বাবার দেয়া স্যুট
লিখেছেন লিখেছেন মুিজব িবন আদম ৩১ মার্চ, ২০১৪, ০২:৩৩:৩৪ দুপুর
চার ভাই। এক ধাচ। এক ছাঁচ। যেন এক থোঁকায় বাবার এক হালি ছেলে। ঈদ এলেও এক রকম জামা। এখনকার মত তখনতো গার্মেন্টস ছিল না্। তাই ঈদের সপ্তাখানেক আগেই চার ভাইকে একসাথে দর্জির দোকানে মাপ দিতে ডাক পড়তো। মাপ দেবার সময় এক একজনের এক এক বাহানা। কারো ডিজাইন এমন হতে হবে। আবার কারো পকেট এমন হতে হবে। দর্জি চাচা কেবল হাসিমুখে মাপ নিয়ে একটা করে চকলেট দিয়ে বিদায় করতেন। ঈদের দুই এক দিন আগে আসতো একটা পোটলা। খুলে দেখা যেত ফটোস্ট্যাট ডিজাইন। বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই, কেবল মাপ ছাড়া। এনিয়ে চার ভাইয়ের শত চেষ্টা। কিন্তু কোন ফল হয়নি। কারন, দর্জি কেবল বাবার নির্দেশ পালন করতেন। চার ভাইয়ের চার ডিজাইন হতে দোষ কি? বাবা জুতাও কিনতেন বাটা কোম্পানীর একই ডিজাইন। কেবল চার সাইজের। কেন এমন করেন বাবা?
আমি বড়। তাই ছোটদের জন্য মাঝে মধ্যে একটু ফ্যান্সী বা কালারফুল জিনিস পছন্দ করলে বাবা এড়িয়ে যেতেন; নয়তো চার জনের জন্যই কিনতেন। মাকে বললে তিনি বাবার পক্ষে হাজার যুক্তি দিতেন। তাঁর মতে এটাই ছিল মহান কাজ। কোন কিছুতেই চার ছেলের মধ্যে বিন্দু পরিমান পার্থক্য নয়। কারো যেন এমন মনে না হয় যে আমারটা পচাঁ। অথচ আমরা ভাইরা কিন্তু এতে বিরক্তই হতাম। মাঝে মাঝে তাই বাবার উপর ভিষণ রাগও লাগতো।
এর মধ্যে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা সামনে এল। বাবা আমাকে লঞ্চে তুলে দিতে আসলেন। লঞ্চ ছাড়ার সময় হল। কিন্তু তিনি নামলেন না। কী যেন ভাবলেন। তারপর আমার সাথেই ঢাকা গেলেন। পরের দিন পরীক্ষা শেষে গেলাম ঘুড়তে। বাবা সাথেই আছেন। আমার স্যুট হলো। পেলাম আরও অতিরিক্ত অনেক কিছু। ভালই লাগছিল। আবার ছোট ভাইদের কথা ভেবে খারাপও লাগছিল। বাবা মনে হয় আমাকে বুঝতে পারছিলেন। বললেন, আল্লাহ যদি বাঁচায় বাকীরাও যখন ইউনিভার্সিটিতে উঠবে তখন তারাও একই জিনিস পাবে।
কিন্তু আল্লাহর হিসেব ছিল ভিন্ন। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা চলছে। বাকী তিন ভাইয়ের একজন কলেজে, একজনের এসএসসি সামনে, আর ছোটভাই ৮ম শ্রেণীতে। এমন সময়ে চার ভাইয়ের ঘাড়ে বাবার মরদেহ। সেইসাথে বড় একটা দেনার বোঝা। কোন সাক্ষী নেই, কেবল দাবীদার এক আত্মীয়। সত্য কী মিথ্যা জানার সুযোগ নেই। মা বললেন, তোদের বাবাতো কখনও ধার দেনা করেন নাই। তবুও পরিবারের আয়ের প্রধান সম্বল সদর রোডের ওষুধের দোকনটি বিক্রির বিনিময়ে দেনা শোধ করে মুরদার কবরস্থানে নেয়া হল।
বিকেল গড়িয়ে গেল। ফুফু আমাকে ডাকলেন। বললেন, বাবা তোর মা বড় বেশী ভেঙ্গে পড়েছে। তুই শক্ত থাকিস। বুকে পাথর বেধেঁ হলেও সেমিস্টার ফাইনাল দিতে ঢাকা চলে যা। নইলে যে সব কুল হারিয়ে যাবে। সেই থেকে আমি শক্ত। পাথরের মতই। দায়িত্ব পালনে প্রতিক্ষণ বাবার দৃষ্টিতে সবকিছু বুঝার চেষ্টা করছি। ইহলোক থেকে চলে গেলে কি আমাদের কথা শুনা যায়? তুমি কী শুনতে পাও বাবা? জানি না।
তবুও বলছি: বাবা তোমার হাজার কাজের মাত্র কয়েকটা করতে পেরেছি। আল্লাহর রহমতে টিউশানী করেও ভাইদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাবা কাউকেই স্যুট কিনে দিতে পারিনি। এজন্য তোমার কী মনকষ্ট? তবে বাবা, তোমার দেয়া সেই স্যুটটা আমরা ভাইরা পালাক্রমে পড়েছি। এখন সেটা তোমার ছোট ছেলের। ও পড়াশুনায় সবার চেয়ে ভাল করছে বাবা।
আর একটা কথা, তুমি ধার না করেও যে মিথ্যা দেনার দায়ে আমাদের দোকানটাকে দিয়ে দিতে হল তা অনেক পরে জেনেছি। যখন সেই আত্মীয়টি নিজ মুখে কেঁদে কেটে বললেন। এখন উনি খুব অনুতপ্ত। তার সন্তানরা সব সম্পত্তি নস্ট করে ফেলেছে। বুড়াকে কেউ দেখাশুনা করে না। আত্মীয়টি ভুগছেন প্রচুর। শুধু বলেন - এ পাপের ফল।
বাবা, অজ্ঞতায় যদি তোমাকে কোনদিন ভুল বুঝে থাকি সেজন্য মহান আল্লাহর দরবারে সর্বক্ষণ ক্ষমা চাই ও তোমার জন্য দোয়া করি। পারলে তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও।
বিষয়: Contest_father
১৫৪৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ
আল্লাহতায়লা আপনাদের উপর রহমত করুন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন