ডিজিটাল ডিজিটাল বলে গলা ফাটাবেন না, প্লিজ

লিখেছেন লিখেছেন পৃথিবী থেকে ০৭ মে, ২০১৩, ০৬:৪৫:৩৪ সন্ধ্যা

আমাদের উন্নয়নের অসুখে ধরেছে। এই অসুখ এখন মহামারির রূপে নিয়মিত বিরতিতে হাজির হচ্ছে। যেটা আবার ভয়াবহতায় প্রায়ই গজবের মাত্রা পেয়ে যায়। সাভারের ‘রানা প্লাজায়’ যা ঘটল তা গণখুনেরই নামান্তর। বলাই বাহুল্য, এই ঘটনার শোকে মানুষ মাত্রই বিহ্বল হবেন। আমি শোককে আপাতত ছুটি দিতে চাই। যেখানে আমরা সচেতনভাবে, নিয়ম করে, শতমুখি প্রস্তুতি নিয়ে খুনের সব আয়োজন করে রেখেছি সেখানে এইরকম ঘটনায় নিয়মিত শোক প্রকাশও কৌতুকে পরিণত হয়েছে। আমরা আর এই ধরণের কৌতুকে কান দিতে চাই না। শোকের জায়গায় আমি শাস্তি শব্দটা ব্যবহারের পক্ষপাতি।

আত্মসমালোচনার সময় এসেছে এখন। আর বিলম্ব নয়। ছয়তলার অনুমতি নিয়ে নয়তলা করার সব ফাঁক ফোঁকর রেখে দিব আর কতদিন? আমরা এখন এতটাই বেহায়া হয়ে গেছি যে, এমন গণখুনের সামনে দাঁড়ায়ে এখন শোক প্রকাশ করব! বিরোধি দল হরতাল প্রত্যাহার করবে, শোক জানাবে। নেতারা সংবাদ সম্মেলন করবেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করবেন। মধ্যবিত্ত প্রাণ শোকে কাতর হবে, মিডিয়ায় প্রকৌশলীদের হিড়িক পরে যাবে। তিনারা টেকনিক্যাল ব্যাখ্যা দিবেন। ব্যাবহারবিদ, পারোকোয়াল বামপন্থি দলগুলা শ্রমিক দরদী কর্মসূচি দিবেন। মালিককে যথারিতি খুঁজে পাওয়া যাবে না ঘটনার পর থেকেই। এবং মালিক হবেন, স্বাভাবিক নিয়মেই ক্ষমতাসীদের ঘরের লোক। সাংসদ তাকে পালাতে সহযোগিতা করবেন ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডকে নিশ্চিতভাবেই কৌতুকের অংশ হিসেবেই ধরতে হবে। অন্যদিকে মিডিয়া স্বাভাবিকভাবেই- দুর্ঘটনা, বিপর্যয়, ট্রাজেডি বা ভয়াবহতা বোঝানোর মত কোন শব্দ ব্যাহার করবে। এর ফলে আমরাও ঘটনার হৃদয়বিদারতা কাটিয়ে কিছুটা সময় নিব। বেদনা কাটিয়ে উঠতে উঠতে আবার ঘটে যাবে আর একটা ‘ট্রাজেডি’। ফলে মিডিয়ার এইসব ভাষ্যের আড়ালে যে ব্যাবস্থার কারণে এই করম ধারাবাহিক হত্যার ঘটনা ঘটে তার ঠিকুজিও আমরা ধরতে পারব না। দেশ-নির্বাচন, ক্ষমতা, জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে যাবে। গণতন্ত্রের আকাঙ্খায় কাতর হয়ে আমরা ভোট দিতে পারব কিনা সেই আশঙ্কা বা আশায় দিন পার করতে থাকব। বাড়তে থাকেবে আমাদের উন্নয়ন কাঙ্খা। গ্রামকে বানাব শহরমুখী। স্থাপনাই হবে উন্নয়নের নিদর্শন। এই যখন অবস্থা তখন, শহর মানেই খুনের রাজত্ব হতে বাধ্য। সেটা ঢাকা, সাভার বা ময়মনসিংহ-যেখানেই তা করা হোক না কেন।

এই সব গণখুনের ঘটনা আমাদের একটা ঐতিহ্যতে পরিণত হয়েছে । ১৯৯৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজউকের হিসেবেই ভবন ধস ও হেলে পড়ার ৫০ টি ঘটনার রেকর্ড আছে। ২০১০ সালে বেগুনবাড়িতে আব্বাসউদ্দিনের ৫ তলা বাড়ি পাশের একটি বস্তিতে হেলে পড়লে ২৫ জন মারা যান। ২০০৬ সালে ২৪ ফেব্রয়ারি তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স ভবন ট্রাজেডিতে ২১ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৫ এ ফেব্রিক্স ইন্ড্রাস্টিজ ও স্পেকট্রাম সোয়েটার ইন্ডাষ্ট্রিজ লিমিটেড এর ৮ তলা ভবন ধসে ৬২ জন নির্মান শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। গত নভেন্বরে তাজরিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুরে মারা যান ১১০ জন। হাতের কাছে পাওয়া এসব তথ্য খবুই অপ্রতুল। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা অগুনতি। নিহতের সংখ্যাও লুকানো হয়। এত এত হত্যার নিয়মিত মহড়া দেখে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমরা এখন লাশের সংখ্যা গুনতে গুনতে অংক শিখতে পারছি। বাচ্চাদের গণিতে দক্ষ বানাতে পারছি।

