কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ১৪: আরোপিত বিরোধ ও সমাজ পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি
লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ১৬ মে, ২০১৩, ০৫:২৪:১৯ সকাল
চৌদ্দ: আরোপিত বিরোধ ও সমাজ পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি
প্রিয় পাঠক, আজ আনিসুল হকের একটি লেখা থেকে কিছু আংশ তুলে দেয়ার চেষ্টা করব, নিতান্ত প্রয়োজনে, যেটা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্বগুলোর মধ্যে একটি যোগসূত্র রচনা করবে। আর খাপছাড়া পর্বগুলোর মধ্যে একটা ঐক্যের সূত্র সহজেই খুঁজে পেতে পারেন। যে শিরোনাম দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, সেই যুদ্ধের আশঙ্কায় আমরা ভীত না হলেও, তিনিও আমাদের মতোই সন্দিগ্ন মন নিয়ে বলছে, ‘যুদ্ধ যদি হয়ও, তা হবে রাজায় রাজায় কিংবা বলা যায় রাজা যাঁরা হতে চান, তাঁদের মধ্যে, তাঁদের জন্য, তাঁদের দ্বারা। আর তার শিকার হবে জনতা, উলুখাগড়া, সাধারণ মানুষ, দেশ, দেশের ভবিষ্যৎ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। খবরের কাগজেই পড়েছি, উত্তর বাংলার এক সাধারণ নাগরিক বলেছেন, আসল গন্ডগোল ‘চিয়ার’ নিয়া। অর্থাৎ গদিতে কে বসবেন, এইটা হলো সব গন্ডগোলের মূলে’ [হক, ২০১৩]। এ আলবত সত্য কথাটি দেশের আমজনতা জানলেও কতিপয় স্বার্থান্বেষীর হাতে তাদের ভাগ্য আজ বন্ধী হয়ে পড়েছে।
কায়েমী স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক হীনমণ্যতা আমাদের অধ:পতনের সর্ব নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসলেও তিনি প্রশ্ন রেখেছেন এবং নিজেই তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন, ‘আদৌ কি এই দেশে মানুষে মানুষে কোনো বিরোধ আছে? একটা নতুন কথা শোনা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ আর ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। এ পক্ষ ও পক্ষকে, ও পক্ষ এ পক্ষকে এ জন্য দোষ দিচ্ছে। আমি বলি, এ ধরনের কোনো বিরোধ আদৌ ছিল না, এখনো নেই, কাজেই এই বিরোধ যদি এখন কিছু দেখা দিয়েও থাকে, এটা টিকবে না। বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আর বাংলাদেশের সব মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে। বাংলাদেশের মানুষ, যিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, জীবনে-মরণে তাঁরা ধর্মের চর্চা করে থাকেন। একাত্তর সালে যাঁরা যুদ্ধে গেছেন, তাঁরা জয় বাংলা বলে স্নোগান দিয়েছেন, আবার আল্লাহ-খোদার নাম নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথায় ব্যাপারটার প্রতিফলন আছে, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, আমি মুসলমান, মুসলমান একবার মরে, দুইবার মরে না’ [হক, ২০১৩]। শেখ মুজিবর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি’ [রহমান, ২০১২:৪৭]।
সে যাই হোক, আনিসুল হকের পর্যবেক্ষণে অত্যন্তু সুন্দরভাবে উঠে এসেছে আমাদের সমাজ বাস্তবতার কঠিন সত্যটি- ‘ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, আমাদের সমাজে সব পেশার, সব মতের, সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করছে, যার যার কাজ করছে। ইমাম সাহেবদের, মৌলভি সাহেবদের, আলেম সাহেবদের শ্রদ্ধাভক্তি করেই আমরা বড় হয়েছি। আবার মাদ্রাসার ছাত্র, স্কুলের ছাত্র, আবার পাড়ার রিকশাওয়ালা কিংবা চর্মকারের ছেলে—আমরা সবাই মিলে পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলেছি। কিন্তু সময় বদলে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ড চলছে। দেশের লোকসংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যও প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষ ব্যস্ত, আত্মকেন্দ্রিক। ফলে সমাজে সব মানুষের মধ্যে, সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে যে মিলন, যে সমন্বয়-প্রক্রিয়া, সেটার সুযোগ কমে গেছে। আমাদের দেশে কিন্ডারগার্টেন হয়েছে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে অনেকে, বেশির ভাগ পড়ছে বাংলা মাধ্যমে, আবার মাদ্রাসায় আছে দুটো ভাগ, আলিয়া মাদ্রাসা আর কওমি মাদ্রাসা। এসবের মধ্যে কেবল পাঠ্য বিষয়ে বৈষম্য আছে তা-ই নয়, শ্রেণীগত বৈষম্য আছে। আমাদের দেশের কওমি মাদ্রাসায় পড়া এবং তার সঙ্গে যুক্ত এক বিশালসংখ্যক নাগরিকের মনের কথা বাকিরা কখনো পাঠ করার চেষ্টা কি করেছেন? গণমাধ্যমে যদি তাঁদের চরিত্রকে হেয় করে দেখানো হয়, তাঁরা দুঃখ পাবেন, প্রতিবাদ করবেন, এটাই কি স্বাভাবিক নয়’ [হক, ২০১৩]?
বর্তমান বিভাজনের শিকারে পরিণত হওয়া আমজনতার বিক্ষুব্ধতার অন্তর্নিহিত কারণের একটি হলো ‘বৈষম্য’ আর তার থেকে পরিত্রাণ পেতে তাই তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। আবার মাদ্রাসায় পড়ুয়া কিংবা বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়া ছাত্রদের মধ্যেও কোনো বিরোধ নেই, বৈষম্য রয়েছে। আমরা একই দেশের একই সমাজের নাগরিক। যেটা দরকার, তা হলো, মেলামেশা, ভাব-বিনিময়’। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সমাজটা চিরকালই ছিল সমন্বয়ের সমাজ। আমরা পরস্পরের সঙ্গে মিশেছি, মিলেছি, নিয়েছি, দিয়েছি, আত্মার আত্মীয় হয়েছি, শান্তিতে বসবাস করেছি। এখন অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সামাজিক পরিবর্তন, বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত উন্নতি ইত্যাদি যেন আমাদের মানুষে মানুষে, শ্রেণীতে শ্রেণীতে, পেশায় পেশায়, মূল্যবোধে মূল্যবোধে এমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করে, যা সমাজ-রাষ্ট্রে অশান্তি তৈরি করে। দেশি-বিদেশি রাজনীতিক-স্বার্থবাদীরা তা চাইতে পারে, কিন্তু আমরা যেন তাঁদের পাতা ফাঁদে পা না দিই’ [হক, ২০১৩]।
সময়ের পালাবদলে আমাদের সংস্কৃতির নানা চিহ্নের নানা রকম পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক, আর এসব বিবর্তন আর পরিবর্তন নিশ্চয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গের জন্য নানা তাৎপর্য বহন করে। তাই বেশী দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদেরকে এসব অনুসঙ্গ নিয়ে আলোচন, পর্যালোচনা এবং গবেষণা করতে হবে, নচেত নানাভাবে সামাজিক প্রকৌশলের সুযোগ নিবে সুযোগ সন্ধানীরা।
তথ্যসূত্র:
রহমান, শেখ মুজিবর (২০১২). অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
হক, আনিসুল (২০১৩). যত কান্ড ‘চিয়ার’ নিয়া। প্রথম আলো, ৯ই এপ্রিল, ২০১৩।
বিষয়: বিবিধ
১৩১৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন