নাসেখ ও মানসূখ

লিখেছেন লিখেছেন ফারুক হোসেন ২১ জানুয়ারি, ২০১৪, ১১:৫৭:০৪ রাত

নাসেখ মানসূখের এই কোরান বিরোধী মিথ্যা প্রথমে চালু হয় ৪০০ হিঃ বা ১০০০সনের শেষের দিকে তখনকার কিছু আলেম ওলামা কতৃক , যাদের অন্যতম আহমেদ বিন ইশাক আল দিনারি(মৃঃ ৩১৮ হিঃ), মোহাম্মদ বিন বাহার আল-আসবাহানি (মৃঃ ৩২২হিঃ) , হেবাতাল্লাহ বিন সালামাহ (মৃঃ ৪১০হিঃ) এবং মুহাম্মাদ মূসা আল-হাজমি (মৃঃ ৫৪৮ হিঃ)। তাদের দাবী , কোরানের কিছু আয়াত বাতিল বা প্রতিস্থাপিত হয়েছে কোরানের অন্য আয়াত দ্বারা। যে আয়াত অন্য আয়াতকে বাতিল করেছে , তাকে বলা হয় 'নাসেখ' এবং বাতিলকৃত আয়াত - 'মানসূখ'।

আসলেই কোরানের কোন আয়াত মানসূখ বা বাতিল হয়নি এবং কোরানের দুটি আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। অমুসলিমরা ও কোরানস্কেপ্টিকরা এই আয়াতগুলি ব্যবহার করে দুটি আয়াতের ভিতরে বিরোধ দেখিয়ে এটা প্রমান করতে যে , কোরান পারফেক্ট নয় ।

যে দুটি আয়াতের উপর ভিত্তি করে আলেমরা নাসেখ মানসুখের দাবী করেন , চলুন সেই আয়াত দুটি বিশ্লেষন করা যাক -

প্রথম আয়াত ২:১০৬

"আমি কোন আয়াত(آيَةٍ) রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান?"


আলেমদের দাবী এই আয়াত প্রমান করে যে কোরানের কিছু আয়াত অন্য আয়াত দিয়ে বাতিল করা হয়েছে। তারা 'আয়াত' এর শব্দগত মানে করেছে কোরানের আয়াত , যদিও কোরানে আমরা 'আয়াত' এর ৪ রকমের শব্দগত মানে পাই।

১) 'আয়াত' = অলৌকিক ঘটনা (miracle)

"১৭:১০১ আপনি বণী-ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস করুন, আমি মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য নিদর্শন( آيَاتٍ ) দান করেছি।"

২) 'আয়াত' = উদাহরন (example)

"২৫:৩৭ নূহের সম্প্রদায় যখন রসূলগণের প্রতি মিথ্যারোপ করল, তখন আমি তাদেরকে নিমজ্জত করলাম এবং তাদেরকে মানবমন্ডলীর জন্যে নিদর্শন(آيَةً) করে দিলাম।"

৩) 'আয়াত' = চিহ্ন (sign)

"১৯:১০ সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে একটি নির্দশন(آيَةً) দিন। তিনি বললেন তোমার নিদর্শন এই যে, তুমি সুস্থ অবস্থায় তিন দিন মানুষের সাথে কথাবার্তা বলবে না।"

৪) 'আয়াত' = কোরানের আয়াত।

"৩৮:২৯ এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ(آيَاتِهِ) লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে।"

এখন

২:১০৬ "আমি কোন আয়াত(آيَةٍ) রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান?"


আয়াতটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে প্রতীয়মান হয় যে , এই আয়াতে 'আয়াত' এর মানে কোরানের আয়াত না হয়ে বাকি ৩ টি মানেই বেশি যুক্তিযুক্ত। কারন - এই আয়াতেরি কয়েকটি শব্দের দিকে খেয়াল করুন -

১) "বিস্মৃত করিয়ে দিলে"- কোরানের আয়াত বিস্মৃত হয়ে যাওয়া কিভাবে সম্ভব? বেশিরভাগ হাফেজ ভুলে গেলেও কারো না কারো তো মনে থাকার কথা , তদুপরি কোরান একবার লেখা হয়ে গেলে তো আর ভোলা সম্ভব নয়। যদি মেনেও নেই আয়াতটি বাতিল হয়ে গেছে , তবুও সেটা কোরানেই লেখা থাকবে এবং সেটা ভুলে যাওয়া কখনৈ সম্ভব নয়। অলৌকিক ঘটনা বা চিহ্ন বা উদাহরন ভুলে যাওয়া সম্ভব।

