কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ১৫: নিয়ন্ত্রিত মূলধারার গণমাধ্যম ও অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক গণমাধ্যম
লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ১৭ মে, ২০১৩, ০৬:১০:৫৮ সকাল
পনের: নিয়ন্ত্রিত মূলধারার গণমাধ্যম ও অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক গণমাধ্যম
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। অবাধ ও মুক্ত তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা ছাড়া মানুষের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে সমুন্নত রাখা কখনই সম্ভব নয়। কিন্তু অনুতাপের বিষয় হলো যে, আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারগুলো অগণতান্ত্রিক উপায়ে গণমাধ্যমগুলোর কন্ঠরোধ করা চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সাংবাদিকের যে ভূমিকা তার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা চলেনা। একটি সুষ্ঠু শক্তিশালী স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ জগৎই সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম ও আইনের শাসন, ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও দেশের সত্যিকারের সার্বিক উন্নতি সাধনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস নিয়ে যাদের কাজকারবার তারা এবিষয়ে আমাদের যে কারো চেয়ে অনেক বেশী জানেন।
আমাদের গণমাধ্যমগুলো একদিকে যেমন সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তেমনি অন্যদিকে রাজনৈতিক পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে পড়েছে। আমাদের সাংবাদিক ও সম্পাদক বন্ধুরা ডাক্তারের কাছ থেকে মেডিক্যাল ইথিক্স আশা করলেও এটা কখনই ভাবেন না যে, তাদের জন্যেও জার্নালিজমের ইথিক্স মানা জরুরী। সে যাই হোক, এ ডিজিটাল যুগে সত্য গোপন করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপর দিকে মূলধারা গণমাধ্যমগুলোর সত্য প্রকাশে নিসংকোচ হওয়ার ব্যর্থতার জন্যই এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অনিয়ন্ত্রিত সামাজিক মাধ্যমগুলো। আমাদের গণমাধ্যমগুলো পক্ষপতা দুষ্ট হয়ে পড়েছে বলেই এখন সবাই ঝুকে পড়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে। গণমাধ্যমের কর্মীরাসহ সবপেশার পেশাজীবিরা এখন রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য।
আজ বিশ্বময় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিস্তার ঘটেছে। মোবাইল প্রযুক্তির বলে আজ বিশ্ব আমাদের হাতে মুঠোয়। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় একটি রাষ্ট্র ইচ্ছে করলেই আর সামাজিক মাধ্যমগুলোকে টুটি চিপে ধরতে পারছে না। আর এসুযোগেই তাদের অপকর্মের তথ্যাদি ও দলিলপত্র বিশ্বময় ব্যাপিত হয়ে পড়ছে। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য এক বিশাল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। কারণ বর্তমানে রাজাকার আলবদরের বিচারের জন্য তথ্যা-প্রমাণাদি খুঁজে পেতে যত কষ্ট হচ্ছে, ভবিষ্যতে বর্তমানে অপকর্মকারী কারো বিষয়ে তথ্য কিংবা প্রমাণ পেতে গয়েন্দা বিভাগ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা গবেষক ও ঐতিহাসিকের জন্য তেমন বেগ পেত হবে। এই ডিজিটাল যুগে সব সুকর্ম আর কুকর্মের ডিজিটাল ছাপ থেকে যাচ্ছে যা মুহূর্তের ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। তথ্যের কয়টা উতসই ধ্বংস করা যাবে।
প্রকৃতপক্ষে ‘গণমাধ্যম’ বলতে সবধরণের সংবাদ মাধ্যমকেই বোঝায়। প্রকৃতপক্ষে এই গণমাধ্যম মানুষের তথ্য জানার সমতাকে অভূতপূর্ব একপর্যায়ে উন্নীত করেছে। ডিজিটাল যুগে নিত্য নতুন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবন আর উন্নয়নের ফলে তথ্য নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সরশিপকে অর্থহীন করে তুলেছে। মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন অতীতে আর কখনোই এতটা উন্মুক্ত হয়নি, এখন যেমনটা হয়েছি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে নেতিবাচক দিকও। কিছু অনৈতিক-অসুস্থ কিংবা স্বার্থবাজ মানুষের হাত পড়ে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি হয়ে পড়েছে ‘সাইবার ক্রাইম’এর হাতিয়া যা কিনা হলুদ সাংবাদিকতার চেয়েও ভয়ঙ্কর। মাদকাসক্তের মতোই কেউ কেউ সাইবার ক্রাইমে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অবাধ চর্চার একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গ। তাই সংবাদপত্রকে ‘Forth State’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল অনেক আগেই। চতুর্থ রাষ্ট্র হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকার ব্যত্যয় যেমন ঘটেনি, তেমনি এই ভূমিকা সম্প্রসারিত হয়েছে রাজনীতির গণ্ডি অতিক্রম করে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর অন্যায়-অবিচারের চিত্র জনসম্মুখে তুলে ধরে তার প্রতিকার ও প্রতিরোধে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলা হয়ে থাকে যে, ‘Mass media is the people’s parliament always in session’। কথাটি অনেকেই রূপক অর্থে ব্যবহার করলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণমাধ্যমই সরকারকে আত্মসমালোচনার সুযোগ করে দেয়।
সাংবাদিকতার ইতিহাস পর্যালোচনা করল দেখ যায় যে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ভর করা অপশক্তির তান্ডবে যখন নিরীহ মানুষের জীবনে নেমে আসে অবিচার আর অন্যায়ের মাধ্যমে বৈষম্য আর নির্যাতন, তখন গণমাধ্যম ন্যায় আর সুবিচারের আপোসহীন দাবী নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে গণমানুষের পাশে। দুর্নীতি আর অপশাসনে যখন দেশের আমজনতা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত আর স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার বাঁধাগ্রস্ত, তখন সাংবাদিক আর গণমাধ্যমই মজলুমের ফরিয়াদ তুলে ধরে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।
আমাদের গণমাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ও আদর্শগত চিন্তাধারার মুখপত্র। মালিক পক্ষের রাজনৈতিক অঙ্গীকারই হয়ে উঠে আমাদের গণমাধ্যমগুলোর প্রধান লক্ষ্য, সেখানে নৈতিকতা, আদর্শ, দেশপ্রেম কিংবা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা হয়ে পড়ে গৌণ। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত আমাদের মূলধারার সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনের সংগঠক ও মুখপত্র হিসেবে। ইত্তেফাক ও সংবাদ সে ভূমিকা পালন করেছিল বলেই ১৯৭১ সালে এ দুটি পত্রিকাই পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণের ল্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করেছিল গণস্বার্থে। বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে মূলধারার গণমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলো যথার্থই জনগণের সংগঠক ও মুখপত্র হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।
আমরা অবাক হই যখন এই একুশ শতকের বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা নিজেদের তল্পীবাহক একশ্রেণীর গণমাধ্যমকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে অন্যায়ভাবে, তেমনি স্বাধীন গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সেন্সরশিপ প্রথাকেও ‘আইনসঙ্গত’ রূপ দিয়ে মতপ্রকাশের অধিকারকে ক্ষুন্ন করছে। তাই কায়েমী স্বার্থের বিরোধী এবং নানা সামাজিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক চিন্তার বাহক গণমাধ্যমগুলো সেন্সরশিপের খড়গ এড়িয়ে কৌশলে প্রকাশিত হয়ে থাকে। আর এ কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে সত্যপ্রকাশে প্রতিনিয়তই তারা কুন্ঠিত।
মজার ব্যাপার হলো বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশে গণমাধ্যম অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, বাংলাদেশে নতুন বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে কিন্তু পুরাতন সেন্সরশিপের ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্য রাখলো। আমাদের দেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মতপ্রকাশের সংঘ-সমিতি বা রাজনৈতিক দল করার ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ স্বীকৃত। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত একটা সরকার কিভাবে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ বা অন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তেক্ষেপ করে? যদি সেটা করেই থাকে, তবে সে সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক বলার অধিকার হারায়। আমাদের কর্তাব্যক্তিরা রাজনীতি মঞ্চে যত জোরেই গলাবাজী করুন না কেন, জনগণ সেটা বিশ্বাস করে না। আর বিশ্বাস করে না বলেই সুযোগ পেলে সেটা প্রমাণ করে দেয় তাদের ব্যালটের মাধ্যমে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন