পার্বত্য এলাকায় খ্রিস্টীয়করণ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব!!!

লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া পারভীন হাবিবা ২৮ মে, ২০১৩, ১১:৪১:২৯ সকাল



বাংলাদেশ হওয়ার সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একটা সমস্যায় পড়ে গেলাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য ‘রাজা’ ত্রিদিব রায় পাকিস্তানিদের পক্ষে অবস্থান নিলেন (সম্প্রতি তিনি মারা গেছেন)। ত্রিদিব রায় পাকিস্তানিদের খুশি করার জন্য কিছু চাকমাকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী বানিয়েছিলেন। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের ধরিয়ে দিতে থাকে। ফলে রাঙ্গামাটি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এ কারণে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিল যে, চাকমারা সবাই রাজাকার হয়ে গেছে। ’৭১ সালে যখন কলকাতায় ছিলাম, সেখানে আমরা ‘সাপ্তাহিক দেশবাংলা’ পত্রিকা বের করি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণার জন্য। ওতে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম চাকমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে। ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম কলেজে চাকমা ছাত্রদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তাদের কয়েকজন আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। এ কারণে পাহাড়ি জনগণের প্রতি বরাবরই আমার একটা সফট কর্নার রয়েছে। ব্যক্তিগত কারণ তো সব ক্ষেত্রেই কাজ করে। ’৭২ সালে দেশে ফিরে আবার লিখেছিলাম, ‘চাকমাদের কাছে টানো’। ওই নিবন্ধে লিখেছিলাম, চাকমাদের নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হবে। ইতিপূর্বে যাই ঘটে থাকুক না কেন, তার সঙ্গে সব চাকমাকে জড়িত করা ঠিক হবে না। ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি বনে গেছেন, কিন্তু সাধারণ চাকমারা তো কোন দোষ করেনি। তাদের নিয়েই আমাদের থাকতে হবে। এই অঞ্চলে আমরা একটা স্থায়ী অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারি না। ওদের কাছে টানতে হবে।

সমস্যা হয়ে গেল ১৯৭৪ সালে। মানবেন্দ্র লারমা, সন্তু লারমার বড় ভাই, তখন আমাদের জাতীয় সংসদের সদস্য। সংসদে পার্বত্য এলাকা থেকে সেবারে ২ জন সদস্য ছিলেন। মানবেন্দ্র লারমা এবং চাই চ’ রোয়াজা। রোয়াজা ছিলেন বান্দরবান এলাকার এবং লারমা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি এলাকার। তারা পাহাড়িদের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। তখন তারা নিজেদের ‘উপজাতীয়’ বলতেন। তারা সব উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ‘জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি চাইলেন। তাদের জন্য বিশেষ কিছু অধিকার সংরক্ষণের দাবি করলেন।

যেদিন মানবেন্দ্র লারমা এবং চাই চ’ রোয়াজা শেখ সাহেবের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেন, আমাদের ‘দেশবাংলা’ পত্রিকার অফিস ছিল তখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে, সেদিন তারা দু’জন আমাদের অফিসে এলেন সকালের দিকে। এসে আমার টেবিলের পাশে তাদের দুটো হাতব্যাগ রেখে বললেন, ‘আজ আমাদের সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে শেখ সাহেবের। ওটা সেরে আসি। তারপর আপনার সঙ্গে কথা বলব।’ আমি চা খেয়ে যেতে বললাম। তারা বললেন, ‘ফিরে এসে খাব।’

তারা চলে গেলেন দ্রুত। প্রায়ই তারা এরকম করতেন। বিকালে যখন ফিরে এলেন, দেখলাম দু’জনেরই মুখ কালো। বললাম, ‘কী হয়েছে’? বললেন, ‘শেখ সাহেব কোন কথা শুনলেন না। আমাদের বললেন বাঙালি হয়ে যাও।’

বিষণœ মুখে চা খেয়ে তারা দু’জন চলে গেলেন। এই যে যাওয়া, এর পর লারমাকে আর কোনদিন দেখিনি। তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন এবং ‘শান্তিবাহিনী’ বানালেন।

আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক সুযোগ নষ্ট করেছি। আমাদের তখনই সুযোগ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করে ফেলার। তারা তখন মোটেই হোস্টাইল ছিল না। তারা নমনীয় ছিল। তারা আমাদের সঙ্গে ওঠাবসা করত। মানবেন্দ্র লারমা ও রোয়াজা যখন হিলট্রাক্টস্ থেকে সংসদে জয়ী হয়ে এলেন, ‘দেশবাংলা’ কার্যালয়ে আমরা তাদের সংবর্ধনার আয়োজন করলাম। এই সুসম্পর্কগুলো আমরা যদি কাজে লাগাতে পারতাম, তাহলে শান্তিবাহিনী গড়ে উঠবে কেন। লারমা কখনোই ভারতমুখী ছিলেন না। তিনি সমাজতন্ত্রী ছিলেন। রাজতন্ত্র বিরোধী ছিলেন। চাকমা রাজার বিরোধী ছিলেন।

১৯৭৪ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে লারমা বলেছিলেন, “ঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যে উপজাতীয় সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান, তা দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যুগের পর যুগ অতিবাহিত হয়েছে, মানুষ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছে, কিন্তু সে উন্নতি পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে থেমে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের লোক ‘বহির্ভূত’ এলাকায় বাস করে এবং তাদের কোন গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। সংবিধানে উল্লেখ আছে বাংলাদেশ একটি ‘একক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র’। কিন্তু কী কারণে আজ পর্যন্ত এই এলাকাকে ‘বহির্ভূত’ এলাকা গণ্য করা হয় তা বোঝা যায় না।”

এ থেকে বাংলাদেশের প্রতি লারমার এবং তার সঙ্গীদের তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। আমরা কি সে দৃষ্টিভঙ্গির মর্যাদা দিয়েছি?

সেদিনের সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে প্রচণ্ড সমস্যা সৃষ্টি হয়ে গেল। বিক্ষুব্ধ চাকমারা সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করল। তখন কেবল চাকমারাই এতে ছিল। ভারতে চলে গেল প্রায় ৫০ হাজার চাকমা। সেখানে ভারত সরকার তাদের অস্ত্র দিল, গোলাবারুদ দিল। তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল। বাংলাদেশ সরকারকেও সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়াতে হল।

সম্পর্কটা আজ অনেক তিক্ততার পর্যায়ে চলে গেছে। কিন্তু যেখানেই যাক না কেন, একথা সবাইকে মনে রাখতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ডিফেন্স চিন্তাই করা যাবে না। আমরা যদি ম্যাপের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চল একটা সরু সমুদ্র উপকূল মাত্র। এটা আন-ডিফেন্ডেবল হয়ে যায় সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা আর ডিফেন্ডেবল থাকে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম এজন্য স্ট্রাটেজিক্যালি আমাদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। কারণ চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের কোন অবস্থান থাকে না। আমাদের পুরা বিষয়টি সেই সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপলদ্ধি করতে হবে।

এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আজকে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশ, সংগঠন, সংস্থা তৎপর হচ্ছে; সেটা কেন হচ্ছে। শতাব্দীকাল পূর্ব থেকে এ অঞ্চলে একটা খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে আসছে। এশিয়ার বুকে ‘দ্বিতীয় ইসরাইল’। শত বছরের প্রজেক্ট। সেটা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাদ দিয়ে তৈরি করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে বইপুস্তক, কাগজপত্র, মানচিত্র তৈরি হয়েছে। বিভিন্নভাবে তৎপরতা চলে আসছে ও চলছে। আমাদের পার্বত্য এলাকা নিয়ে ওয়েব সাইটে নিত্যদিন নতুন নতুন পোস্ট যুক্ত হচ্ছে, যা পড়লে মনে হবে সেখানে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কিছু নেই। আর এই সেনাবাহিনীর একমাত্র কাজ হচ্ছে ‘নারী ধর্ষণ’। তাদের আর কোন কাজ নেই। সেখানে যারা বাঙালি আছে, তাদেরও সবাই ধর্ষক ও চোর-লুটেরা। সব একতরফা ও অতিরঞ্জিত প্রচারণা। জবাব দেয়ার কেউ নেই। না বাংলাদেশ সরকার না কোন বেসরকারি সংস্থা। পার্বত্য এলাকার বাঙালিদের যারা প্রতিনিধিত্ব করেন বা পাহাড়িদের মধ্যে যারা এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তারা বোধহয় এত কিছুর খবরই রাখেন না। ‘কমিশন ফর চিটাগাং হিলট্রাক্টস’ খাড়া করা হয়েছে। তারা কারা? কোন অধিকারে তারা এটা করেছে? নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ব্যাংকক, ওসাকা, নিউইয়র্ক, লন্ডনÑ সর্বত্র নিত্যদিন মিটিং, ওয়ার্কশপ চলছে। নানা ‘রিপোর্ট’, ‘গবেষণাপত্র’ তৈরি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ব তিমুরের সঙ্গে একই পর্যায়ে ফেলে লেখা হচ্ছেÑ ‘জেনোসাইড ইন চিটাগাং হিলট্রাক্টস অ্যান্ড ইস্ট তিমুর’। চিটাগং হিলট্রাক্টস এখন সারাবিশ্বে হট নিউজ। এত ক্ষুদ্র জায়গা নিয়ে এমন তৎপরতা কেন?

ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, এই উপমহাদেশের স্বাধীনতার আগে, ’৪৭ সালের আগে, ১৯৪০-এর দিকে এই কনসেপ্ট নিয়ে বড় রকমের তোড়জোড় চলেছিল। ওই সময় একজন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসার মি. কুপল্যান্ড এ নিয়ে একটা প্রকল্প দাঁড় করিয়েছিলেন। যাকে ‘কুপল্যান্ড প্ল্যান’ নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের উত্তর-পূর্ব দিকে এখন ভারতের যে সাতটি রাজ্য আছেÑ আসাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল, মনিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়, যাকে ‘সেভেন সিস্টার’ বলা হয়, এই সাতটি রাজ্যের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সম্পৃক্ত করে, তার সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল, কক্সবাজার, শংখ নদী থেকে দক্ষিণ দিকেÑ এই অঞ্চলগুলো নিয়ে, তার সঙ্গে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) সন্নিহিত বেশ কিছু এলাকা নিয়ে তৈরি হবে পৃথক একটি রাষ্ট্র। বাদবাকি উপমহাদেশ ও বার্মাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে কিন্তু মাঝখানের পাহাড়ি এলাকাকে তখনই স্বাধীনতা দেয়া হবে না। ভারত, পাকিস্তান, বার্মার বাইরে আরও কিছুদিন ধরে রাখা হবে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনে, ‘ক্রাউন কলোনি’ হিসেবে। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা যেভাবে রাখা হয়েছিল। সময় হলে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা দেয়া হবে। অতঃপর নাফ নদীর মোহনা থেকে চীন সীমান্তের অরুণাচল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বাস্তব রূপ নেবে স্বপ্নের ‘খ্রিস্টান রাষ্ট্র’।

এটাই ‘কুপল্যান্ড প্ল্যান’। ব্রিটেনের মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্টে এ নিয়ে অনেক আলোচনা, অনেক দেনদরবার হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার এতে সায় দেয়নি। কারণ তখন উপমহাদেশে ও বার্মায় ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে। একদিকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তুঙ্গে, অন্যদিকে অং সান সু চির পিতা জেনারেল অং সানের নেতৃত্বে বার্মাও স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। ব্রিটিশ সরকার সেই সময়ে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর প্রস্তাব সামনে আনার ঝুঁকি নিতে চাইল না। কারণ তাহলে ভারত-পাকিস্তান ও বার্মায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। গান্ধী-নেহরু, জিন্নাহ বা অং সান কেউই এ ব্যবস্থায় রাজি হতেন না। ব্রিটিশের পক্ষে নিজেদের ভবিষ্যৎ স্বার্থ অটুট রেখে শান্তিপূর্ণভাবে পিছু হটা যেত না।

‘কুপল্যান্ড প্ল্যান’ তখনকার মতো চাপা পড়লেও পশ্চিমের গোঁড়া খ্রিস্টান গোষ্ঠীগুলোর মাথা থেকে সেই ‘প্রকল্পটি’ চলে গেছে বলে মনে হয় না। মনে হয়, সেজন্যই পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে এত তৎপরতা। এই ক্ষুদ্র এলাকাটির ওপর এমন শ্যেনদৃষ্টি।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে খ্রিস্টীয়করণের লক্ষ্য অনেকাংশেই সফল হয়েছে। এখনও সেখানে সেই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলেছে। লক্ষ্য করার বিষয়, ’৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার আগের চেয়ে তার পরবর্তীকালেই সেখানে খ্রিস্টীয়করণ অনেক বেশি হয়েছে। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, এই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের ‘ভারতীয়’ ভাবতেই অভ্যস্ত ছিল না। মিশনারিরা তাদের সেই ‘সাইকি’ কাজে লাগিয়েছে এবং এখনও লাগাচ্ছে। ভারত সরকার বিলম্বে হলেও বিষয়টি বুঝতে পেরে এ অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারি কার্যক্রমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। সেখানে বিদেশী মিশনারিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি রেভারেন্ড স্কটের মতো ওই অঞ্চলে দীর্ঘকাল অবস্থানকারী খ্যাতনামা ধর্মযাজককেও সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বাংলাদেশের জনগণ এবং বাংলাদেশ সরকারেরও সেই উপলব্ধিতে পৌঁছানোর সময় বোধ হয় পার হয়ে যাচ্ছে।

আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১/১২টি নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা ও টিপরা ছাড়া অন্যদের জনসংখ্যা খুবই কম। এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যেই খ্রিস্টীয়করণ জোরেশোরে চলছে। বান্দরবানের তিনটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় সব সদস্যকেই খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এটাও হয়েছে বেশিরভাগ বাংলাদেশ হওয়ার পর। এখন বড় তিনটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীÑ চাকমা, মারমা ও টিপরা সম্প্র্রদায়ের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে।

চাকমা ও মারমারা নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ। সেটাই খ্রিস্টান মিশনগুলোর সামনে বড় বাধা। কিন্তু সাম্প্র্রতিককালে চাকমা ও মারমাদের মধ্যেও খ্রিস্টীয়করণের পালা শুরু হয়েছে। ঠিক কতজন চাকমা বা মারমাকে ইতিমধ্যে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। ১৯৭১-এর আগে একজন চাকমাও খ্রিস্টান হয়েছে বলে শুনিনি। এখন বেশকিছু খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী চাকমা দেখা যায়। এ ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান নেয়া দরকার।

লক্ষ্য করার বিষয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্র্কে দেশে-বিদেশে যে প্রচারণা চলছে তাতে বলা হয় সেখানে দলে দলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাহাড়িকে জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে। আসলে কি তাই? গত ষাট বছরে ক’জন চাকমা মুসলমান হয়েছে? বোধ হয় তা আঙুলে গোনা যাবে। আর তারও প্রায় সবই বিবাহ সংক্রান্ত। মিশনারি তৎপরতার মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষিত করার ঘটনা নেই বললেই চলে। তবু বাইরের দুনিয়ায় তেমন অপপ্রচার চলছেই। এমনকি কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্যাংককের রাস্তায় মানববন্ধন করেছেন, তাদের হাতে ব্যানার ফেস্টুনÑ ‘ঝঃড়ঢ় ভড়ৎপরনষব পড়হাবৎংরড়হ ড়ভ ইঁফফযরংঃং ঃড় ওংষধস রহ ঈযরঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং.’ এমন নির্জলা মিথ্যাচার ও অপপ্রচার মহামতি বুদ্ধের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এখন যদি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়কে ব্যাপকভাবে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা যায়, তাহলে পরিস্থিতিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা সব মহলকে ভেবে দেখতে হবে। বৌদ্ধধর্মের যারা ধারক তাদেরও ভাবতে হবে।

কেউ যদি বুঝেশুনে স্বেচ্ছায় খ্রিস্টধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। খ্রিস্টান হওয়াটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কোন এলাকায় ব্যাপক ধর্মান্তরের উদ্যোগ নেয়া এবং ওই এলাকার জনমিতি পাল্টে দেয়া অনৈতিক, অধর্ম ও অগ্রহণযোগ্য। ওটা মধ্যযুগে হয়েছে। আজকের দিনে অচল। আজ যেভাবে আমাদের পার্বত্য এলাকায় অসংখ্য এনজিও বিপুল অর্থ-সম্পদ নিয়ে সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে ধর্মান্তরের কাজে লিপ্ত রয়েছে, তার পরিণতি কী হতে পারে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। সেখানে ভারত সরকারকে ৬ লক্ষাধিক নিয়মিত সৈন্য এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন রেখেও পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি নাজুক। অথচ পার্বত্য এলাকা থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার দাবি তোলা হচ্ছে। আমাদের কথিত সুশীল সমাজের অনেকে বুঝে বা না বুঝে সেই দাবিতে কণ্ঠ মিলিয়ে থাকেন।

পার্বত্য এলাকায় এখন তো প্রধান সংঘাত পাহাড়িদেরই দুটি গ্র“পের মধ্যে। একটি গ্র“প শান্তিচুক্তিরও বিরোধী। তাদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত লেগেই আছে। দু’পক্ষই অস্ত্রধারী। তারা উভয় পক্ষ পাহাড়ি-অপাহাড়ি নির্বিশেষে সেখানকার নাগরিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন সেখানে কঠোর সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে পুরো এলাকাটিতে মাৎস্যন্যায় নেমে আসবে।

দেশের সব জেলাতেই সেনাবাহিনী কমবেশি আছে। সেনাবাহিনী থাকে প্রয়োজন অনুযায়ী। সেনাবাহিনী থাকবে কী থাকবে না, সেটা জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিচারে স্থির হতে হয়। সব দেশেই সেই নিয়ম। কোথাও কি এমন নিয়ম আছে, স্থানীয়দের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর সেনাবাহিনী মোতায়েন বা প্রত্যাহার করতে হবে? সে রকম দাবি তোলার চিন্তা করাই চরম দায়িত্বহীনতা।

সেনাবাহিনীর কোন সদস্য যদি পার্বত্য এলাকায় কর্মরত অবস্থায় কোন অন্যায় বা অসদাচরণ করে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সেটা সাধারণ সাজার চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। সেনাবাহিনীর লোকেরা পার্বত্য এলাকায় কাজের জন্য বাড়তি ভাতা পেয়ে থাকে, তারা সেখানে অন্যায় করলে শাস্তিটাও বাড়তি হবে না কেন?

উপসংহার

এতক্ষণ যে আলোচনা করেছি, তা থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি, আমাদের পার্বত্য এলাকায় অশান্তির বীজ ব্রিটিশ আমলে রোপণ করা হয়েছে। আর তা করা হয়েছে এলাকাটিকে সমতল থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের ‘গেইম রিজার্ভ’ তৈরি করার মধ্য দিয়ে, যে প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। এমতাবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সব বিদেশী মিশনারি তৎপরতা নিষিদ্ধ করে সেখানে কর্মরত সব এনজিও সংস্থার কার্যক্রম ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেয়ার এখনই সময়। তারা সেখানে যেসব সেবামূলক কাজ চালায়, তার অর্থায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

আমাদের এই পার্বত্য এলাকার ওপর নিবিড় নজরদারি নিশ্চিত রাখা, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখা বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। সেজন্য এই এলাকার প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোন অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার চলছে তার উপযুক্ত জবাব দেয়া এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা করা জরুরি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি নির্বিশেষে সব নাগরিকের পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে পিছিয়ে থাকা নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে এগিয়ে আনার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নও সরকারকেই করতে হবে। মানবতার ভেকধারী দায়বদ্ধতাহীন দেশী-বিদেশী এনজিও গোষ্ঠীর হাতে এ এলাকার ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়া যাবে না।

বিষয়: বিবিধ

১২৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File