২) "সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন" - একটি কোরানের আয়াত বাতিল করে তারি মতো সমপর্যায়ের আরেকটি আয়াত আনয়নের মধ্যে কোন যুক্তি আছে কি? আল্লাহ কি খেলা করছেন? (আল্লাহ মাফ করুন)। বরং মূসা বা অন্য রসূলের কাছে এমন কোন অলৌকিক ঘটনা বা চিহ্ন বা উদাহরন দেয়া হয়েছিল যা মানুষ ভুলে গেলে উত্তম বা সমপর্যায়ের অলৌকিক ঘটনা বা চিহ্ন বা উদাহরন আনয়ন বেশি অর্থবহ।

৩) আপনি যদি এই আয়াতের কন্টেক্সট দেখেন অর্থাৎ আগে পিছের আয়াত পড়েন , তাহলে বুঝবেন , ২:১০৬ নং আয়াতে 'আয়াত' এর মানে কোরানের আয়াত নয়। এখানে 'আয়াত' শব্দটি দিয়ে আল্লাহর কুদরতের কথা বলা হয়েছে যা অলৌকিক ঘটনা বা চিহ্ন বা উদাহরনের সমার্থক।

আল্লাহ মানুষকে বোঝানোর জন্য যখনি কোন (আয়াতের) অলৌকিক ঘটনা বা চিহ্ন বা উদাহরনের আনয়ন করেন , তখন তা পূর্ববর্তী আয়াতের সমান বা বৃহৎ হয়ে থাকে।

"৪৩:৪৬-৪৮ আমি মূসাকে আমার নিদর্শনাবলী (بِآيَاتِنَا) দিয়ে ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গের কাছে প্রেরণ করেছিলাম, অতঃপর সে বলেছিল, আমি বিশ্ব পালনকর্তার রসূল। অতঃপর সে যখন তাদের কাছে আমার নিদর্শনাবলী (بِآيَاتِنَا) উপস্থাপন করল, তখন তারা হাস্যবিদ্রুপ করতে লাগল। আমি তাদেরকে যে নিদর্শনই (آيَةٍ) দেখাতাম, তাই হত পূর্ববর্তী নিদর্শন অপেক্ষা বৃহৎ এবং আমি তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলাম, যাতে তারা ফিরে আসে।"


২য় আয়াত ১৬:১০১

"এবং যখন আমি এক আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত উপস্থিত করি এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেন তিনিই সে সম্পর্কে ভাল জানেন; তখন তারা বলেঃ আপনি তো মনগড়া উক্তি করেন; বরং তাদের অধিকাংশ লোকই জানে না।"

এখানে কোন আয়াতের প্রতিস্থাপনের কথা বলা হচ্ছে , তা বুঝতে হলে , এই আয়াতেরি শেষের অংশটি খেয়াল করুন - "তখন তারা বলেঃ আপনি তো মনগড়া উক্তি করেন; বরং তাদের অধিকাংশ লোকই জানে না।" এখানে এই 'তারা' টা কারা? যারা রসূলকে মনগড়া বা বানিয়ে কথা বলার দায়ে অভিযুক্ত করছে? এরা নিশ্চয় রসূলের অনুসারীরা না। এমন কথা মূসলমানেরা তাদের রসূলকে বলতে পারে না।


