টোকাই কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন আশিক জ্যাকি ২৫ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:২৯:৫৬ সন্ধ্যা
চারটা ছেলে, বয়স আট থেকে ১০ বছর। গোল হয়ে বসে আছে পল্টন ময়দানে। সঙ্গে একটা পেটমোটা প্লাস্টিকের বস্তা। বস্তা ভরা পরিত্যক্ত পানির বোতল। কী হবে এগুলো দিয়ে, জিজ্ঞেস করায় সবচেয়ে যেজন বড় সেই উত্তরটা দিল, ‘ভাঙারির দোকানে লইয়া বেচুম। এই প্যালাস্টিকের দাম আছে। ২২ ট্যাকা কইরা কেজি।’ আরেকজনের বস্তায় ছিল দু-তিন রকমের তার এবং কয়েক টুকরো পাইপ। এগুলোও কি বিক্রি হবে? যে ছেলেটা উত্তর দিল তার উচ্চতা সবার চেয়ে কম। মুখভর্তি কালিঝুলি মাখা। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গোটানো। বলল, ‘রাস্তায় যত রহম প্যালাস্টিকের জিনিসপাতি দেহেন, সব বিক্রি হইব। এই বোতল, গ্যালান, শ্যাম্পুর শিশি, পাইপ, তার, পলিথিন ব্যাগ, স্যালাইনের ব্যাগ সব চলে। কুনু একটা ফ্যালনা নাই।’ —বিক্রি করে কত টাকা পাও প্রতিদিন? সেই ছেলেটাই জবাব দিল—ঠিক ঠিকানা নাই। ৪০ ট্যাহা ৫০ ট্যাহা। এহেক দিন এহেক রহম। —সারা দিন কি এই কাজই করো? স্কুলে যাও না? ওরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল, ‘স্কুলে যামু কী করতে?’ আসলেই ওরা স্কুলে যায় না। মাঝেমধ্যে এনজিওর আপা-ভাইয়ারা ভরপেট ভাত আর নতুন খাতা-কলমের লোভ দেখিয়ে ওদের নিয়ে পড়তে বসায়। কিন্তু সেই লোক দেখানো পড়ালেখায় তেমন কোনো উপকার ওদের হয় না। সত্যি বলতে কি, এই নিষ্ঠুর শহরে জীবন বাঁচানোর নানা কায়দা-কানুন শিখতে শিখতেই ওদের শৈশব কেটে যায়। বাকিটা জীবন কী করে টিকে থাকবে সেই শিক্ষা নিতেই এখন ব্যস্ত ওরা। ওরা সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে, আঁস্তাকুড় খুঁটে মানুষের ফেলে দেওয়া কাগজ, লোহা-লক্কর, প্লাস্টিক টোকায়। আমরা ওদের নাম দিয়েছি টোকাই। ভারি বিচিত্র জীবন এদের। অতি অল্প বয়সে কত কিছুর মুখোমুখি যে হতে হয়েছে ওদের। ওদের জীবনের গল্পগুলো যেকোনো উপন্যাসের কাল্পনিক কাহিনীকেও হার মানায় কখনো কখনো। কমলাপুরের রেলস্টেশনের নুরু বিল্লাহর কথাই ধরা যাক। কত দিন আছো কমলাপুর স্টেশনে? জিজ্ঞেস করলে নুরু জবাব দেয়, দুই বছর ধইরা। —কী করে এলে? —বাড়িততে পালায়া আইছি। —কেন? —আমার মায়েরে নিয়া খারাপ কথা কইছিল আমার মামাতো ভাই। ওরে আমি দাও দিয়া কোপ দিছিলাম। দিয়া আর ফির্যা চাই নাই। টেরেনে উইটঠা আয়া নামছি এহানে। অহন ইস্টিশনে কাগজ টোকাই। রাইতে প্লাটফরমে ঘুমাই। নেত্রকোনার সুজন অবশ্য কাউকে মেরে কেটে আসেনি। তার বাবা আর মায়ের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। রাগের মাথায় বাবা মাকে তালাক দিয়ে দেয়। দুদিন পর তার বড় বোনের বয়সী এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলে তার বাবা। সেই রাগে সে বাড়ি ছাড়ে। আজ দেড়টি বছর হয়ে গেল, মায়ের কিংবা বড় বোনের মুখটা দেখতে পায় না সে। নেত্রকোনার সচ্ছল গৃহস্থ ঘরের ছেলে সুজন তাই এখন আমাদের শহরের টোকাই। আরেকজনের কথা না বললেই হচ্ছে না। গায়ের বিশাল ঝুলের ময়লা কালো ছোপওয়ালা গেঞ্জি আর প্যান্টের দিকে খেয়াল না দিলে একে টোকাই বলে মনেই হবে না। অদ্ভুত সুন্দর গায়ের রং। মাথায় ভীষণ ঘন কোঁকড়া চুল। দেবশিশুর মতন সুন্দর চেহারা। ভারি চুপচাপ ধরনের, সহজে কথা বলতে চায় না। নাম বলল মাসুদ। এরও বাড়ি পালানোর ‘কেস’। ঘটনা অতি সামান্যই। মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছিল বলে বড় ভাই আর বাবা মিলে বেদম পিটিয়েছিল। ব্যস অভিমান করে বাড়ি ছাড়ল সে। প্রথমে সে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিল সিলেট রেলস্টেশনে। একটা রেস্তোরাঁয় হাঁড়ি-পাতিল ধোয়ার কাজ করেছিল কিছুদিন। তো সেখান থেকে চলে এলে কেন?—কথাটা শুনে লাজুক মাসুদ এবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলল। তারপর অনেকটা সময় নিয়ে বলল, ‘হোটেলের মালিক রাইতের বেলা আমার সাথে খারাপ কাম করত।’ সদরঘাটের হাবিবের গল্পটাও অনেকটা এ রকম। নানার মার খেয়ে চাঁদপুর থেকে সোজা এখানে এসে হাজির। এখন রাস্তাঘাটে কাগজ, লোহা-লক্কড় আর প্লাস্টিকের বোতল টোকায় সারা দিন। নানা মেরেছিল কেন? শুনে দুই পাশে মাথা নাড়ল হাবিব, তারপর জবাব দিল, ‘নানায় বেশি মারে নাই, মারছিল মামায়। দোকানে বই টিফি চাইতেছিলাম, এক কাস্টমার আই চা না পাই খাঁড়ায়া আছিল। হেইডা দেখি নানায় আরে ক্যাশের থুন নামাই ইগ্গা চোয়াড় দিল। মামা আইয়ারে লাত্থি মাইরল কতগিনি। শ্যাষে আই রাগ করি লঞ্চে উডি চলি গেলাম সদরঘাট। ইয়ানো আই বাসে হেলপারের কাম লইছিলাম। ওস্তাদ ব্যাডায় বহুত খারাপ আছিল। আরে দি আকাম করাইত। আর টেকা দি জুয়া খেইলত। একদিন রাইতের বেলা হ্যাতের পকেটের থুন আড়াই হাজার টেকা আর মোবাইলগা লই আমি ভাগি আইছি, আর যাই ন।’ কথা বলতে বলতে চোখে পড়ল এদের প্রত্যেকের কাছেই সস্তা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই আছে। সেদিকে আঙুল তুলে দেখাতেই তারা সব একযোগে হেসে উঠল। আমিন নামের ছেলেটা পোকা দাঁত দেখাতে দেখাতে বলে, ‘সিগারেট না খাইলে স্যার ভালা লাগে না। শইলডা ম্যাজ ম্যাজ করে।’ তারপর মালেককে দেখিয়ে বলে— ‘স্যার, এই হালায় কিন্তু ডেন্টি লয়। আবার মাঝে মইধ্যে ট্যাবলেটও খায়।’ —ডেন্টি কী জিনিস? —এইডা টানলে খুব নিশা হয় স্যার। একটার দাম ২০ ট্যাকা। প্যালাস্টিকের প্যাকেটে ভইরা মুখ লাগায়া টানতে হয়। একটা ঠিকমতন টানলে আর হুঁশ থাকে না। মালেক যার নাম সে কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করল না। তার মানে এই ছেলেটা যা বলছে সে কথা সত্যি। জানতে চাইলাম, ‘নেশা করো কেন তুমি? মরে যাবে তো!’ ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘সব সুম লই না ভাইয়া। যেই দিন টোকাইয়া মাল বেশি জমাইতে পারি না, ভাত খাওয়ার পয়সা থাকে না, হেই হেই দিন ডেন্টি লই।’ — ডেন্টির সঙ্গে ভাত খাওয়ার কী সম্পর্ক? — তিনবার ভাত খাইতে ৫০ ট্যাকা লাগে। ২০ ট্যাকা দিয়া একটা ডেন্টি নিলে সারা দিনে আর খিদা লাগে না। বেখাপ্পা শোনালেও বলতে হচ্ছে ঢাকা শহরের পরিবেশ রক্ষায় আমাদের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে টোকাইরা। যদিও আমাদের অবহেলা আর সরকারের ঔদাসীন্য ওদের নিত্য প্রাপ্য। শহরের ভদ্রলোকেরা তাদের সমাজের উচ্ছিষ্ট হিসেবেই ধরে নিয়েছে। যতটা সম্ভব তাই ওদের থেকে দূরেই থাকে তারা। কিছু বেসরকারি সংস্থা ওদের নিয়ে কাজ করার চেয়ে হাঁকডাক ছাড়তেই বেশি ব্যস্ত। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ওরা টোকাই কেন? শিরোনামে বই লিখে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন। টোকাইদের নিয়ে নানা রকম কথা বলা হয়েছে। কোনো কোনো বিশেষ দিবসে টোকাইদের ভাগ্যে জুটেছে পাঁচতারা হোটেলে বসে খাবার খাওয়ার সুযোগ। টিভির বদৌলতে সেসব আমরা ঘরে বসে বসে দেখেছি। কিন্তু টোকাইদের ভাগ্যের চাকা তাতে একচুলও নড়েনি। টোকাইরা আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। কেননা যেসব শিশুর বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা তারা এই শহরে এখনো আমাদের আবর্জনা কুড়িয়ে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। এখনো অবহেলার পাল্লাটা টোকাইদের দিকে বড্ড বেশি হেলে আছে। ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত্’—এটা বাস্তবায়িত হলে ঠিক আছে। কিন্তু যদি কেবল কথার কথাই হয় তাহলে বলতেই হচ্ছে, টোকাইদের ভাগ্যটা আসলেই কোনো দিন পাল্টাবে কি?
বিষয়: বিবিধ
২২৯৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন