কবে কিভাবে আওয়ামী-লীগ সরকার বিদায় নেবে।

লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া পারভীন হাবিবা ০৩ মে, ২০১৩, ০৩:২৭:০২ দুপুর

বর্তমান আওয়ামী সরকারে আমলে যে বারোটি বিশাল মানবিক বিপর্যয়ে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং বিরাট আর্থিক বিপর্যয়ে বহু মানুষ তাদের সঞ্চয় হারিয়েছে, সেসব ঘটনার পেছনে কোন আওয়ামী মন্ত্রী-নেতারা সম্পৃক্ত ছিলেন তার কিছু বিবরণ জানা গেছে। তারা নেপথ্যেই থাকতে চেয়েছেন। সামনে ঠেলে দিয়েছেন তাদের ফ্রন্টম্যানদের। এই ফ্রন্টম্যানদের বহন করতে হয়েছে সমাজের ধিক্কার, মিডিয়ার সমালোচনা এবং পুলিশের রিমান্ড ও জেল।

যেমন ডেসটিনির আর্থিক কেলেংকারিতে ওই গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, সেক্টর কমান্ডার ও সাবেক সেনা প্রধান লে. জে. হারুন-অর-রশিদ জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু জেলে গিয়েছেন ওই গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ রফিকুল আমীন। যেমন, হলমার্কের আর্থিক কেলেংকারিতে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলেও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী নিরাপদে আছেন। কিন্তু জেলে গিয়েছেন এই গ্রুপের কর্ণধার তানভীর মাহমুদ তফসির। যেমন, সর্বশেষ মানবিক বিপর্যয়ে সাভারের আওয়ামী এমপি মুরাদ জংয়ের বিরুদ্ধে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে সার্বিক প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ উঠলেও তিনিও নিরাপদে আছেন। কিন্তু সোহেল রানা হাজতে আছেন।

এই ফ্রন্টম্যানদের হয়তো কিছু শাস্তি ভোগ করতে হবে। তবে আওয়ামী লীগ যদি আবার সাধারণ নির্বাচন ম্যানেজ করে ক্ষমতায় থেকে যেতে পারে তাহলে তারা লঘু দণ্ড ভোগ করবেন।

বিস্ময়কর সব উত্থান

আওয়ামী রাজনীতির ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. দীপু মনি, আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী (যিনি আগে এমপি ছিলেন না এবং এখনো নির্বাচিত এমপি নন) প্রমুখের উত্থানের মতোই আওয়ামী ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে রফিকুল আমীন, তানভীর মাহমুদ ও সোহেল রানার উত্থান ঘটেছে বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে। উল্কার মতো এদের আবির্ভাব এবং আলাদিনের দৈত্যের মতো এদের বিশাল আকার ধারণে আওয়ামী পত্রিকা, টিভি বিব্রত হয়েছে। তাই এদের উত্থান কিভাবে ঘটল সে বিষয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশে তারা কুণ্ঠিত থেকেছে। তার পরেও সাভার দুর্ঘটনার প্রধান হোতা ও ফ্রন্টম্যান সোহেল রানার উত্থান বিষয়ে কিছু পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এসব খবরের সারাংশ হলোÑ

সাভারে সোহেল রানার পরিচয় খালেক কলুর ছেলে এবং হঠাৎ গজিয়ে ওঠা যুবলীগ নেতা হিসেবে। আদি বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মণ্ডপ গ্রামে। দুই দশক আগে আবদুল খালেক কলু জয়মণ্ডপ গ্রাম ছেড়ে সাভার বাজারে ভাসমান মানুষ হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ঘানিতে সরিষার তেল ভাঙিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করতেন। সাভার বাজারের সেই ভাসমান ঘরের সন্তান সোহেল রানা সন্তানের জন্মের পর কলু খালেক একটি নাদুসনুদুস শিশু দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। ওই সময়ে বাংলাদেশে মুভির বড় নায়ক ছিলেন সোহেল রানা। সম্ভবত কলু খালেক ছিলেন তার ভক্ত। তাই তিনি নবজাত শিশুর নাম রেখেছিলেন সোহেল রানা। তবে তিনি তখন কল্পনাও করতে পারেননি তার পুত্রধনটি হবে নায়ক সোহেল রানার চাইতে অনেক বেশি খ্যাতিমান ও ধনবান।

এক সময় সোহেল রানা তার বাবার তেলের ঘানিতে কাজ করত। বোতলে ভরে সরিষার তেল বিক্রি করত পায়ে হেটে। একটা বাইসাইকেল কেনার সামর্থ্য তার ছিল না। তাদের বাড়িটিকে এখনো স্থানীয়রা কলুর বাড়ি হিসেবেই জানে।

সোহেল সাভার অধরচন্দ্র হাইস্কুলে কাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। এরপর পড়াশোনা এগোয়নি তার নিজের উচ্ছৃঙ্খলতা এবং পিতার দারিদ্র্যের কারণে। কিন্তু সোহেল রানা এগিয়ে গিয়েছিল ছাত্ররাজনীতিতে। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই রানা ঢুকে পড়ে রাজনীতি আশ্রিত সন্ত্রাসী রাজীব-সমর বাহিনীতে। সাভারের ঝুট ব্যবসায়ে হাত লাগিয়ে বিত্তের মালিক হতে থাকে। একসময়ে সে হয় সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।

দু-তিন বছরের মধ্যে সোহেল রানা রূপান্তরিত হয় মানি মেশিনে। অর্থাৎ, টাকা উৎপাদনের যন্ত্রে। প্রথমে সোহেল রানা একটি তেলের মেশিন বসায়। নাম দেয় রানা অয়েল মিল। গোলাপ ফুল মার্কা সেই তেল সাপ্লাই করা হয় সাভার থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত।

১৯৯৮-এ সোহেল রানার নজরে পড়ে স্থানীয় রবীন্দ্রনাথ সাহার জমি। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। সোহেল রানা দখল করে রবীন্দ্র সাহার জমি। সেখানে ডোবার ওপরে রানা প্লাজা নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় ওই বছরেই। রবীন্দ্র সাহা মামলা করলেও সে মামলা আদালতে বেশি দূর এগোয়নি। সাভারে গড়ে ওঠে সোহেল রানার সন্ত্রাসী চক্র। সে পরিচিত হয় ভয়ঙ্কর ভূমিদস্যু রূপে। সাভারে উঠতে থাকে সোহেল রানার ভবন। প্রথমে নয় তলা রানা প্লাজা। তারপর নয়তলা রানা টাওয়ার। তারপর তার নিজের পাচতলা বাসভবন। সাভার পৌর এলাকায় আড়াই একর জমি। পৌরসভার বাইরে ষোল একর জমি। একটি পত্রিকার হিসাবে এসব বাড়ি, সম্পত্তি ও নগদ ক্যাশসহ সোহেল রানা হন ৫০০ কোটি টাকার মালিক। এক সময়ে বাইসাইকেলবিহীন রানার পরিবারের ছিল তিনটি মোটরগাড়ি এবং তার নিজের চলাফেরার জন্য একটি প্র্যাডো।

রাজনীতির আড়ালে সাভারের মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রথমে নিজের বাহিনী দিয়ে চুরি করানো, পরে চাদাবাজি, এবং পরিচিতি বেড়ে যাওয়ার পর জোর করে জমি দখল, বিশেষত হিন্দু সম্পত্তি দখল করে প্রথমে নিজের নামে লিখে নিয়ে এবং পরে শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল বিত্তশালী হয়ে যায় সোহেল রানা।

কলু থেকে কোটিপতি

ইংরেজিতে একটা বাক্য আছে, ফ্রম র‌্যাগস টু রিচেস (From rags to riches) যা দিয়ে বর্ণনা করা হয় সেই সব ব্যক্তিদের যারা চূড়ান্ত অভাব অনটন থেকে যাত্রা শুরু করে বিশাল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ফ্রম র‌্যাগস টু রিচেসÑ অনুপ্রাসটি লক্ষ্য করুন। সাভারের সোহেল রানার উত্থানে বাংলায় অনুপ্রাস হয়েছে কলু থেকে কোটিপতি!

