কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ৭: গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার পূর্বশর্ত পরমতসহিষ্ণুতা
লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ০৭ মে, ২০১৩, ০৭:৩০:১০ সকাল
সাত: গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার পূর্বশর্ত পরমতসহিষ্ণুতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাস সবার জানা থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে পারিনি। সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের যাতাকলে নিষ্পেষিত আমাদের জনজীবন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূলুন্ঠিত করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ না করে আমরা জড়িয়ে পড়ছি জাতিকে বিভাজিত করার তর্কে; আর নানা প্রচেষ্টায়- স্বজ্ঞানে কিংবা অবচেতনভাবে। আর সেই হীন ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থতার পথে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি লাভের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে সমাজের অধিকাংশ অকর্ষিত মানুষ। তার খেসারত দিয়ে চলেছে আমাদের স্বদেশ ও তার নিরীহ নাগরিকেরা। জাতিগত কিংবা ব্যক্তিক স্বাধীনতার দার্শনিক তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। তাই আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা চালাব- যদিও প্রাথমিকভাবে এসব হবে বিচ্ছিন্নভাবেই- এই সিরিজ লেখার নানা পর্বে।
বিশ্বময় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিযোগিতা করে একে অন্যের সাথে তাদের রাজনৈতিক আদর্শের। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মাধ্যমে। আর সেই প্রতিহিংসার বলীর পাঁঠা হল দেশ ও দেশের অসহায় জনগণ। একদল অন্য দলের বিরুদ্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ডাক দেয় হরতাল কিংবা অবরোধের। এতে দেশ ও জনগণের বারোটা বাজলেও তাদের কিছু যায় আসে না। প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলতে পারলেই হলো। এটা অনেকটাই যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের মতো। কারণ তারা দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করেন না, তারা রাজনীতি করেন ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় আরোহণ করার জন্য, দেশের সম্পদকে গনিমতের মাল কিংবা নিদেনপক্ষে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নিজেদের বাপদাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তির মতো ভোগ করার জন্য। জনগণকে সেটা বুঝে ঐক্যবদ্ধভাবে অপ-রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে যেমন তারা দাঁড়িয়েছিল আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়।
বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত দারিদ্র প্রপীড়িত বাংলাদেশে জাতির সামনে হাজারও সমস্যা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সব সমস্যা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর। তাদের একটিই ধ্যানজ্ঞান কিভাবে তারা ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকতে পারবে কিংবা সময়মত আরোহন করতে পারবে। দেশ ও জাতির কথা বাদ দিয়ে দল এবং নিজের অবস্থানের কথাই তাদের কাছে মুখ্য। দেশের আমজনতা এখন সেটা বুঝতে শিখেছে। শুধু প্রয়োজন তাদের জাগরণের, প্রতিবাদী হবার। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা উচিত দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসতে না পারলে জাতি কখনওই কল্যাণমুখী রাজনীতির পথে এগুতে পারবে না। আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতা লাভের মোহ আর পারস্পরিক দ্বন্দ্বেই তাদের সব শক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলছেন।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরা সব সময়ই অন্যায়, অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তারা কখনোই মাথা নোয়ায়নি, চির উন্নত শির- বীর বাংলাদেশী হিসেবে তাদের আত্ম-পরিচয়কে তারা শাণিত করেছে যুগে যুগে। কিন্তু সেই বাংলাদেশীরা এখন দিনে দিনে হয়ে পড়েছে নতজানু, নি:বীর্য প্রতিবাদহীন, অদৃষ্টে বিশ্বাসী এক পলায়নপর জাতি। বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা আমাদেরকে তাই একটি অধ:পতিত জাতিতে পরিণত করেছে। জাতির এ চেতনাগত অবক্ষয় শীঘ্রই আমাদের ঠেকানো দরকার। নচেত জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীন সত্তাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আর অবজ্ঞা করা হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও দার্শনিক তাৎপর্য কি, সেটা আমাদের অনুধাবন করা দরকার নির্মোহভাবে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ চেতনাগত ব্যাখ্যা নয়, সে ব্যাখ্যা হওয়া চাই জ্ঞাননির্ভর, প্রজ্ঞাদীপ্ত ও জীবনবাস্তবতার আলোকে। পুরো জাতির কৃতিত্বকে খাটো করে, ব্যক্তি বিশেষের বা কোন দলের কীর্তি গাথাই কি আমাদের স্বাধিকার আর স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস? সেই একদেশদর্শী চেতনাগত দারিদ্র্যের কারণেই প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে। ফলে অপর দল কিংবা গোষ্ঠী তার বিপরীতে তৎপর থাকছে নতুন ও বিকল্প ইতিহাস খোঁজতে কিংবা বানাতে। আমাদের জাতীয় ইতিহাস বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে দলীয় হীনমন্যতার কারণে- আর সাধারণ মানুষ তা থেকে বিশ্বাস হারাচ্ছে। শ্রদ্ধা হারাচ্ছে নেতা-নেত্রীদের প্রতি, আর ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে জাতির ভবিষ্যত সম্পর্কে। জাতীয় প্রচার মাধ্যমে কিংবা জনসভাগুলোতে গলাবাজী আজ অন্ত:সার শূন্যতায় পরিণত হয়েছে। কি নগ্ন আর দুর্বিনীত মিথ্যাচার করছে আমাদের নেতা-নেত্রীরা- তাদের কাছে আমার প্রশ্ন- মিথ্যাচার কী কখনোই মানুষের মনে শ্রদ্ধা জাগাতে পারে?
আমরা সবাই জানি যে গণতন্ত্রের বিকাশ ছাড়া একটি দেশের স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠে না আর মানবাধিকার সেখানে ভূলুন্ঠিত হয় প্রতিনিয়ত। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আমরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যতই জিকির তুলি না কেন, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত যে পরমতসহিষ্ণুতা সেটা কি আমাদের প্রত্যহিক অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়? পাঠক! আপনার আমার বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন রেখে নতুন আশায় বুক বেঁধে গণতান্ত্রিক আগামীর খোয়াব দেখছি, জানি না সেটা দিনের খোয়াবই থেকে যায় কিনা! এত কিছুর পরেও আমাদের দেশ নিয়ে আমরা অনেক বেশ আশাবাদী। তাই রবার্ট চেম্বারের ভাষায় বলতে হয়, ‘That is no ground for pessimism. Much can grow on and out of a ruin. Past errors as well achievements contribute to current learning’ [Chambers, 1997:9].
তথ্যসূত্র:
Chambers, R. (1997). Whose reality counts? Putting the first last. London: Intermediate Technology Publications.
বিষয়: বিবিধ
১৫৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন