কষ্টে কাটে নষ্টপ্রহর, পর্ব- ৪: গণমুখী রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও শ্রেণী সংগ্রাম
লিখেছেন লিখেছেন মাহরুফ চৌধুরী ০৪ মে, ২০১৩, ০৭:৪২:১৭ সকাল
চার: গণমুখী রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও শ্রেণী সংগ্রাম
‘জনস্বার্থের রাষ্ট্র’ (Public Interest State)- ধারণার প্রবক্তাদের সমালোচনাকারীরা দু’টো দৃষ্টিকোণ থেকে এর ধারণাটিকে আক্রমণ করে থাকেন। প্রথমত, তারা অস্বীকার করেছে যে, কোন একক ও সনাক্ত করার মতো ‘জনস্বার্থ’ (Public Interest) বলে কিছু নেই। সমালোচনাকারীদের মধ্যে যারা এই সারির, তারা হলেন উন্নয়ন অর্থনীতির আমূল সংস্কারবাদী তাত্ত্বিকেরা যারা সাধারণত ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারেবিয়ান ও আফ্রিকার অধিবাসী [Hewitt et al, 1992]। এ ধারার লেখকেরা মাক্র্সীয় তত্ত্বের দ্বারা প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত। তারা ‘জনসাধারণ’ কে কখনই একই দলভুক্ত বলে মনে করেন না। তার পরিবর্তে তারা দেখেন যে, প্রকৃতপক্ষে সমাজ ও অর্থনীতি নানা সামাজিক শ্রেণীতে বিভক্ত। এই বিভাজনে দু’টো খুব গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো- যারা বাজারের জন্য পণ্য উতপাদনের উপকরণের মালিক এবং আর যাদের মালিকানা নেই। এসমালোচকদের মতে, উন্নয়নশীল দেশে এই শ্রেণী কাঠামো আরো জটিল হয়ে ওঠে যেখানে বৃহদায়তন উতপাদনের মালিকানা থাকে বিদেশীদের। ফলে স্থানীয় ‘জাতীয় বুঁর্জোয়া’ ধনবাদীরা সাধারণতই দুর্বল হয়।
জনস্বার্থের রাষ্ট্র ধারণার সমালোচনাকারীদের মতে তাই রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে এ শ্রেণী সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে- একটি প্রতিষ্টান হিসেবে যেটি ক্ষমতা প্রদর্শণ করে (অবদমন, সংঘাত-সংঘর্ষ এবং অর্থনৈতিক ও প্রাশাসনিক ক্ষমতা) একটি প্রধান্য বিস্তারকারী শ্রেণীর দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থে- কিন্তু বিমূর্ত ‘জনস্বার্থ’-এ নয়। মাক্র্স নিজেও তার ‘কমিউনিস্ট মেনিফ্যাস্টো’তে রাষ্ট্রকে ‘a committee for managing the common affairs of the whole bourgeoisie’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা বেশ বিখ্যাত।
পাশ্চাত্যে এধরণের রাষ্ট্র সম্ভবত লোকজ শিল্প উন্নয়নে সহায়ক হয়। এটা হয়তো একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র তৈরী করে- পরিকল্পিত শ্রমের প্রতি সাড়া দিয়ে শিল্পায়িত সংঘাত কমাতে এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাইতো দেখা যায়-
‘The ways in which we interact with the state are contradictory- they leave many people confused. We seem to need things from the state, such as child care, houses, medical treatment. But what we are given is often shoddy or penny pinching, and besides, it comes to us in a way that seems to limit our freedom, reduce the control we have over our lives… it is not just that state provision is inadequate, under-resourced and on the cheap. … The way it is resourced and administered to us doesn’t seem to our real needs.
State provision leaves a bad taste in our mouths. State institutions are often authoritarian, they put us down, tie us up with regulations.
A distinction is often made between our public and our private life. But even the parts of our life designed private do not any longer, if they ever did, seem to be fully under our control or unaffected by the state and its policies. The state seems at times to penetrate even our closest relationships with each other …officialdom has a well defined view about the family and what it should be’ [LEWRG, 1979:5-6].