গরিব থেকে ধনী হওয়াটা নিন্দনীয় নয়। বরং খুবই প্রশংসনীয় যদি সেই যাত্রাপথ হয় বৈধ। এতে সেই নব্য ধনীর উদ্যোগ, উদ্যম, বুদ্ধি ও পরিশ্রমের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মানুষ উদ্বুদ্ধ হতে পারে। আরো মানুষ গরিব থেকে ধনী হতে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশ আরো উন্নত হতে পারে। কিন্তু চরম দারিদ্র্য থেকে প্রচুর বিত্তÑ এই লক্ষ্যে পৌছানোর পথটি যদি হয় অবৈধ তাহলে সরকার ও সমাজকে তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা ও অবস্থান নিতে হবে। নতুবা বিত্তের লোভে সেই ব্যক্তির অপরাধকে অন্যরা অনুসরণ করতে থাকবে। অপরাধই তখন হবে ব্যক্তিগত সাফল্যের মূলমন্ত্র, যার পরিণতিতে তখন ঘটতে থাকবে ডেসটিনি, হলমার্ক, রানা প্লাজার মতো একটার পর একটা সামষ্টিক দুর্ঘটনা।

চুমুর পোস্টার

সোহেল রানা বুঝেছিলেন ধনী হবার জন্য আওয়ামী এমপি মুরাদ জংয়ের রাজনৈতিক কর্মে সাপোর্ট দিয়ে যেতে হবে। তাই বিএনপি আহূত হরতালের দিনে সকালবেলাতে তার মাস্তান বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন রানা প্লাজায়। শ্রমিকদের বাধ্য করেছিলেন ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে। দুর্ঘটনা থেকে বেচে যাওয়া একাধিক শ্রমিক বলেছেন, তারা ভবনে যেতে না চাইলে, রানা বলেছিলেন ভবনে কিছু হয়নি, কেবল প্লাস্টারে ফাটল ধরেছে।

সাভারের তিনটি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে উচ্চারিত হয় সোহেল রানার নামÑ যদিও কাগজে কলমে কোনো অভিযোগ ছিল না। সোহেল রানার শক্তি ছিল তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় আওয়ামী এমপি তালুকদার তৌহিদ জং মুরাদ। সাভার বাজারে স্থায়ীভাবে লাগানো হয় মুরাদ জং- সোহেল রানার যুগল ছবিসহ টেকনিকালার শত শত পোস্টার। প্রকাশিত হয় রানাকে জড়িয়ে ধরে মুরাদ জংয়ের চুমু খাওয়ার দৃশ্য। এ চুমু পারস্পরিক প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। এ চুমু ছিল উভয়ের ক্ষমতা ও বিত্তের প্রতি দুর্দমনীয় লোভের প্রকাশ এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিজ্ঞাপন।

সপ্তাহে দু-এক দিন সাভারে যেতেন মুরাদ জং। তার সামনে পেছনে থাকত পুলিশের ভিআইপি প্রটোকল। এ ছাড়া থাকত তিন-চারশ মোটরবাইক। আর সার্বক্ষণিকভাবে থাকত রানা বাহিনী। একটি পত্রিকা জানায় ‘মুরাদ জং মিরপুরে বাস করে রানার মতো লোক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন সাভার-আশুলিয়ার ঠিকাদারি কাজ, শিল্পকারখানার চাদাবাজি, ঝুট ব্যবসা, জমি রেজিস্টৃ বাণিজ্য, কমিশন আদায়, টিআর-কাবিখা-ওএমএস-সহ তার রাজনীতি।’

একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে (জুলাই ১৯৯৬ -সেপ্টেম্বর ২০০১)। তখন, ফেনী, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি এলাকার কিছু আওয়ামী এমপি জাতীয় সন্ত্রাসের প্রতীক হয়েছিলেন।

