কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ১৩:পরশ্রীকাতর বাঙালী ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ

লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ১৫ মে, ২০১৩, ০৬:০১:২০ সকাল

তের: পরশ্রীকাতর বাঙালী ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ

বাঙালী জাতি সম্পর্কে বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলেও শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে বাঙালীর জাতীয় বৈশিষ্ট্যের একটি অনন্য দিক সম্পর্কে আমাদের জন্য একটা সুন্দর কথা বলে গিয়েছেন: ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সফলা বাংলাদেশে সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না’ [রহমান, ২০১২:৪৭-৪৮]।

তার মানে বাঙালী একটা পরশ্রীকাতর জাতি। তাই তারা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গেও কুন্ঠিত হয় না। আর সেটাই আমরা দেখতে পাই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মঘাতী কার্যকলাপে। আর বিশ্বাসঘাতকতার কথা না হয় এখানে আলাপ নাইবা করলাম, যেহেতু আমাদের ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকদের সম্পর্কে অন্য একটি অংশে কিছুটা আলোকপাতের চেষ্টা করেছিলাম। জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা আর দৈন্যের কারণ তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে এখানে তুলে ধরেছেন। যারা তাঁর এ জীবনী গ্রন্থটি পড়েছেন, তারা জানেন যে তিনি ১৯৪৭-পূর্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরশ্রীকাতরতার কথা বলেছে এবং তা কিভাবে তখন রাজনৈতিক আন্দোলনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। আমরা যদি স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ আর আলোচনা-পর্যালোচনা করি, সেটাই আমরা দেখতে পাব।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পরশ্রীকাতরতায় জাতীয় ঐক্য আজ মহা হুমকীর সম্মুখীন। একদল যখন ক্ষমতার মসনদে আরোহন করে তখন আর অন্য দল সেটা সহ্য করতে পারে না। গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে তারা অনেক অগণতান্ত্রিক ও আত্মঘাতী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক সময়ের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আর ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর জন্ম অন্য যে কারণেই হোক না কেন, তার পেছনে যে আমাদের রাজনৈতিক পরশ্রীকাতরতা প্রত্যক্ষভাবে ইন্দন যুগিয়েছে তা চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করবেন। এর সাথে ঔপনিবেশিক ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির সুস্পষ্ট সম্পর্ক লক্ষনীয়। তাই ঐতিহাসিক উদাহরণটা টেনেই আজকের লেখার ইতি টানছি।

ইতিহাস পাঠকমাত্রই জানেন যে, ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ও গণ-অভ্যুত্থানের পর দিশেহারা ব্রিটিশ রাজ উপমহাদেশে ধর্মীয় বিদ্বেষের বীজ বপন করে ভারতীয়দের পরস্পরের মধ্যে হানাহানি ছড়িয়ে দেয়ার যে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারই পদক্ষেপ হিসেবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নামের দু’টো দল আত্মপ্রকাশ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের প্রয়োজনে এবং উতসাহে যেমন ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়, তেমনি পরবর্তীকালে তাদেরই প্রয়োজনে এবং উতসাহে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। লক্ষ্যনীয় যে, মুসলিম লীগের ঘোষণাপত্রে এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়: ‘… to foster a sense of loyalty to the British government among the Muslims of India’ [হাসান, ১৯৮২:১৩০]। কিন্তু শুরুতেই দল দু’টোর নীতি আদর্শ যাই থাকুক না কেন, আখেরে তারা ইংরেজ-তোষণ নীতি পরিত্যাগ করে ইংরেজ খেদাও নীতিই গ্রহণ করেছিল।

উপরের ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে কোন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা যদি মনে করেন, আমাদের মূলধারা রাজনীতির দু’অক্ষের প্রয়োজনেই ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আর ‘হেফাজতে ইসলাম’-এর পয়দা হয়েছে এবং একসময় এরাই বুমেরাং হয়ে ঔপনিবেশিক ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি মানসিকতা দ্বারা চালিত অক্ষশক্তি দুটোর মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়, তবে আশ্চর্য হবার কিছুই থাকবে না। সেদিন অবশ্য টিভির পর্দায় দেখলাম একজন মন্ত্রী বলছেন ইতিহাসের নাকি পুনরাবৃত্তি হয় না। ইতিহাসের ছাত্র নয় বলে হয়ত তিনি সেটা বলতে পেরেছেন। আপাতত টাইম মেশিনের মাধ্যমে না হয় কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারের বেয়াকুপ আমজনতা হয়ে রবার্ট ক্লাইভের পলাশী বিজয়ের শোভা যাত্রা দেখি। প্রিয় পাঠক, ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায় শুরু না হওয়া আগ পর্যন্ত আপনিও না হয় আমার সাথে ‘প্রতারণার মাধ্যমে পতিপক্ষকে পরাজিত করার নায়ক’ ক্লাইভের শোভাযাত্রা দেখুন।

তথ্যসূত্র:

রহমান, শেখ মুজিবর (২০১২). অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।

হাসান, ফরহাদ (১৯৮২). পিতৃভূমি ও স্বরূপ অন্বেষণ [প্রথম খন্ড]। ঢাকা: এজেডএম বদরুদ্দোজা।

বিষয়: বিবিধ

১৯০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File