কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ৫: সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও সংকটময় বিশ্বব্যবস্থা

লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ০৫ মে, ২০১৩, ০৫:৫৩:২৮ সকাল

পাঠকের প্রতিক্রিয়া

বুড়া মিয়া ছদ্মনামের এক পাঠক তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে-‘ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমই হচ্ছে বিভিন্ন মতবাদ সৃষ্টি করে সেগুলো অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া, আর অন্যদের ঐ চাপিয়ে দেয়া মতবাদ বুঝাতে নিরন্তর চেষ্টা করে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে যাওয়া। অন্যদের বুঝতে বুঝতে তাদের ধন-সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে আরেকটি মতবাদ চাপিয়ে দেয়া, এই প্রসেসে শুধু অপরের ধন কুক্ষিগত করার এই প্রসেসটা অনেক দিন যাবতই চলে আসছে এবং এই প্রসেসে তারা বাইরের ধন আহরণ করেই যাচ্ছে’। আমি এপাঠকের অভিমতকে অভিনন্দন জানাই। এখন কথা হলো ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নানা মতবাদের গোলক ধাঁধায় আমরা যারা ঘুরপাক খাচ্ছি, তাদের উদ্ধারের জন্যই আবার প্রয়োজন মানবিক, কল্যাণমুখী বিচার-বিশ্লেষণে পারদর্শী মানুষের দরকার যারা দেশ ও জনগণের স্বার্থে প্রতিটা মতবাদকে ‘গণধোলাই’য়ের ব্যবস্থা করবে যাতে করে সাধারণের জ্ঞান-চক্ষু বিকশিত হয়। সে যাই হোক, আপনার অভিমত আর চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে আর তার জন্যই আমি বৃত্তের ভেতরে থেকেই বৃত্ত ভাঙ্গার খোয়াব দেখছি, বৃত্তের বাইরে গিয়ে নয়- যে কাজটা আমাদের বেগম রোকেয়া সুচারুভাবেই সম্পাদন করেছেন।

পাঠক কুশপুতুল লেখার শিরোনাম দেখে ভেবেছিলেন এটি একটি ধারাবাহিক উপন্যাস- কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখলেন গবেষণামূলক লেখা। তবে উপন্যাসের সংজ্ঞাটা যদি সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে না দেখে সমাজ-বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেখেন, তবে হয়ত আপনার ধারণাই ঠিক- শেষ পর্যন্ত এটি পরিণত হবে একটি ধারাবাহিক প্রেমের উপন্যাসে- তবে মানব-মানবীর প্রেমের উপন্যাস নয়, দেশ-প্রেমের বিবর্তনের ইতিহাস।

পাঁচ: সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় ও সংকটময় বিশ্বব্যবস্থা

আমাদের মনে রাখতে হবে- এটা মনে করা ভুল যে, আমাদের সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতি থেকে পৃথক রাখা উচিত। লেনদেনের মধ্যে দিয়েই একটি সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটে। কিন্তু তাই বলে সংস্কৃতিক মিথোস্ক্রিয়ার নামে অপসংস্কৃতি আবাহনও মেনে নেয়া যায় না। আমাদের বুঝতে হবে যেসব কারণে নৈতিক অধ:পতনের সমস্যা, সাংস্কৃতিক আত্মহত্যা এবং রাজনৈতিক অনৈক্য আমাদেরকে দিন দিন একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেই সব কারণেই আমাদেরকে সাংস্কৃতিক শুদ্ধাচারী হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে জাতি বলতে আমরা যা বুঝি, তাহলো

‘cultural communes constructed in people’s minds and collective memory by the sharing of history and political projects’ [Castells, 1997:51].


বর্তমানে সময়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর (State Institutions) কমে যাওয়া এবং আত্মপরিচয়ের রাজনীতির প্রদুর্ভাব সমাজ বিজ্ঞানীদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে যাই হোক, বর্তমান বিশ্ব-(অ)ব্যবস্থায় আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই মৌলিক রূপান্তরের বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন থাকা দরকার। আমাদেরকে সামাজিক ও সাংস্কৃতি বিবর্তন আর রূপান্তরের ইতিহাস পর্যালোচনা এখানে একটা বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে যে, যে কোন ঘটনা একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে। একই সময়ে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, এই প্রক্রিয়াগুলো কখনোই পরিপূর্ণভাবে বড় বড় চিন্তাভাবনার কিংবা কোন বিদ্যমান তত্ত্বের সাথে মিলতে নাও পারে। সে যাই হোক, জনপ্রিয় পর্যালোচনায় (Popular Discourse) নানা মতবাদ সামাজিক কর্মকান্ডকে অসংলগ্ন সাংস্কৃতি মূল্যবোধ ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।

আমাদের এপৃথিবীটা দিন দিন আরো নৈরাজ্যিক আর বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে এবং সাথে সাথে হয়ে উঠছে প্রবল আক্রমণাত্মক ও হিংস্র। এটা যেসব কারণে এমন হচ্ছে সেসব বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমাদের বোঝার ও তার জন্য কাজ করারই ব্যর্থতা, এবং সাথে সাথে গণমাধ্যমগুলো এটাকে আরো কঠিন করে তুলেছে যে, অজ্ঞতা আর অনীহাকে টিকিয়ে রাখতে তাদের পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন [Ignatieff, 1998:8]।

ডেবিড করটেনের মতে, বৈশ্বিক ত্রিমাত্রিক মানবিক সমস্যাগুলো- গভীর দারিদ্র্য, সামাজিক অসংহতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়- বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। তাঁর মতে:

‘Even in the world’s most affluent countries, high levels of unemployment, corporate downsizing, falling real wages, greater dependence on part-time temporary jobs without benefits, and the weakening of unions are creating a growing sense of insecurity. ...The world is increasingly divided between those who enjoy opulent affluence and those who live in dehumanizing poverty, servitude and economic insecurity. …

Evidence of the resulting social stress is everywhere: in rising rates of crime, drug abuse, divorce, teenage suicide, and domestic violence; growing numbers of political, economic and environmental refugees; and even the changing nature of organized armed conflict. …

Environmentally, although there have been important gains in selected localities in reducing air pollution and cleaning up polluted rivers, the deeper reality is one of growing ecological crisis. …The younger generation lives with the question of whether they may be turned into environmental refugees by climate changes that threaten to melt the polar ice caps, flood vast coastal areas, and turn fertile agricultural areas into deserts’ [Korten, 1995:19-21].


লক্ষণীয় যে, গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সম্পদের অসমতা বৃদ্ধি, স্থানীয় সংঘর্ষের বিস্তৃতি, এবং নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা, আন্তর্জাতিক দেনা, ধর্মী উন্মাদনা এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী সামষ্টিক পরিচয়ের রূপ- এসব কিছুই সম্ভাব্য ‘সামাজিক অস্থিতিশীলতা’ তৈরীর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তাই পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশের গরীব জনসাধারণও গভীর দারিদ্র, সামাজিক অসংহতি আর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ক্ষমতা এখন এক সময়ের প্রভাবশালী পাশ্চাত্যের দেশগুলোর হাত থেকে চলে যাচ্ছে অন্যদের কাছে। এতেই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই তারা বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নানা দেশ নানা রকমের হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। সেই কারণেই-
‘Western intervention in the affairs of other civilizations is probably the single most dangerous source of instability and potential global conflict in a multi-civilizational world’ [Huntington, 1996:312]।


আত্মপরিচয়ের রাজনীতি কি এখন আগের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ? আর এটা কি একুশ শতকের সামাজিক কর্মকান্ডের মূল চালিকা শক্তি হবে? এর জবাবে যে কারোই উত্তর হবে যে, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা করার এটা তেমন উপযোগী পন্থা নয়। কারণ আত্মপরিচয়ের রাজনীতির এক রূপ কিংবা অন্য রূপ সবসময়ই অনিবার্যভাবে মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই প্রেক্ষাপটে সন্দেহাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানাধরণের যৌথ-আত্মপরিচয় যেগুলো সামাজিক বিজ্ঞানী কিংবা বিশ্লেষকদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। আর সেসবই এখন অনুসন্ধানের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

তথ্যসূত্র:

Castells, M. (1997). The power of identity. Oxford: Blackwell.

Huntington, S. P. (1997). The clash of civilizations and the remaking of the world order. London: Touchstone.

Ignatieff, M. (1998). The warrior’s honor: Ethnic war and the modern conscience. London: Catto & Windus and Random House.

Korten, D. (1995). When corporations rule the world. San Francisco: Kumarian Press.

বিষয়: বিবিধ

১১৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File