দুর্ঘটনার ছয় দিন পরে উদ্ধারকাজ দেখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সাভারে গিয়েছিলেন, তখন মুরাদ জং তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রক্ষকদের বাধায় মুরাদ জং কাছে ঘেষতে পারেন নি। কিন্তু কেন? মুরাদ জং কি ইনফেকশাস? সংক্রামক? এলাকায় গিয়ে স্থানীয় এমপির সঙ্গেই তো সবচেয়ে প্রথমে দেখা করা এবং বিস্তারিত কথা বলা উচিত ছিল প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু সোহেল রানা যে ফটো অপরচুনিটির সুযোগ নিয়েছিলেন, সেই সুযোগ প্রধানমন্ত্রী দিতে চাননি মুরাদ জংকে। তবে দুর্ঘটনার প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী যেমন সংসদে তার ভাষণে যুবলীগের সঙ্গে সোহেল রানার সম্পৃক্তি দ্বিধাহীন কণ্ঠে অস্বীকার করেছিলেন, তেমনটা তিনি মুরাদ জংয়ের বেলায় এখনো করেননি। প্রধানমন্ত্রী বলেননি, মুরাদ জং আওয়ামী লীগের এমপি নন।

প্রসঙ্গত বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি অনেকেই সতর্কবাণী দিচ্ছেন। তারা বলছেন, মুরাদ জংয়ের মতো কোনো ব্যক্তি যেন আগামীতে কোনো নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন না পায় সে বিষয়ে খালেদাকে এখন থেকেই সাবধান ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে।

সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগে কমফর্টেবল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, ‘ক্ষমতায় এলে সবাই সরকারি দলের হয়ে যায়।’ তার এ কথা সত্য। তবে এটাও সত্য যে এই ধরনের রূপান্তরিত সন্ত্রাসীর সংখ্যা আওয়ামী লীগেই বেশি ভিড় জমায়, কারণ তারা সেখানে বেশি কমফর্টেবল ফিল করে। আর তার কারণ হচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ে বিরাজমান সন্ত্রাসী মনোভাব (‘আপনারা কি চুড়ি পরে থাকেন? ‘একটার বদলে দশটা লাশ চাই’) এবং দলীয়পর্যায়ে চর্চিত সন্ত্রাসী কালচার (লাঠি-বৈঠা-লগি ব্যবহার, ২৮.১০.২০০৬)।

বুধবার ২৪ এপৃলে সহমাস্তানরা রানা প্লাজার বেইসমেন্টে আটক পড়লেও সোহেল রানা বেরিয়ে যেতে পারে। সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সাভার তথা সারা দেশজুড়ে সেøাগান রানার ‘ফাসি চাই’। বস্তুত, সেøাগানের চার্ট যদি বাংলাদেশে হতো তাহলে শেখ হাসিনা জানতেন ওই চার্টে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ এই দুটি সেøাগান জনপ্রিয়তায় নিচে নেমে গিয়েছে। টপ প্লেস এখন দখল করেছে ‘ফাসি চাই’ সেøাগান। এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারে শাহবাগ চত্বরে তথাকথিত জাগরণের সেøাগান কন্যা লাকি আকতার। সারা দেশজুড়ে দাবি ওঠে রানাকে গ্রেফতারের। এই কাজটা আওয়ামী সরকারের জন্য কঠিন ছিল না। সরকার সংশ্লিষ্টরা অনুমান করেছিলেন সোহেল রানা নিশ্চয়ই আওয়ামী কোনো নেতার আশ্রয় ও সহযোগিতায় তাদের প্রিয় গন্তব্যস্থল ইনডিয়াতে চলে গিয়েছে অথবা চলে যাবার চেষ্টা করছে। রোববার ২৮ এপৃলে সোহেল রানা ধরা পড়ে এবং তাদের অনুমান সত্যি প্রমাণিত হয়।

সেদিন বেলা তিনটার দিকে যশোরের বেনাপোল রেলস্টেশন বল ফিল্ড এলাকা থেকে সোহেল রানাকে সঙ্গী মিঠুসহ আটক করা হয়। জনৈক অনিলকে সঙ্গে নিয়ে রোববার ভোরে ফরিদপুরের কানাইপুর থেকে সে বেনাপোলে পৌছেছিল। সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগকর্মী ফার্নিচার ব্যবসায়ী শাহ আলম মিঠু তাকে আশ্রয় দেয়। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে দুপুর দু’টার দিকে র‌্যাবের ইনটেলিজেন্স ডিরেক্টর লে. কর্নেল জিয়া আহসানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম হেলিকপটারে যশোর এয়ারপোর্টে পৌছে যায়। তারা কঠোর গোপনীয়তায় বল ফিল্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে রানা ও মিঠুকে আটক করতে পারে কিন্তু অনিল পালিয়ে যায়। বেলা সাড়ে তিনটায় রানা-মিঠুকে যশোর এয়ারপোর্টে নেয়া হয়। সেখানে প্রেস কনফারেন্সে লে. কর্নেল জিয়া আহসান জানান, রোববার সন্ধ্যার পরে কোনো এক সময়ে বর্ডার ক্রস করে রানা ইনডিয়াতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ইনডিয়াতে পার করে দেয়া শর্তে রানা অনিলের মাধ্যমে মিঠুকে টাকা দিয়েছিল।

সত্যটা কে বলছেন?

প্রধানমন্ত্রী নাকি র‌্যাব ডিজি?

কঠোর নিরাপত্তার মাধ্যমে রানাকে হেলিকপটারে নিয়ে আসা হয় ঢাকাতে। যে ব্যক্তি পায়ে হেটে গোলাপ মার্কা সরিষার তেল বিক্রি করত, সেই ব্যক্তি প্র্যাডো থেকে উন্নীত হয় হেলিকপটারে। তবে এই ফাইট সুখকর হয়নি। যশোর এয়ারপোর্টেই লে. কর্নেল জিয়া আহসান জানান, আটক করার সময়ে রানার হাতে থাকা একটি ব্যাগ থেকে প্রচুর টাকা ও কয়েক বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। হেলিকপটারে বসে সোহেল রানা বুঝেছিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় তার শাস্তি হোক বা না হোক মানিলন্ডারিং ও মাদকদ্রব্য মামলায় তার কিছু শাস্তি হবে। ওই মামলার শুনানিতে যদি সে বলে, ফেনসিডিল কখনো ইনডিয়ামুখী হয় না-ইনডিয়ান ফেনসিডিল হয় বাংলাদেশমুখী, তাহলেও সে রেহাই পাবে না।

ইতোমধ্যে যশোর-খুলনায় গুজব রটে যায় রানা ঠিকই ইনডিয়াতে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারকে রক্ষার জন্য ইনডিয়ানরা তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। এসব গুজব থেকে বোঝা যায় পুলিশের কথা যেমন মানুষ বিশ্বাস করে না, ঠিক তেমনি র‌্যাবও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে চলেছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের নির্ভীক ও সত্যবাদী হতে হবেÑ ‘মাননীয়’র স্তুতি ছাড়তে হবে।

রোববার বিকেলে ঢাকায় র‌্যাব হেড কোয়ার্টার্সে প্রেস কনফারেন্সে র‌্যাব ডিরেকটর জেনারেল মোখলেসুর রহমান জানান, রানা প্লাজায় ব্যাপক হতাহতের মূল হোতা সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক সোহেল রানা। … প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রানা স্বীকার করেছে সে গ্যার্মেন্ট ফ্যাক্টরি খোলা রাখতে মালিকদের চাপ দিয়েছিল। শ্রমিকদের জোর করে ভবনের ভেতরে ঢুকিয়েছিল। ঘটনার পর ঘণ্টা দুয়েক সে সাভারে ছিল। পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জনৈক শামীমের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। প্রথম রাত সেখানে থাকে। দ্বিতীয় দিন মানিকগঞ্জে তার বন্ধু আফজাল শরিফের বাসায় ওঠে। সেখানে এক রাত থেকে চলে যায় ফরিদপুরে। ইনডিয়া যাওয়ার প্ল্যান করে ফরিদপুরে।