কিন্তু সমালোচকদের মতে, আমরা যদি উন্নয়নশীল বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে রাষ্ট্রকে প্রকৃতপক্ষে আমরা পাব একটি তালগোল পাকানো প্রতিষ্ঠান হিসেবে। এক্ষেত্রে দুর্বল রাষ্ট্র সাধারণত বিদেশী কম্পানীগুলোর- যারা সস্তা শ্রম আর স্থানীয় শিল্পায়নের প্রতিযোগিতাকে প্রতিহত করে- তাদের উদ্দেশ্যকেই সাধন করে। ফলে রাষ্ট্র স্থানীয় শিল্পায়ন উন্নয়নের বদলে সম্পদ ও রসদ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়, শ্রমিক সংগঠনগুলোকে চাপের মধ্যে রেখে এবং কল্যাণমুখী কার্যক্রম প্রতিহত করে যার ফলে শ্রমের মূল্য বাড়িয়ে তোলে যখন নিজস্ব কর্মচারী ও সমর্থকদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের পথ খুঁজে।
উপরের প্রেক্ষাপটেই দু’জন আফ্রিকান লেখক- ঈসা শিবজী এবং মাহমুদ মামদানী- রাষ্ট্রকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। তারা দু’জনই রাষ্ট্রের কর্মচারীদেরকে ‘স্থানীয় পেটি বুঁর্জোয়া’ হিসেবে দেখেছেন: ছোটখাটো সম্পত্তির মালিকদের একটি শ্রেণী যা ব্যবসায়ী এবং ধনী চাষাবাদকারীদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। মামদানী স্বাধীনতা-উত্তর উগান্ডার অবস্থা বিশ্লেষণ করে বর্ণনা করেন কিভাবে ‘পেটি বুঁর্জোয়া’দের ‘উত্তর-উপনিবেশিক শাসক শ্রেণী’তে উত্তরণ ঘটে যারা কিছু সময়ের জন্য ‘নাগরিক বুঁর্জোয়া’দের স্বার্থ সংরক্ষণের ‘অবিভাবক’ হিসেবে কাজ করেছে। এধরণের ‘মধ্যস্বত্ত্বভোগী’ শাসক শ্রেণীর উদ্ভবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মততপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে-
‘Given that it is located both within the state (state bureaucracy) and outside of it (kulaks, traders), the petty bourgeoisie has two alternative methods of accumulation: to use the state to create public property, which the petty bourgeoisie would then control indirectly through its control over the state; or to use the state to expand individual private property, which the petty bourgeoisie would then control directly through ownership’ [Mamdani; 1976:314, emphasis in original].
উক্ত দু’জন লেখকই আফ্রিকান অর্থনীতির স্বাধীনতা-উত্তরকালের সরকারী সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের বিশ্লেষণ করেছেন জাতীয়করণ এবং আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বানিজ্যের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠিতে, আর রাষ্ট্রীয় আমলাদের শ্রেণী স্বার্থের মাপকাঠিতে। তানজানিয়ার বিষয়ে শিবজী লিখেছেন যে, যখন রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়, তখন-
‘… on top of the adminstrative bureaucracy of the civil service-type running the state machinery there arises the economic bureaucracy… [which] is involved directly in running the production process’ [Shivji, 1973:10-11].
এপ্রক্রিয়ায় ‘শাসনকারী আমলাতন্ত্রে’র জন্য দু’টো সুবিধা আছে। এটা এর ব্যবসায়ী ও চাষাবাদকারীদেরকে একটি অর্থনৈতিকভিত্তিক স্বাধীনতা প্রদান করে। এটা আরো সহায়তা করে জাতীয় ও সমাজবাদী (Socialist) উন্নয়নের মাধ্যমে বিশেষ স্বার্থের সাথে সমাজের সাধারণ স্বার্থের সনাক্তকরণে [Mamdani, 1976]। সরকার ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর যৌথ কার্যক্রমের দু’পক্ষের স্বীকৃত সুযোগ-সুবিধার দ্বারা এঅর্থনীতির ভিত মজবুত হতে থাকে। বিদেশী কোম্পানীগুলো সাধারণত অর্থ পায় খেসারত, পেটেন অধিকার, ট্রেডমার্ক এবং বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপনা পরামর্শক সর্বরাহ এবং নাগরিক আমলাদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতির মাধ্যমে, একই সাথে ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে [Shivji, 1973]। প্রতিদান হিসেবে স্থানীয় অর্থনৈতিক আমলারা এবং তাদের সহযোগীরা বেশ আকর্ষণীয় পরিচলনা পর্ষদের পরিচালকের পদ, মোটা অংকের বেতন এবং পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। স্থানীয় অর্থনৈতিক আমলারা এবং বাহিরের ধনতান্ত্রিকরা যখন সহযোগীতে পরিণত হয়, কেবল তখনই ঘুষ এবং সরকারী দফতরকে ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য ব্যবহৃত হয় [Mamdani, 1976]। এভাবে ‘আমলা মূলধন’ (Bureaucrat Capital) গ্রামে ও শহরে ব্যক্তিগত মূলধনের সঞ্চয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে [Mamdani, 1992]।
এটি হলো ‘জনস্বার্থ’ যুক্তির একটি অতি সরলীকৃত চিত্র। কিন্তু এটি রাষ্ট্রের একটি সঙ্গতিপূর্ণ অথচ নৈরাশ্যবাদী ভিশন- যা কিনা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিশালী ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণ করে। এটা আরো বাজারের সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, কোন পরিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ কার্যকর পদ্ধতি নেই যা কিনা জনস্বার্থের সফলভাবে কাজ করবে। জনস্বার্থের পরিবর্তে বাজার গঠিত হয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেগুলো তাদের মালিকদের স্বার্থে শক্তি প্রয়োগ করে যায়। বাজার ক্ষমতার ব্যবহারের মধ্যমে ধনী ও তাদের রাজনৈতিক সহচরেরা নিজস্ব স্বার্থে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার শুরু করে দেয়- যেটা আমরা বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাচ্ছি অতন্ত স্পষ্টভাবে।
তথ্যসূত্র:
Hewitt, T., Johnson, H. and Wield, D.(1992). Internationalization and development. Oxford: The Open University/Oxford University Press.
LEWRG (London-Edinburgh Weekend Return Group). (1979). In and against the state. Edinburgh: Black Rose Press.
Mamdani, M. (1976). Politics and class formation in Uganda. London: Heinemann.
Shivji, I. (1973). The silent class struggle. Dar es Salam: Tanzania Publishing House.
বিষয়: বিবিধ
১০৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন