কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব-১৭: শ্বাসরুদ্ধ শিশু গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক হটকারিতা

লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ০৪ জুন, ২০১৩, ০১:২৭:৩৩ রাত

সতের: শ্বাসরুদ্ধ শিশু গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক হটকারিতা

‘রাজনীতির শব্দার্থ ভিত্তিক সংজ্ঞা সহজেই অনুমেয়। ‘রাজ’ অথাত ক্ষমতা এবং ‘নীতি’; এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই শব্দ সম্ভারে সমৃদ্ধ আমাদের বাংলা ভাষায় এই শব্দটির উতপত্তি। বর্তমান রাজনীতিতে যন্ত্রণাক্লিষ্ট এই দেশের জনসাধারণের, শব্দটির উতপত্তিগত ব্যাখ্যার জন্য কোনো শব্দ তত্ত্ববিদের শরণাপন্ন হওয়া নিষ্প্রয়োজন। লাগাতার আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও আর ভাঙচুরের মাঝে এই রাজনীতি কতটুকু নীতির সংঘাত আর কতটুকু ক্ষমতার লড়াই তাও তাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান’ [চৌধুরী, ২০০১:১৩৯]।

ইতিহাস থেকে শেখা না-শেখার বড় কারণ হলো ‘স্বার্থ চিন্তা’। তাই বাংলাদেশে ‘রাজনীতি হলো ব্যক্তি-পরিবার-গোষ্ঠীর স্বার্থকেন্দ্রিক’ [মালিক, ২০১৩]। ‘দেশের দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দল, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সৃষ্টি, আমাদের নাতি দীর্ঘ গণতান্ত্রিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এখনো হয়নি। দুই দলেই এখনো কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। অতএব এই দুই জনের ইচ্ছা আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একান্তই প্রাসঙ্গিক। অন্তত বর্তমান আবস্থায় রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অন্যদের লম্ফ ঝম্প অবান্তর। এই কথা দুই নেত্রীই জানেন। তারা এও জানেন, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানেন যে রাজনীতিতে কোনো কথাই শেষ কথা নয়’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৪]।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিমন্ডলে ‘নির্বাচনহীন গণতন্ত্র, মৌলিক গণতন্ত্র, পরিচালিত গণতন্ত্র, একদলীয় গণতন্ত্র- এসবই আমরা এই জীবনে প্রত্যক্ষ করেছি। আর এসবের মাঝে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু সংসদ কখনো হয়েছে অবান্তর, কখনো রয়েছে বিশ্বস্ত বিরোধীদল বিশিষ্ট, কখনো বা বিরোধী দল বিহীন। কখনো আমাদের বিরল অভিজ্ঞতায় দেখেছি গণতন্ত্রের হঠাত আলোর ঝলকানিতে উদ্ভাসিত সংসদ; প্রাণবন্ত, কর্মমুখর। কখনো আবার, এখন যেমন, প্রত্যক্ষ করছি আমাদের বিকল গণতন্ত্রের অচল সংসদ, যাতে বিরোধী দল আছে না নাই, তা এখনো দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী ঠাহর করতে পারছেন না’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৩]।

‘আমাদের নেতৃবৃন্দ, গণতন্ত্রের স্লোগানকে, এক যুগ ধরে আমাদের উপর অধিষ্ঠিত সামরিক জুজুটিকে তাড়ানোর জন্যেই ব্যবহার করেছেন, ব্যবহার করে লাভ করেছেন এরশাদ তাড়ানোর প্রচেষ্টায় অভূতপূর্ব জনসমর্থন। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সর্বকালীন নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে তারা দেখিয়েছেন দুর্ভাগ্যজনক বিমুখতা এবং পীড়াদায়ক অদূরদর্শিতা। বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবেশে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিবর্তনের মূলধারা সম্বন্ধে তারা দেখিয়েছেন সচেতনতার একান্ত অভাব। তাদের রাজনৈতিক ব্যবহারবিধিতে মনে হয় তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে যেন দেশ নেই এবং এই দেশটিকে ঘিরে যেন নেই একবিংশ শতাব্দী পানে দ্রুত ধাবমান একটি পৃথিবী’ [চৌধুরী, ২০০১:৯৮]

‘আমাদের পরিতাপ, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আজ যেন দূরদর্শিতা, সহিষ্ণুতা আর সমঝোতা নির্বাসিত’ [চৌধুরী, ২০০১:৫]। অথচ দু’দলেরই ‘প্রায় সবাই, দল নির্বিশেষে, সমঝোতারই পক্ষপাতী। কিন্তু নেত্রীদ্বয়ের মুখোমুখি, আত্মরক্ষার্থে তারা হয়তো বা তোতাপাখি অথবা মূক বধির। নেতৃদ্বয়ের এই সত্যটি অনুধাবনের ক্ষমতা নিশ্চয়ই রয়েছে’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৪]। ‘আমাদের নেত্রীদ্বয় নিশ্চয়ই সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক বিবর্তন সম্বন্ধে অবহিত রয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতার প্রয়োজনের মূল্যায়নে সমর্থ। তারা নিশ্চয়ই জানেন, রাজনৈতিক গোঁয়ার্তমি আর অদূরদর্শিতার মাসুল কি’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৪]।

‘দেশে চাকুরি নেই; অনেকের জন্যই নেই তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উপযোগী কর্মসংস্থান্ দেশে আইন শৃঙ্খলা দুর্বল; সমাজের সর্বস্তরে রয়েছে নিরাপত্তার একান্ত অভাব। দেশে সন্তানসন্ততিদের শিক্ষার অনিশ্চয়তা; ভ্রান্ত শিক্ষানীতি আর শিক্ষাঙ্গনে সহিংস রাজনীতি বিনষ্ট করেছে বাংলাদেশের শিক্ষার মান এবং গ্রহণযোগ্যতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নেই কোনো নিশ্চয়তা; দায়িত্বহীন রাজনীতির কারণেই অর্থনৈতিক প্রবৃত্তি আজ এদেশে শামুকগতি’ [চৌধুরী, ২০০১:১]।

‘মানুষ নিয়েই সরকার। মানুষের হৃদয় আছে। অতএব সরকারও হৃদয়বান হতে সক্ষম্ এই যুক্তিটি আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলো

হয়তো মানবেন না’ [চৌধুরী, ২০০১:৬]। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে বর্তমান পরিস্থিতি, ‘মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্ল্যাটো এরিস্টটলের নগর গণতন্ত্রের জমানা থেকে আজ পর্যন্ত এই ধরনের গণতান্ত্রিক অচলাবস্থা কোনো জাতিই বোধ করি প্রত্যক্ষ করেনি কোনো দিন’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৩]। সে যাই হোক, ‘ক্ষমতার শীর্ষে আমাদের দুই নেত্রীই একান্ত একাকী। তাদের চারপাশের জনতার কোলাহল মিলিয়ে গেলে পাত্র মিত্র সভাসদের প্রস্থানে, তাতক্ষণিকতার অযুত বন্ধন শিথিল হলে, তারা রইবেন ইতিহাসের মুখোমুখি। কারণ তাদের দায়িত্ব সত্যিকার অর্থে ঐতিহাসিক’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৫]।

‘সমস্যাটি রাজনৈতিক। তাই নেত্রীদ্বয়ের রাজনৈতিক শুভেচ্ছাই হবে পন্থার আবিষ্কারক। আমার এই আশাবাদ, সাধারণ রাজনীতির দৃষ্টিকোণে হয়তো বা অবাস্তব, অলীক এবং অসম্ভাব্য। কিন্তু জাতীয় জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, অবশ্যই বিরল সে সব মুহূর্ত, যা সাধারণ রাজনৈতিক বিচারের ঊর্ধ্বে। বর্তমান সঙ্কটটি সেই মুহূর্তেরই বাহক’ [চৌধুরী, ২০০১:১২৫]। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে প্রত্যেক দেশেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব। প্রতিটি দেশের সচেতন নাগরিক মাত্র্রেরই তা কাম্য। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণে প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার প্রয়োগের মধ্যমেই গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এবং সেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিই নিশ্চিত করে উন্নয়নের উপযুক্ত পরিবেশ। তাই আমাদের কামনা, ‘দেশে মুক্ত স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, দেশে বাঁধ ভাঙা গণতন্ত্র আসুক, দেশের সার্বিক বিকাশ হোক্ একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ একটি আধুনিক দ্রুত উন্নয়নগামী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। গণতন্ত্রে সেই আত্মপ্রকাশ ঘটবে কখনো ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মাঝে, কখনো বা ‘জয় বাংলা’র জয়োল্লাসে। ইতিহাসের সুবিশাল প্রেক্ষাপটে সবারই জন্যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রইবে অবারিত দ্বার। গণতন্ত্রের এই তো মহিমা’ [চৌধুরী, ২০০১:২৩৭]।

তথ্যসূত্র:

চৌধুরী, ফারুক (২০০১)। প্রিয় ফারজানা। ঢাকা: মীরা প্রকাশন।

মালিক, শাহদীন (২০১৩)। সঠিক ইতিহাস আর ‘শেখা না-শেখা’। প্রথম আলো, ১৭ই মে, ২০১৩।

বিষয়: বিবিধ

১৭৭৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File