এরা হলো তারাই , যারা রসূলকে বিশ্বাস করে না এবং রসূলের কাছে নাযিলকৃত কোরানের আয়াত তাদের কাছে রক্ষিত আল্লাহর আয়াত থেকে ভিন্ন। ফলে তারা রসূলকে মনগড়া উক্তি করার দায়ে অভিযুক্ত করছে। বোঝা গেল এরা হলো আহলে কিতাবের অনুসারীরা (ইহুদী ও খৃষ্টানরা)। শুধু এই আয়াতের মাধ্যমেই নয় , অন্য আয়াতের মাধ্যমেও আল্লাহ জানিয়েছেন যে , কোরান অনুসারীদের জন্য পূর্বের রসূলগনের জন্য নাযিলকৃত কিছু কিছু আয়াত বা আইনের পরিবর্তন করেছেন। আল্লাহ কোরানে একটি আয়াতের স্থলে অন্য আয়াত উপস্থিত করলেন কিনা তা ইহুদী ও খৃষ্টানদের যেমন জানার কথা নয় , তেমনি তাদের জন্য কোন মাথা ব্যাথার কারন হতে পারেনা বা তার জন্য ক্ষেপে যেয়ে রসূলকে মনগড়া উক্তি করার দায়ে অভিযুক্ত করতে পারেনা। সর্বশক্তিমান আল্লাহ "আপনি তো মনগড়া উক্তি করেন" এই বাক্য দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে , এই আয়াতে কোরানের আয়াত প্রতিস্থাপনের কথা বলা হয় নি । বরং আহলে কিতাবদের গ্রন্থে যে আয়াত আছে , তার স্থলে নুতন বা উত্তম আয়াত রসূলের কাছে নাযিলের কথা বলা হয়েছে।

কেউ একজন বলেছেন -

আপনি নাসেখ মানসূখকে অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ আপনি যদি মদ হারাম হওয়ার তিন আয়াত ও বিধবাদের স্বামীর ঘরে অবস্থানের দুই আয়াত পাশাপাশি রেখে বিবেচনা করে দেখেন তবে বিষয়টি পানির মত পরিষ্কার হয়ে ভেসে উঠবে, পূর্ববর্তি আয়াত পরবর্তি আয়াত দ্বারা রদ করা হয়েছে।
তাই কি? দেখি কি লেখা আছে আয়াতগুলোতে :

মদের ৩ আয়াত -মদ সম্পর্কে প্রথমে বলা হলো-

২১৯।সুরা বাকারা। তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, 'এগুলির মধ্যে রয়েছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য কিছু লাভ। কিন্তু লাভ অপেক্ষা পাপ অনেক বেশী।'

২য় ধাপে বলা হলো-

৪৩। সুরা নিসা। হে মুমিনগণ ! নেশাগ্রস্থ অবস্থায় সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা [সালাতের সময়ে] যা বল তা [অর্থ] বুঝতে পার। [আবার] অপবিত্র অবস্থায় [সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না], যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা গোসল কর, তবে পথচারী এ ব্যবস্থার ব্যতিক্রম।

৩য় ধাপে নিষিদ্ধ করা হলো-

৯০।সুরা মায়েদা। হে মুমিনগণ ! [সকল] মাদকদ্রব্য [নেশা জাতীয় দ্রব্য], জুয়া, মূর্তি পূজার পাথর [যার উপরে উৎসর্গ করা হয়], তীরের সাহায্যে ভাগ্য গণনা জঘন্য কাজ [যা] শয়তানের সৃষ্টিকর্ম। সুতরাং তোমরা উহা বর্জন কর, যেনো তোমরা [আধ্যাত্মিক] সফলতা লাভ করতে পার।


কোরানে একি বিষয়ের উপরে একাধিক আয়াতের আরো নজীর আছে। যেমন কেয়ামতের উপরে , সৃষ্টির বর্ননার উপরে ইত্যাদি। এর অর্থ এই নয় যে পরবর্তী আয়াত পূর্ববর্তী আয়াতকে রদ করেছে। রদ করা বলতে বুঝায় নুতন কোন আয়াতের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়ে পূর্ববর্তী কোন আয়াতের নির্দেশ কে অকেজো করে দেয়া। আমরা যদি মদ বা নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াত ৩টি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই , আয়াত ৩টি পরস্পর বিরোধী নয় এবং আয়াতগুলোতে মদের ভালো ও মন্দ দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আয়াত ৩টিই উপদেশ মূলক এবং ৩টি আয়াতেই নেশা জাতীয় দ্রব্যের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিকের বর্ননা দিয়ে মূলত নেশা জাতীয় দ্রব্য বর্জন করতেই উৎসাহিত করা হয়েছে। বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই কাফি। ১ম দুটো আয়াত বুদ্ধিমানের জন্য। মদ মহাপাপ জানার পরে এবং নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজ হবে না জানার পরে ও কি কোন সত্যিকারের মুসলমান নেশা জাতীয় দ্রব্য বর্জন না করে পার পাওয়ার কথা ভাবতে পারে? বর্জন করতে বলার এই আয়াতে কি আগের দুটো আয়াত রহিত করার কোন কথা বলা আছে? নেই।

