কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ৮: সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও সম্পদ পাচারের ঐতিহাসিক ধারা

লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ১১ মে, ২০১৩, ০৬:১৪:৩৯ সকাল

গরহাজিরের কৈফিয়ত

গত কয়েক দিন ধরে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটায় লেখার সুযোগ হয়নি। তাই মে মাসে প্রতিদিন লেখার প্রতিজ্ঞা আমার ভঙ্গ হয়েছে। হয়তো তার কাফ্ফারা হিসেবে আমাকে পরের মাসেও লিখতে হতে পারে। আমার এ অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুখিত। হয়তো বলবেন, ‘জীবন যাদের দু:খে গড়া, তাদের আবার দু:খ কিসের?’ হয়তোবা তাই! সঙ্গে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

আট: সমৃদ্ধ বাংলাদেশ ও সম্পদ পাচারের ঐতিহাসিক ধারা

আমরা জানি যে, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেব পরিচিত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে তুর্কীদের শাসন আমলের সূচনা থেকেই বাংলাদেশের ধন-সম্পদ দেশের বাইরে পাচার হওয়া প্রতিদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে দিল্লীর দরবারে উপঢৌকন আর খাজনার নামে। বাংলাদেশের সেন রাজারা যদিও ভারতের কর্নাটক থেকে অভিবাসিত হয়ে এদেশে এসেছিল, তবে তারা তাদের নাড়ীর সাথে তেমন যোগাযোগ রাখতে পরেনি। ফলে তারা শাসন আর শোষণের মাধ্যমে এদেশটাকে চেটেপুটে খেয়েছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে তুর্কীদের আগমনের মাধ্যমে শাসন ব্যবস্থায় জড়িত তুর্কীরা তুরস্কের সাথে তাদের সম্পর্ক টিকেয়ে রেখেছিল বিভন্নভাবে। তাছাড়া আফগান, মোঘল, ইংরেজ যারাই এদেশের শাসন ক্ষমতায় বসেছে তারা কখনই তাদের নাড়ীর বন্ধন ছিন্ন করেনি। বাংলাদেশে বহিরাগত শাসকরা ভূমিপুত্র বাঙ্গালীদের উপর একদিকে রাজদন্ড ঘুরিয়েছে, অন্যদিকে তাদের অর্থসম্পদ যে যেভাবে পেরেছে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশে পাঠিয়েছে কিংবা সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। এভাবে উপমহাদেশে তুর্কী শাসনামল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনামল পর্যন্ত মূলত জনগণের কষ্টার্জিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদ শাসক শ্রেণী লুটেপুটে খেয়েছে কিংবা চালান করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় রাজকোষে আর নিজ নিজ পূর্বপুরুষের দেশে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত দিল্লীর তুর্কী সুলতানাতের শাসনকর্তারা হাদিয়া হিসেবে হাতি ঘোড়ার পিঠে করে দিল্লীর দরবারে পাঠাতেন বিপুল পরিমান অর্থসম্পদ। আর যখন তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব শেষ করে ফিরে যেতেন, তখন কিংবা তার আগ থেকেই নানা কায়দায় এহাত ওহাত করে বিপুল অর্থসম্পদ হয় তারা সাথে করে নিয়ে গেছেন, না হয় অন্যের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মোঘল আমলে বাংলাদেশের মোঘল গভর্ণরেরা উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো ছাড়াও প্রতিবছর খাজনা হিসেবে প্রচুর অর্থ দিতেন দিল্লীর কেন্দ্রীয় মোঘল দরবারে। মোঘলদের পর মারাঠারা ‘চৌথ’-এর নাম করে ‘বর্গী’ হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থসম্পদ লুট করে নিয়ে যেত। আর তাদের এই লুটতরাজ কমে আসার সাথে সাতে ইংরেজরা এসে হাজির তাদের বখরা নিতে। সুদীর্ঘ ২শ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭) ধরে এরা আমাদেরকে নানা কায়দায় শাসন ও শোষণ করেছে- আর জাহাজ বোঝায় করে অর্থসম্পদ আর কাঁচামাল পাঠিয়ে দিয়েছে সাত-সমূদ্র তের নদীর ওপারে তাদের জন্মস্থান ব্রিটেনে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, কেবল নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে কৌশলে পরাজিত করে মীর জাফর আলী খাঁকে বাংলাদেশের সুবেদার বানানোর পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ৮ লক্ষ পাউন্ডের ধনসম্পদ নিয়ে ১৭৫৭ সালের শেষের দিকে একটি জাহাজ লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে [মাকর্স, পৃ.৮৬]।

ইংরেজ যুগের পর আমরা পড়ি পাঞ্জাবীদের নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর হাতে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এদেশের সম্পদ দিল্লী কিংবা লন্ডনের পরিবর্তে চলে যেতে শুরু করে করাচী কিংবা ইসলামাবাদে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে চলে এপাচার। কয়েক শতাব্দী ধরে বহিরাগতদের শোষণ আর শাসনে ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে পড়ে ততকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জারের ভাষায় ‘তলাহীন ঝুড়ি’ - হাজারো খয়রাতি সাহায্যেও যে দেশটির আর প্রয়োজন মিটে না।

প্রকৃতপক্ষে, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) বাংলাদেশের ধনসম্পদের প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয়ে একে ‘জান্নাত-উল-বেলাওয়াদ’ বা জাতিগুলোর স্বর্গ (Soobah jennat-ul-Belaod Bengala- The paradise of Nations, the Subah of Bengal) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ব্রিটিশ গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন (১৭৮৫-১৭৯৩) তার এক চিঠিতে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। চিঠিতে তিনি আমাদের দেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘England is fortunate enough to establish domenion over one of the richest regions of the earth’ [হাসান, পৃ. ৫৩]। বিদেশীদের এমন প্রশংসা অর্জনের মত সম্পদশালী দেশটি নাগরিকদের ব্যর্থতায় বিশ্বের অন্যতম একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে আজ বিশ্বসভায় পরিচিত। আমরা আশাবাদী, একুশ শতকে আমাদের সমৃদ্ধির পথে ফিরে যাওয়া শতক। জাতির আগামী প্রজন্মের কঠোর সাধনা আর সৃজনশীল প্রচেষ্টার বদৌলতেই এদেশ পৌঁছে যাবে সমৃদ্ধির এক নতুন দিগন্তে।

তথ্যসূত্র:

মাকর্স, ক. (). ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জী।

হাসান, ফ. (১৯৮২). পিতৃভূমি ও স্বরূপ অন্বেষণ [প্রথম খন্ড]।

বিষয়: বিবিধ

১২৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File