতএব, বাংলাদেশ ওদের মূল টার্গেট।

কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এত গূরত্ব বহন করলে ও আমাদের দেশের শাসক গোষ্ঠীগুলো নিজেদের হীন স্বার্থ প্রতিষ্ঠা, অসৎ উদ্দেশ্য সাধন ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে দেশের বূহত্তম স্বার্থকেও জলান্জলি দিতে সামন্যতম কার্পণ্য করে না। এখনো সময় আছে আসুন, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে দেশটাকে ভালবাসি। প্রতিরোধ গড়ে তুলি দেশ বিরোধী সকল ষড়যন্ত্রের। এটাই হোক আমাদের আজকের প্রত্যাশা।

লেখক; ব্লগার এমডি জাহিদুল ইসলাম

বিষয়: বিবিধ

২৩৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File