অন্ধকারে মুখ গুজে শেষ আকুতি “বাঁচতে চাই”

লিখেছেন লিখেছেন রায়ান মাসরুর ২৬ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৪৮:০৩ রাত

ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ- নাগরিক মতপ্রকাশের সব অনলাইনজুড়ে একটাই আলোচনা সাভার রানা প্লাজা ট্রাজেডি। ২৪ এপ্রিল ১৮দলের ডাকা হরতাল চলছিল দেশজুড়ে। অন্য দিনের মতো সেদিনের সূর্যের আলোটাও ছিল বেশ ঝলমলে। কিন্তু সাভারের রানা প্লাজায় যে নির্মমতা অপেক্ষা করছিল তা জানান দিয়েছিল পূর্বদিনের ফাটল। তবুও মৃত্যুর কাছে স্বপে দেয়া হল অনেকগুলো তাজা প্রান আর হাজারো জীবনের সব স্বপ্ন। ২৩ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সম্বর্ধনায় বিদায়ী স্পিকার ও নতুন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ বলছিলেন, সময়টা ভালো যাচ্ছে না। তিনি সবার কাছে সংকট উত্তরনে সহযোগিতা ও আল্লাহর সাহায্য চেয়েছিলেন। তার আশংকাই সত্য হল। যাত্রাটা তার শুরু হল এক অশুভ দিনে। ভাই মারা গেলেন এ খবরে প্রেসিডেন্ট যেমন ব্যথাকাতর তেমনি পরদিন যখন তার শপথ আয়োজন হচ্ছিল তার ১২ঘন্টা আগে সকালে ঘটে গেল নির্মম ট্রাজেডি রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ার ঘটনা।

ছোট বোন আয়েশা ফেসবুক চ্যাটিংয়ে জানালো লন্ডনে সকালেই সে যখন অফিস যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠে তখন বিনে পয়সায় বিলি হচ্ছিল পত্রিকা (ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে পত্রিকা বিক্রি হয় না)। তখন ঘটনার বিবরন জানতে বিদেশীদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশীদের কাছে। বোনটি জানালো তার হাতে মেট্রো পত্রিকায় বড় হেডলাইনে বিশাল ছবিতে সাভারের ঘটনার বিবরন দেয় হয়েছিল। শুধু লন্ডনের মেট্রো পত্রিকাই নয়। বিশ্বমিডিয়ার সব মাধ্যমগুলোতে জায়গা দখল করে আমাদের শ্রমজীবিদের লাশের মিছিলের সংবাদ। এই সাভারেই এর আগে স্পেকটার্ম গার্মেন্টস ধ্বসে ৭৬জন, তাজরীন গার্মেন্টস আগুনে পুড়ে ১১৪জন আরো অসংখ্য দূর্ঘটনার খবর খুব বেশি দিন ব্যবধানের নয়। সবশেষ তাজরীনে যখন কাবাব হলো দেশীয় অর্থনীতির চাকা ঘুরানো মূল্যবান শ্রমিকের দেহগুলো তখন আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম এই শোক যেন আমাদের শেষ শোক হয়। কিন্তু নিয়তির মৃত্যু কুপ যেখানে তৈরী হয়েছে আমাদের দরিদ্রদের ভোগ করার জন্য সেখান থেকে ফেরানোর সাধ্য কার। ঘটনার পরপর আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে হাজারো মানুষ। রক্ত দিতে দীর্ঘ লাইন এসে দাড়ায় কুমিল্লার টাউন হল পর্যন্ত। ফটো সাংবাদিক এসোসিয়েশন নেতা তাপস ভাই, সাদেক ভাই, বাহার ভাই ও রিপনসহ আরো ক’জন বন্ধু সহকর্মী ভাইয়ের উদ্যোগে কুমেক সন্ধানীর সহযোগিতায় সেদিন প্রায় শতাধিক মানুষ রক্ত দিয়েছে তাৎক্ষনিকভাবে। সব মতের সব মানুষ এক হয়ে গিয়েছে মানবতাকে বাঁচানোর তাগিদে। বড় কোন দূর্যোগ পুরো জাতিকে এক করে দেয় তা আবারো স্বচক্ষে দেখলাম।

লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন লাশের মিছিলে ৩০৪ জন শ্রমিক যোগ হয়েছেন। আহত দুই সহ¯্রাধিক। এরই মাঝে শুরু হয়ে গেছে নানা রকম টকশো। আর এতে রসদ যোগাচ্ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বহু উজির নাজির, নেতা পাতিনেতা বুদ্ধিজীবি ও পরজীবিরা। কিন্তু এতো কথা বলে এ পর্যন্ত কি কোন বড় দূর্ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন? এই শ্রমজীবি মানুষদের কাছে কি জবাব দেবে আগামীর বাংলাদেশ? পুজিপতিরা কি দায় এড়াতে পারবেন? কোথায় আজ সেই প্রকৌশলীরা.. যারা কালো টাকার ভোগে স্বস্তা হিসেবের দালান চড়িয়ে দেন আমাদের ভাগ্যকে চাপা দিতে। চাপা পড়া দালানের ভেতর থেকে কোন নারী বোনের পা দেখে আমার বলতে ইচ্ছে করছে.. মৃত্যুর আগে এ বোনটি আমাদের বিবেকের দরজায় এভাবে পা দেখিয়ে দিয়ে গেলো। যে গার্মেন্টস শিল্প স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে যাচ্ছিল সেটাকে এমন দূর্বল খুটির উপর দাড় করিয়ে কারা আমাদের ভাগ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে? স্পেকটার্ম, তাজরীন, রানা প্লাজার পর হয়তো খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না আরো এমন বিষাদময় স্মরণসভার। ইতোমধ্যেই ফাটল ধরা পড়েছে আরো বেশ কিছু দালানে।

পুঁজিপতিদের অন্ধকার গুহায় মুখ গুজে যখন আমাদের স্বজনরা জীবনকে ফিরে পাবার শেষ আকুতি করছে তখন বেদনায় ছেয়ে যায় প্রতিটি সুস্থ্যবিবেকসম্পন্ন মানুষের। গোটা জাতি শোকে স্তব্দ। পাগলের মত যে বাবা তার সন্তানকে খুজছেন সাভারে তিনি হয়তো জানেন না তার আদুরের উপার্জনক্ষম মেয়েটি ১ম দিনেই পিষ্ট হয়ে দেবে গেছে ৩য় তলায়। কি নিয়ে ফিরবেন ঘরে.? কে দেবে জবাব? এমন বাবার সংখ্যা আজ একজন দুজন নয়.. অসংখ্য। টিভি স্ক্রিনে সবাই দেখছি এখনো বনি আদমরা বেঁচে থাকার শেষ আকুতি করছেন.. হাহাকার করছেন একটু মুক্ত আলোতে আসার জন্য, প্রয়োজন হলে শরীরের অংগ প্রত্যঙ্গ কেটে হলেও যেন তাদের বের করা হয়।

শ্রমে পোড়া মানুষের লাশঘর এখন দীর্ন বিদির্ণ ধ্বংসস্তুপ। মানুষের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে কবি ফররুখের সেই ছন্দ কয়েকটি মনে পড়ছিল-

''যেখানে প্রশস্ত পথ ঘুরে গেল মোড়

কালো পিচ- ঢালা রঙে লাগে নাই ধূলির আঁচড়

সেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর;

সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখে না সে মৃতের খবর

জানি মানুষের লাশ মুখ গুজে পড়ে আছে জমিনের পর।''

পুরো বাংলাদেশ কাঁদছে। হাসপাতালের বারান্দা আর কলংকের স্বাক্ষী রানা প্লাজা ছাপিয়ে হাহাকার, আর্তনাদে বিষাদময় হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। রানা প্লাজার ’রানা’ শব্দটি এখন আর কোন নেতা আর প্রভাবশালীর সম্বোধন নয় এখন তা কলংকের উচ্চারন। তাজরীনে কাবাব হলো ১১২জন মা বোন.. কিছুই হলো না মালিকের। ক’দিন টকশো বেচা কেনা হল। ভবন ধ্বসের এই ট্রাজেডিও হয়তো অতি শিগগিরই রাজনৈতিক বলিতে পরিনত হবে। এভাবেই কি রানাদের জুচ্চোরি প্রাসাদের নিচে অসহায় আমাদের স্বপ্নগুলোকে কবর দিতে হবে?

যারা রানার এই ভবন সহ আরো অসংখ্য মৃত্যুকূপ অনুমোদন দিয়েছেন, সেই সব প্রকৌশলীরা কি দায় এড়াতে পারবেন? সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা নাকি প্রথমত ইঞ্জিনিয়ার হয় আর পিছনের বেঞ্চের ছাত্ররা হয় রাজনীতিবিদ। তাহলে ১ম বেঞ্চ আর শেষ বেঞ্চের ছাত্রদের কলংকজনক চরিত্রবদলের কাছেই কি মাঝের ছাত্রগুলোর প্রাণ যাবে বারে বারে?

শেষ করবো ফেসবুকে দুজন প্রিয় মানুষের ষ্ট্যাটাস দিয়ে। সাধারন বান্না ভাই লিখেছেন, 'রাজনৈতিক নেতা' হয়ে তো অনেক দিন রইলেন ... এবার একটু 'মানুষ' হয়েই দেখুন !!" মোস্তফা শাকেরুল্লাহ লিখেছেন, “যারা শীর্ণ জাতির বুকে জাগালো আশা, মৌন মলিন মুখে জাগালো ভাষা। সেই রক্তকমলে গাঁথা মাল্যখানি, বিজয় লক্ষ্যে দেব তাদেরই গলে।। ..........এই আত্মত্যাগের উপরেই হয়তোবা একদিন বাংলাদেশ দাড়াবে। কিন্তু সেই বাংলাদেশেও তোমাদের স্মরণ করা হবে, এ সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। ভালো থাকিস, ভাই-বোনেরা। কোন উচ্চাভিলাষ নয়; এতটুকু ভালো থাকার আকাঙ্খায় যাদের জীবন হারিয়ে যায়। তাদের অনন্তের জীবন সুখ আর ভালোয় কাটুক..’’

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File