আলেমদের দাবী অনুযায়ী যদি আগের দুটো আয়াত রহিত হয়ে যায় , তাহলে কি ৩য় আয়াত নাযিল হওয়ার পর থেকে , মদ খেলে আর মহাপাপ হবে না নাকি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজের নিকটবর্তী হওয়া যাবে? মদ আগেও যেমন মহাপাপ ছিল , এখনো তেমনিই মহাপাপ আছে এবং আগেও যেমন নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজের নিকটবর্তী হওয়া যেতনা , এখনো তেমনি নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজের নিকটবর্তী হওয়া যায়না। তাহলে আগের দুটো আয়াত রহিত হলো কেমনে? কেউ কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন।

এখন দেখা যাক বিধবাদের নিয়ে আয়াতদুটোত কি বলা হয়েছে -

২৩৪। সুরা বাকারা। তোমাদের মধ্য যারা বিধবা রেখে মৃত্যুবরণ কর, তাদের স্ত্রীরা চারিমাস দশদিন অপেক্ষা করবে । যখন ইদ্দত কাল পূর্ণ করবে, তখন নিয়ম অনুযায়ী তারা নিজেদের জন্য যা করবে তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নাই। তোমরা যা কর আল্লাহ্‌ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।

২৪০। সুরা বাকারা। তোমাদের মধ্যে যারা বিধবা স্ত্রী রেখে মারা যায়, তারা যেনো তাদের বিধবাদের জন্য এক বছরের থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত করে যায় । কিন্তু যদি তারা [গৃহ] ত্যাগ করে যায় এই শর্তে যে তারা নিজেদের জন্য যা করবে তা ন্যায়সঙ্গত, তাহলে তোমাদের কোন অপরাধ নাই। আল্লাহ্‌ অসীম ক্ষমতাধর, প্রজ্ঞাময়।


এখানে আয়াত দুটিতে দুটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করা হয়েছে। ১মটিতে বিধবা বিবাহ নিয়ে ও ২য়টিতে বিধবা ভরনপোষন নিয়ে। ফলে আয়াতদুটি পরস্পর বিরোধী তো নয়ই এবং শেষের আয়াত দিয়ে প্রথম আয়াত রদ করা সম্ভব নয়। তালাকের মতৈ বিধবাদের পুনর্বিবাহের আগে ৪মাস ১০দিন অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে এটা জানার জন্য , যে তারা অন্তসত্বা কিনা। এই দায়িত্ব বিধবার । ২৪০ নং আয়াতে মৃতস্বামীকে মরার আগে তাদের বিধবাদের জন্য ১ বছরের ভরনপোষনের ব্যবস্থা করে রেখে যেতে বলা হয়েছে। এই দায়িত্ব মৃত স্বামীর। এই ভরনপোষন বিধবা মৃত স্বামীর সম্পত্তির যে অংশ পাবে তার অতিরিক্ত। দেখুন আয়াত ৪:১২। সুতরাং বোঝাই যায় , ২৪০ নং আয়াতে , বিধবা যদি ১ বছরের আগে নিজে থেকেই চলে যায় তাহলে মৃত স্বামীর উত্তরাধীকারদের বিধবার ভরনপোষনের দায় থেকেই শুধূ মুক্তি দেয়া হয়েছে কিন্ত বিধবাদের ইদ্দত কালীন দায় দায়িত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয় নি বা বিধবাকে মৃত স্বামীর সম্পত্তির অংশিদারীত্ব থেকেও বঞ্চিত করা হয়নি। বলা যায় ইসলামে বিধবাদের জন্য উদার ও পর্যাপ্ত সংস্থানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আরো কিছু মানসূখ(?) আয়াত -

আয়াত [২ : ১১৫] এ বলা হয়েছে যে -

'পূর্ব পশ্চিম সর্বত্রই আল্লাহ্‌ বিদ্যমান; এবং যে দিকেই তোমরা মুখ ফিরাও না কেন সে দিকেই আল্লাহ্‌র উপস্থিতি বিদ্যমান। আল্লাহ্‌ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।'

এবং আয়াত [২:১৪৪] তে বলা হয়েছে - .... তোমাকে এমন কিবলার দিকে ফিরাইয়া দিতেছি যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে। অতএব তুমি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফিরাও। তোমরা যেখানেই থাক না কেন উহার দিকে মুখ ফিরাও ....'।


দাবী করা হয় যে , ২:১৪৪ আয়াত নাযিল হওয়ার পরে ২:১১৫ আয়াত মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে এবং কিছু নাস্তিকেরো দাবী আয়াতদুটি সাংঘর্ষিক। এই দাবীর পিছনে যুক্তি হলো , ২:১১৫ অনুযায়ী আল্লাহ যে কোন দিকে ফিরে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং এই আয়াত রহিত হয়ে যায় যখন আল্লাহ ২:১৪৪ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে কিবলা মসজিদুল হারামের দিকে ফিরে নামাজ পড়তে বলেন।

প্রথমত - কখনৈ যে কোন দিকে ফিরে নামাজ পড়ার অনুমতি ছিল না। কোরানে বলা হয়েছে , কিবলা পরিবর্তন করা হয়েছে কিন্তু কোন কিবলা ছিল না , একথা কোরানের কোথাও বলা হয় নি। ২:১৪৪ এ বলা হয়েছে , আগে যে কিবলা ছিল তা রসূলের পছন্দ না হওয়াতে , আল্লাহ রসূলের পছন্দনীয় নুতন কিবলা নির্ধারন করেন।

আমাদের আলেমরা (?) ভুল যেটা করছেন তা হলো , ২:১৪৪ আয়াতে নামাজের দিগনির্দেশক কিবলার কথা বলা হলেও ২:১১৫ তে নামাজ বা কিবলা কোনটার কথাই বলা হয়নি। ২:১১৫ আয়াতে এই সত্যটাই বলা হয়েছে যে আল্লাহ সর্বব্যাপী ("Omnipresent" ) , অর্থাৎ যেদিকেই তাকাই না কেনো বা যেদিকেই যাইনা কেনো , সবসময়ই আমরা আল্লাহর দিকে ফিরে থাকি। ২:১১৫ আয়াতে দেখুন বলাই হয়েছে আল্লাহ সর্বব্যাপী এবং এর থেকে এটাই প্রমান হয় যে , এই আয়াতের বিষয়বস্তু আল্লাহর উপস্থিতি , নামাজ বা কিবলা নয়। সুতরাং ২:১১৫ আয়াত রহিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা এবং আয়াতদুটি সাংঘর্ষিক ও না।

৬২।সুরা বাকারা। যারা ঈমান আনে [এই কুর-আনে], এবং যারা ইহুদীদের [ধর্মগ্রন্থ] অনুসরণ করে, এবং খৃশ্চিয়ান, এবং সাবীয়ান, যারাই ঈমান আনে আল্লাহ্‌র [একত্বে] শেষ [বিচার] দিবসে এবং সৎ কাজ করে, তাদের জন্য পুরষ্কার আছে তাদের প্রভুর নিকট। তাদের কোন ভয় নাই তারা দুঃখিতও হবে না।

৬৯। সুরা মায়দা। যারা বিশ্বাস স্থাপন করবে [আল কোরআনে], যারা অনুসরণ করবে ইহুদী [ধর্মগ্রন্থ], এবং সাবীয়ান ও খৃষ্টানগণ [এদের মাঝে] যারা বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহ্‌র একত্বের প্রতি; এবং শেষ বিচারের দিনে, এবং সৎ কাজ করবে তাদের কোন ভয় নাই, এবং তারা দুঃখিতও হবে না।

৮৫। সুরা আল ইমরান।কেহ ইসলাম ব্যতীত [আল্লাহ্‌র ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণকারী] অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে, তা কখনও গ্রহণ করা হবে না। পরলোকে সে হবে [আধ্যাত্মিকভাবে] ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত।


দাবী করা হচ্ছে যে , ২:৬২ ও ৫:৬৯ আয়াতে কিছু সংখ্যক ইহুদি ও খৃষ্টানের পরকালে পুরষ্কৃত হওয়ার কথা যা বলা হয়েছে , তা ৩:৮৫ আয়াত নাযিল হওয়ার পরে রহিত হয়ে গেছে , কারন ৩:৮৫ আয়াতে মুসলমান ছাড়া আর সকলেই ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে।

