কেন জানি সেই চেনা পথেই তাকে আবার হাঁটতে দেখছি।
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া পারভীন হাবিবা ০৭ মে, ২০১৩, ০৯:০১:৪৫ রাত
শাপলা চত্বর শান্ত। মাঝরাতের যৌথ বাহিনীর অভিযানে হেফাজতের আওয়াজ থেমে গেছে। তবে ছড়িয়েছে দেশব্যাপী। সকালেই কাঁচপুরে তার প্রমাণ মিলেছে। প্রায় দশ হাজার যৌথ বাহিনীর সদস্য শাপলা অভিযানে অংশ নেয়। সেখানে কি ঘটেছে, কিভাবে সামাল দেয়া হয়েছে তা নিয়ে অন্তহীন গুজব। দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দু’টি টেলিভিশন একসঙ্গে বন্ধ করে দেয়ায় গুজবের মাত্রা আরও বেড়েছে। অন্য গণমাধ্যমগুলো স্বাভাবিক কারণেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। যে কারণে রাতের অভিযানে কত লোক মারা গেছে তা এখনও অস্পষ্ট। কি হচ্ছে, কি হবে? এ নিয়েই মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা যেমন ছিল, তেমনি ছিল কৌতূহল। হেফাজতের চরমপত্র এক মাস আগেই দেয়া হয়েছিল। সরকার আলোচনা করেননি, তা নয়। কখনও মন্ত্রী, কখনও ব্যবসায়ীরা নানা পরিচয়ে হেফাজতের সঙ্গে কথা বলেছেন। গোয়েন্দারা তো সার্বক্ষণিকভাবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন। কথাও বলেছিলেন হেফাজতের আমির আল্লামা আহমেদ শফীর সঙ্গে। ফল হয়নি। মাঝখানে ২রা মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সংবাদ সম্মেলনে ১৩ দফা দাবি নিয়ে কথা বলেছেন দফাওয়ারী। তাতেও কোন কাজ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। কারণ, তারা সবাই প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন ঢাকা অবরোধে যোগদানের। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে কথা বলেছেন তা যদি হেফাজত নেতাদের সঙ্গে চায়ের দাওয়াতে বলতেন তাহলে পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। আল্লামা শফীর সঙ্গে কথা বললেও অসুবিধার কি ছিল। গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম বন্ধ হলো ঠিকই। কিন্তু এর মধ্যেই বুড়িগঙ্গায় যে পানি গড়িয়ে গেছে। আগে বন্ধ করা হলে সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসতো না। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তার দলের নেতাদের সঙ্গেই খুব একটা কথা বলেন না। নেন না তাদের মতামত। স্পিকার মনোনয়নে তার একক সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়েছে। খারাপ ভাল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক। সে বিতর্কে যেতে চাই না। তবে প্রধানমন্ত্রী তার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দলের নেতাদের ইচ্ছার বাইরে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভবিষ্যৎ নির্বাচনকালে তিনি প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে রাজি হবেন না। স্পিকারের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে তিনি সরে দাঁড়াবেন। ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী বয়োজ্যেষ্ঠ। একাধিকবার তিনি জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকেও পুরোপুরি বিশ্বাসের আওতায় আনতে পারেননি। তার কাছে খবর ছিল, শিরিন শারমীন চৌধুরীকে স্পিকার মনোনীত করার পর হয়তোবা ডেপুটি স্পিকার শারীরিক অসুস্থতার কারণে সরে দাঁড়াবেন শপথপাঠ করার আগেই। সে কারণে প্যানেল সদস্য খান টিপু সুলতানকে ঢাকায় থাকতে বলা হয়েছিল। যাক, শেষ পর্যন্ত শওকত আলী পদত্যাগ করেননি। দল নেত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। একই অবস্থা বিরোধী নেত্রীর বেলায়ও। তিনিও তার দলের অধিকাংশ নেতাকে বিশ্বাস করেন না। এমনকি বৈঠক শুরু হওয়ার আগে মোবাইল ফোন জমা দিতে বলেন। আর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে ওয়ান ইলেভেনের পর। রাজনীতিকদের প্রতি অবিশ্বাসের জন্যই যেন জন্ম হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনের। যে কারণে দেশ থেকে রাজনীতি বিদায় নিচ্ছে। হেফাজতের অবরোধে বাংলাদেশ স্তব্ধ হয়েছে। এযাবৎকালে কোন অবরোধ এত প্রভাব ফেলেনি। যেমনটা ফেলেছিল ঢাকা লং মার্চে। শুরুতেই অস্বস্তি তৈরি হয় জনসভার অনুমতি নিয়ে। পুলিশ প্রশাসন অনেক সময় নেয়। এরমধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকায়। অনুমতি ছাড়াই তারা সভা করবে, এমন