তাহলে কে সত্যি বলছেন? র‌্যাবে ডিজি? নাকি প্রধানমন্ত্রী? পাঠক এবং টিভি দর্শকদের হয়তো মনে পড়বে দুর্ঘটনার প্রথম দিনে শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, “রানা প্লাজার মালিক স্থানীয় যুবলীগ নেতা বলে গণমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। আমি সাভারের যুবলীগের কমিটির নাম নিয়ে এসেছি। সেখানে রানার নাম নেই।” (প্রথম আলো ২৫.৪.২০১৩)।

এখন সাহস পেয়েছেন আওয়ামী নেতারা

রানা গ্রেফতার হবার সংবাদ পাওয়ার পর সাভার এলাকার আওয়ামী নেতারা মুখ খুলতে সাহসী হন। দৈনিক কালের কণ্ঠ-র রিপোর্টের কিছু অংশ পড়–ন :

ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাভারের সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন খান ইমু বলেন, “সাভারে সোহেল রানার অপকর্মের প্রতিবাদ করার কেউ নেই। জমি দখল, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, হত্যাকাণ্ড সব অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এমপি মুরাদ জং হলেন তার শেলটারদাতা। এমপির কারণেই তো আজ এই অবস্থা।” ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাভারের বাসিন্দা হাসানউদ্দৌলা বলেন, “রানার সাথে এমপির ঘনিষ্ঠতার কথা ঘুরেফিরে আসছে। আমার সাথে রানার ঘনিষ্ঠতার কথা তো কেউ বলছে না। তাহলে সমস্যা তো আছেই।” সাভার পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম বলেন, এখন এমপি তো বলেন সম্পর্ক নেই। পত্রিকায় ছবি এসেছে। এখন তো অস্বীকার করার কিছু নেই। রানা এক সময়ে ছাত্রলীগ করতেন, সেটা তো এমপিও অস্বীকার করতে পারবেন না। আর এই যুবলীগের পদ দিয়েছেন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক হাসান তুহিন ও এমপি মুরাদ জং।” আওয়ামী লীগ নেতা ও সাভার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফিরোজ কবির বলেন, “সাভারে রাস্তাঘাটে হাটেন। দেখেন সবাই বলবে এমপির সাথে যাদেরই ঘনিষ্ঠতা আছে, সেটার মূল কারণ হলো আর্থিক লেনদেন। সেখানে কোনো দল নেই। জায়গা দখল, ঝুট ব্যবসা, পরিবহন চাদাবাজিসহ কিছু লোকজন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি। রানা হলেন তাদের একজন।” (কালের কণ্ঠ ২৯.৪.২০১৩)।

এরপরে টিভি ইন্টারভিউতেও মোহাম্মদ ফিরোজ কবির বলেন, সোহেল রানা ছিল যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক।

স্থানীয় আওয়ামী নেতারা যে সোহেল রানা গ্রেফতারের মুখ খুলেছেন তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুরাদ জং-সোহেল রানা জুটি সাভারে কত গভীর সন্ত্রাসের শাসন কায়েম করেছিল।

ধরা পড়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী

কিন্তু শেখ হাসিনা এসব কিছুই জানতেন না অথবা জানলেও সংসদে সরাসরি অস্বীকার করেছেন। অথচ তিনি জানেন বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল থেকে শুরু করে বিএনপির শত শত নেতাকর্মী কবে কোথায় কী করেছেন এবং সেসব অভিযোগে তাদের জেলে পুরেছেন। আরো হাস্যকর কথা হচ্ছে, এদের সবাইকে জেলে পুরে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়াকে সংলাপে বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। সবাই বোঝেন শেখ হাসিনা বাধ্য হবেন বিএনপি নেতাদের ছেড়ে দিতে। কারণ মানুষের কাছে তিনি ধরা পড়ে গিয়েছেন মিথ্যাবাদী রূপে। তার মিথ্যাকথনকে ধরিয়ে দিয়েছেন সাভারে তারই দলের নেতারা।

(চলবে)

click here

বিষয়: বিবিধ

১৩৬৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File