এই ভুল দাবীর মূলে ইসলাম শব্দের ভুল ব্যাখ্যা। যদিও কোরানের একাধিক আয়াতে সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা হয়েছে , ইসলাম নবী ইব্রাহিমের ধর্ম এবং উনিই ছিলেন প্রথম মুসলমান (দেখুন ২:১২৮ , ২:১৩১ , ২:১৩৩) , তদাপি আজকের মুসলমানদের দাবী তারাই একমাত্র ইসলামের ধারক ও বাহক এবং একমাত্র কোরানের অনুসারীরাই মুসলমান।

এটা যে একটা ভুল প্রচার তার প্রমান পাওয়া যায় ৩:৬৭ আয়াতে , যেখানে আল্লাহ বলছেন , "ইব্রাহীম ইহুদী ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না, কিক্তু তিনি ছিলেন ‘হানীফ’ (حَنِيفًا مُّسْلِمًا ) অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ এবং আত্নসমর্পণকারী, এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না।" আল্লাহ ৫:১১১ আয়াতে বলছেন যে , যীশু ও তার অনুসারীরা মুসলমান ছিলেন। ২৭:৪৪ আয়াত দেখুন , যেখানে বলা হয়েছে সোলায়মান ও বিলকিস (রানী শেবা) ও আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করেছেন অর্থাৎ মুসলমান এবং ৫:৪৪ আয়াতে বলা হয়েছে তওরাতের অনুসারি সকল নবী ও তাদের অনুসারীরা মুসলমান।

এই সকল আয়াত পড়ে একটাই উপসংহারে আসা যায় , তা হলো তওরাত ও ইন্জিলের (বাইবেল) অনুসারীরাও মুসলমান , যাদের কোরান সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই। এই মুসলমানরা দোজাহানের মালিক আল্লাহর নিকটেই আত্মসমর্পন করেছেন। ইব্রাহিম যে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা তা কোরানেও যেমন পাওয়া যায় , তেমনি তাওরাতেও পাওয়া যায়। কোরান থেকে আমরা এই শিক্ষাই পাই যে , সত্যিকারের মুসলমান সেই , যে এক আল্লাহর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পন করে এবং এক আল্লাহর আইন মেনে চলে এবং তারা শুধু কোরান অনুসারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

এখনকার খৃষ্টানদের মধ্যে যারা 'God' এর একত্বে বিশ্বাস করে ও যীশুর পূজা করে না , তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মুসলমান। ২:৬২ ও ৫:৬৯ আয়াত অনুযায়ী যেকোন ধর্মালম্বি যদি এক সৃষ্টিকর্তায় (আল্লাহ , ইয়াহয়ে , 'God' যে নামেই ডাকুন না কেনো) বিশ্বাস করে , আখেরাতে বিশ্বাস করে ও আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে , সে আল্লাহর দৃষ্টিতে মুসলমান। এবং এরা সকলেই তাদের ভালো কাজ অনুযায়ী পুরষ্কৃত হবে। এরা হলো কোরানিক মুসলিম বা ইহুদি মুসলিম বা খৃষ্টান মুসলিম বা হিন্দু মুসলিম .......।

সুতরাং ২:৬২ ও ৫:৬৯ আয়াতদ্বয় রহিত ও হয় নি বা ৩:৮৫ আয়াতের সাথে কোন কন্ট্রাডিকশন ও নেই।

বিষয়: বিবিধ

২০১২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

165612
২২ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০১:১৬
মাটিরলাঠি লিখেছেন : ভাই পড়লাম। বিষয়টি জটিল। পক্ষে-বিপক্ষে বহু মতামত আছে, এবং এটা একটি ইখতিলাফি বিষয়।

জাজাকাল্লাহু খাইরান।
165633
২২ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:২৭
সঠিক ইসলাম লিখেছেন : ব্লগে এতদিন গোমরাহ ফেরকাহ ছিল হেযবুত তাওহীদ আর আহলে হাদীস। আজকে নতুন দেখলাম হাদীস অস্বীকার কারী আহলে কুরআন। আপনি কি আমু আর সদালাপের সেই আহলে কুরআন ফারুক ?
165634
২২ জানুয়ারি ২০১৪ রাত ০২:৩৪

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File