ঘোষণাও আসতে থাকে। এর মধ্যে হেফাজত কর্মীদের ওপর সরকার সমর্থকরা ঝাঁপিয়ে না পড়লে পরিস্থিতি এতোটা খারাপ হতোনা বলেই বিশ্লেষকরা বলছেন। ভিডিও ফুটেজ কিংবা স্থিরচিত্রে যেসব অ্যাকশনের ছবি দেখা যাচ্ছে, তাতে অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, গায়ে পড়েই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। ফেসবুকের একটি ছবি পরিস্থিতিকে নতুন করে মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন হেফাজত কর্মী মাটিতে শুয়ে আছেন, তার ওপর চড়াও হয়েছেন একজন মহিলা লাঠি নিয়ে। পাশে আরও তিন চারজন পুরুষ উল্লাস করছেন। এ থেকে বুঝা যায়, এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হোক, কোনো একটি মহল তাই চাইছিলেন। হেফাজতের আমির যখন লালবাগ মাদ্রাসা থেকে শাপলা বিস্ফোরণে যোগ দিতে রওনা হলেন, তখন তাকে পলাশীর মোড়ে আটকে বলা হলো- ওখানে নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আছে। তাই সেখানে যাওয়া যাবে না। পুলিশের পাঁচটি গাড়ি তাকে নিয়ে আবার ফেরত চলে গেল। শাপলায় তখন বলা হচ্ছে হুজুর রওনা হয়েছেন, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের মাঝে পৌঁছাবেন। তাকে কেন যেতে দেয়া হলো না, সে নিয়ে অনেক রহস্য। কারা এবং কেন যেতে দিলেন না। তিনি তো বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। অশান্তির বিপক্ষে। এমনকি শাপলায় অবস্থানের বিরুদ্ধেও তার সোচ্চার ভূমিকা ছিল। তিনি সেখানে গেলে কি ঘোষণা দিতেন তাও অজানা রয়ে গেল। হার্ডলাইন বরাবরই গণতন্ত্রের দুশমন। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে গণতন্ত্র বিদায় নিয়েছে একশ্রেণীর শাসকদের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে। বলে রাখি জরুরি অবস্থা কোন সামাধান নয়। নিকট অতীতে আমরা তাই দেখেছি। আলোচনা ছাড়া এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। এ জন্য রাজনৈতিক পণ্ডিত হতে হয় না। রাজনীতি এতোটাই নির্মম নিষ্ঠুর, কিছুটা অমানবিকও। অন্তত বাংলাদেশের বেলায় তা বলা যায়। সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে তখনও অগুনতি লাশ। এর মধ্যেই সংলাপের ডাক এলো। প্রত্যাখ্যানও হয়ে গেল মুহূর্তেই। কতটা আন্তরিকতা ছিল এ সংলাপের আহ্বানে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আমি এ বিতর্কে যাবো না। তবে রাজনৈতিক কমসূচি স্থগিত হলে অসুবিধার কিছুই ছিল না। আসলে রাজনীতিতে অবিশ্বাস এতোটাই দানা বেঁধেছে, কেউ কাউকে সহজে নিতে পারছেন না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিতের আহ্বান জানালেন সেটাও ছিল রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সেটা করতে পারতেন। বিরোধী নেত্রী আরেক ধাপ এগিয়ে। তিনি ৪৮ ঘণ্টার সময় দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কোন প্রতিক্রিয়া আসার আগেই আওয়ামী লীগের দু’জন সিনিয়র নেতা বলে দিলেন, ৪৮ ঘণ্টা কেন ৪৮ মাসেও দাবি মানা হবে না। রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর তরফে একটি প্রতিক্রিয়া এলো মিডিয়ায়। তাতে তিনি বললেন, বিরোধী নেত্রী সংঘাতের পথই বেছে নিলেন, সংলাপে না এসে। এটা বোধকরি অনেকটা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ছিল। আউটরাইট রিজেক্ট করার মধ্যে কি আনন্দ আছে জানি না। তবে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি অজানা এক গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছে। শেষ করছি এই বলে, রাতের অন্ধকারে দিগন্ত এবং ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করার পেছনে যে যুক্তিই থাকুক তা গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তচিন্তার কোন মানুষ এটাকে সহজভাবে নেবে না। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে এ সিদ্ধান্তে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের গায়ে এমনিতেই সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করার তকমা রয়ে গেছে। শেখ হাসিনা সেই তকমা ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। কেন জানি সেই চেনা পথেই তাকে আবার হাঁটতে দেখছি। পত্রিকা থেকে হুবহু। The Daily Manob Zamin
বিষয়: বিবিধ
৯৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন