প্রকৌশলি জনাব আব্দুল ওয়াসেতের পরিবেশ দুষন নিয়ে এই লেখাটি সকলের সাথে শেয়ার করলাম ।

লিখেছেন লিখেছেন নজরুল ইসলাম খান ২২ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:১২:৩৪ সন্ধ্যা

হাজারিবাগের ট্যানারী শিল্প স্থানান্তর জরুরী

ওয়াসেত সাহিন

চামড়া শিল্প বাংলাদেশের একটি অর্থকরী ও সভাবনাময় শিল্প সন্দেহ নেই । দেশে প্রতি বছর বিপুল পরিমান চামড়া উৎপাদন হয় । ফলে নিজস্ব কাঁচামালে এটি একটি দেশীয় চালু শিল্প । দেশের ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রিগুলোর বেশির ভাগই ঢাকার হাজারিবাগে অবস্থিত । কিন্তু এসবে কোন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকায় সমগ্র হাজারিবাগ এবং সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ মারাত্মক ভাবে দূষিত হচ্ছে । বিশেষতঃ বুড়িগংগার পানি বিষাক্ত কাল বর্ণ ধারন করেছে ।

বাংলাদেশে প্রথম ট্যানারী স্থাপিত হয় নারায়নগঞ্জে । আর পি সাহা এটি ১৯৪০ সালে স্থাপন করেন । যা পরবর্তীতে ঢাকার হাজারিবাগে স্থানান্তরিত হয় । ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের আগে এই অঞ্চলের প্রায় সকল কাঁচা চামড়াই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় প্রক্রিয়াজাত করণের নিমিত্তে প্রেরন করা হত ।

পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালে এদেশে মোট ৩০ টি ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রি ছিল । যার সবকটির মালিকানা ছিল পাকিস্তানী ব্যবসায়ীদের । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এসবের অবাংগালী মালিকরা ইন্ডাষ্ট্রি ফেলে চলে যায় । ফলে উক্ত ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রি গুলো বাংলাদেশ সরকারের হস্তগত হয় । বর্তমানে সারা দেশে মোট ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রির সংখ্যা ২৭০ টি । এর প্রায় ৯০% অর্থাৎ বেশির ভাগই ঢাকার হাজারিবাগে অবস্থিত । হাজারিবাগ একটি অত্যন্ত ঘণবসতীপূর্ণ এলাকা । এতে প্রায় ২৫ হেক্টর জায়গার উপর ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রিগুলো অবস্থিত । বাংলাদেশের ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রিগুলো বছরে প্রায় দেড় কোটি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে । এর ৮৫% বিদেশে রপ্তানী করে এবং বাকী ১৫ % চামড়া দিয়ে স্থানীয় বাজারের জন্য শিল্পজাত পণ্য তৈরী করা হয় । এসবের মাঝে আছে ব্যাগ, স্যূটকেস, বেল্ট, জুতা ইত্যাদি । স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত এসব পণ্য যথেষ্ট মান সম্পন্ন । চামড়া রপ্তানী করে বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ । তাই এই শিল্পটিকে পরিবেশ বান্ধব করে এর বিকাশ অবশ্যই কাম্য । এদেশের নামকরা ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রির মধ্যে এপেক্স ট্যানারী, ঢাকা লেদার, লেক্সকো ইত্যাদি অন্যতম ।

সন্দেহ নেই, শহুরে এলাকায় যে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানই পরিবেশ দূষনের কারন ঘটিয়ে থাকে । তবে ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রি এর মাঝে পরিবেশের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে । পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন পানি, মাটি, বায়ূ, গাছপালা, মানুষ ইত্যাদির উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ । হাজারিবাগ ট্যানারীর সমস্ত তরল বর্জ বুড়িগংগায় নিঃসরিত হয় । যা নদীটির পানিকে ঘন কৃষ্ণবর্ণ, দূর্গন্ধময় ও বিষাক্ত করে তুলেছে । জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে শুধুমাত্র হাজারিবাগ ট্যানারী থেকে দৈনিক ৭৭ লক্ষ লিটার তরল বর্জ ও ৮৮ মেত্রিক টন কঠিন বর্জ উদগত হয় । এই পরিমান বর্জ যদি প্রতিদিন নদীতে নিক্ষিপ্ত হয় তবে নদীটির কি অবস্থা হতে পারে তা ভাবতেও ভয় লাগে । বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ যেমন সোডিয়াম সালফাইড, সোডিয়াম মেটা বাই সালফাইট, সালফিউরিক এসিড, বেসিক ক্রোমিয়াম সালফেট, ফরমিক এসিড সম্বলিত বর্জ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকীসরূপ যা প্রতিনিয়ত পানি ও মাটিতে মিশে চলেছে । তরল বর্জ নদীর মাছ ও অন্যান্ন জলজ প্রাণীর ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে । দূষিত বায়ূ ডায়রিয়া ও পাকস্থলীর সমস্যা এবং নাসারন্ধ্রের সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে । বিভিন্ন স্থানে জমা করে রাখা কঠিন বর্জ মাটি ও বায়ূকে মারাত্মক ভাবে দূষিত করে থাকে । এটি গাছপালা, ভূগর্ভস্থ পানি ও জনস্বাস্থের জন্য অতিশয় হুমকীসরূপ । উল্লেখ্য হাজারিবাগ এলাকায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষই নিম্ন আয়ের । কিছু লোকজন গৃহস্থালী কাজে বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি ব্যবহারে বাধ্য হয় । যা তাদের খাদ্যে বিষক্রিয়া সহ নানান স্বাস্থ্যহানী ঘটাচ্ছে । দেখা যাচ্ছে হাজারিবাগ এলাকাকে কিছুতেই স্বাস্থ্যসম্মত বসবাসোপযোগী এলাকা হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই ।

এসব ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রিতে কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় । তারা কোনরূপ মাস্ক ব্যবহার করেনা এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিষয়ে কোন জ্ঞান কিংবা ট্রেনিং তাদের নেই । তারা প্রতিদিন বিষাক্ত গ্যাস নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহন করছে । ফলে তারা নানা রকম মরণ ব্যাধি যেমন ক্যান্সার, ব্রঙ্কাইটিস, এজমা, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়ে নিজেদের আয়ূকে ক্ষয় করে চলেছে । কখনো কখনো তাদের অংগহানী ঘটছে এবং বিষাক্ত গ্যাসের কারনে হারাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি । দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এই অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বহুসংখ্যক অল্প বয়সী শিশুরাও কাজ করে । বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সূত্র মতে হাজারিবাগ ট্যানারীতে কর্মরত শ্রমিকদের ৯০%ই ৫০ বছরের নীচে মৃত্যূ বরন করে থাকে । জীবিকার জন্য জীবন ক্ষয়ের এ চিত্রটি খুবই হতাশাজনক ।

ঢাকা নগরবাসী এই দুঃসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে মুক্তি চায় । এটি জনগনের ন্যায্য চাওয়াও বটে । সরকার ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রিকে হাজারিবাগ থেকে সাভারের সুবুরবনে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে । কিন্তু সরকারীভাবে এখনো সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মিত না হওয়ায় স্থানান্তর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে । স্থানান্তরের খরচ, মালিক পক্ষের অনীহা ও ব্যাংক মর্টগেজ হচ্ছে বিলম্বের মূল কারণ । এছাড়াও এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল বহু পরিবার রয়েছে যারা স্থানান্তরের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । তবে বাস্তবতার আলোকে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারী ইন্ডাষ্ট্রি গুলো স্থানান্তরের সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিকল্প নেই । হাজারিবাগ এবং আশে পাশের এলাকার ব্যাপক পরিবেশ দূষন এবং বিশেষতঃ বুড়িগংগাকে দূষনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে এটি করতেই হবে । বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় ক্ষুদ্র স্বার্থ বিবেচনার সুযোগ নেই । তবে অবশ্যই এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মান করতে হবে । এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ছাড়া স্থানান্তরে কোন ফায়দা হবেনা । শিল্পটিতে আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার চালু করাও জরুরী । ট্যানারী শিল্প এদেশের একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় শিল্প । তাই পরিবেশ বান্ধব করে এর বিকাশ কাম্য । সংগত কারনেই এতে যথেষ্ট পরিমান রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে । তাই কর্মরত শ্রমিকদের স্বাস্থ রক্ষার বিষয়েও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া দরকার । হাজারিবাগের ট্যানারীশিল্প স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অবশ্যই এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের সাথে সাথে ফ্যাক্টরির অভ্যন্তরীন স্বাস্থকর পরিবেশের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে ।পরিবেশ ও জনজীবন বিপদসংকুল করে শিল্প বিকাশের স্বপ্ন অযৌক্তিক ও অমানবিক । বর্জ যথাযথ পরিশোধনের পরই তরল বর্জ নদীতে এবং কঠিন বর্জ কোন ডাম্পিং স্থলে অপসারন করা যেতে পারে । এভাবেই দূষন মুক্ত পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে ।

বিষয়: বিবিধ

১২২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File