বড় অবাক লাগে, স্তম্ভিত হই। রানা প্লাজায় আগে থেকেই ফাটল দেখা গেল। কারখানা ছুটিও দেয়া হল। মালিক সোহেল রানা, সাভার থানার যুবলীগের সিরিয়র যুগ্ম আহবায়ক বললেন, এমন ফাটল কোন ব্যাপার না। এখন যে শতাধিক লোকের লাশ বের করা হল, এটা কি তার কাছে কোনো ব্যাপার না? হাঁ, ব্যাপার না। এরা মানুষ ছিল না। ছিল শ্রমিক। শ্রমিকরা কি মানুষ নাকি? এক-দেড়শ মরেছে; আবারও আনা হবে এ রকম অসংখ্য শ্রমদাসদের। নিয়োজিত করা হবে আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল করতে। সুতরাং সমস্যা কি? পেটের দায়ে তারা যাবে কোথায়? মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাদের ওই কবরে ঢুকতে হবে। নিয়তি।

একটি জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি আকারে গড়ে উঠবার শর্তকে আমরা এত দিন পাশ কাটিয়ে নিজেদেরকে গুটিকয়েক মানুষের হাতে তুলে দিয়েছি। চেতনার ব্যাবসার বলি করেছি আমরা নানা ভাবে। এই সব ব্যাবসায়ীরা উন্নয়ন, উন্নয়ন বলে যে বয়ান দাতাগোষ্ঠি এবং তাদের স্থানী দালালদের স্বার্থের দিক থেকে নির্ধারণ করেছে। আমাদের উপর কৌশলে চাপিয়ে দিয়েছে সে সবকেই আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভুয়া বাকোয়াজীতে গলাধকরণ করেছি এতদিন। নিজেদের পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রকৃতির সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক ভুলে গেছি। নিজেদের উৎপাদনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ভুলে গেছি আধুনিকতার ধাধালো তুড়িতে। আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছি। আমরা নিজের অজান্তে গণকবরে ঢুকে পরেছি। সেতু নির্মান থেকে শুরু করে, ভবণ নির্মান সব কিছুতেই দাতা স্বার্থ দেখভাল ও ভাগভাটোয়ার পথ পরিষ্কার করার জন্য তিনারা তো বটেই, মিডিয়াও আমাদের সভ্যতাবিরোধী উন্নয়নের বয়ানে বুঁদ করে ফেলেছে। আমরা নিজেদের চিন্তা ও ইতিহাসের মধ্য থেকে নিজেদের উপযোগী কোন নীতির দিকে আগাতে পারি না। আমরা খুনিদের নীতিকেই উন্নয়ণ বলে ধরে নেই। এই কাজের সবচেয়ে বড় দোষের হল আমাদের কুৎসিত মনের সুশীল নামধারী ঘাতকরা। ফলে আমরা নিজেদের প্রজ্ঞার দিকে যদি মনযোগি না হই তাহলে রানা প্লাজা ধসের মত উন্নয়নের গজব খেকে আমরা রক্ষা পাবো না।

আমাদের গোটা শহর এক দশকের মধ্যে এখন ল্যান্ডব্যাবসায়ীর আওতায় চলে গেছে। তারা এর উচ্চমার্গীয় নাম দিয়েছে ডেভলপারকোম্পানি। তারা কিসের ডেভলপার। কি তারা ডেভলপ করে। বিল্ডিং বানালেই ডেভলপ করা হয়ে যায়। আর নয়া মধ্যবিত্ত ব্যাপক হারে পঙ্গপালের মতো তাদের দ্বারস্থ হল। এই লাগাম ছাড়া ডেভলপারের নীতিটা কি? আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতিকে তারা ড্রয়িং রুমে ঢুকিয়ে দিল। ফলে অপরিকল্পিতভাবে ভবন ধসের ঘটনাকে দেখে আৎকে উঠার কিছু নাই। গজবের নমুনা মাত্র শুরু। ভয়াবহতা সামনে আরও বাকি আছে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে, তা এখনও আমরা টের পাচ্ছি না। শ্রমিকদের সামনে মূলা ঝুলানো হচ্ছে নিত্যদিন। বাংলাদেশকে আমরা সবার জন্য বাসযোগ্য একটা রাষ্ট্র না বানিয়ে, তার জন্য কোন সংগ্রমে সামিল না হয়ে, এই ভু-অংশকে দেশি-বিদেশিদের বাজারে পরিণত করেছি। উন্নয়ন বলতে বাজারের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই। শুধু দোহাইটা দেয়া হয় জনগণের। ফলে বৈষম্য দিন দিন বাড়ে। উল্টাদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ে উন্নয়নে জিকির। আমরা ফাঁদে পরেছি। এই ফাঁদে চ্যাপ্টা হয়ে এখন আমাদের মরা মা-বোন-ভাইদের পা বের হয়ে আসছে। এই পা আমাদের কপালের দিকেই তাক করা; পরিষ্কার হিসেব।

আমরা ডিজিটাল ডিগবাজিতে এখনও বুঁদ হয়ে আছি। অথচ আমাদের উদ্ধারকর্মীরা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পায় না। একটি ভবন ধসে পড়লে তা থেকে লোকজনকে উদ্ধারে যখন টর্চলাইট খুঁজে পাওয়া যায় না তখন আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি, ''এই মিয়া, কিসের ডিজিটাল- ডিজিটাল চিৎকার করো? আমার মা-ভাই-বোন ভবনের নীচে আটকা। তারা চিৎকার করছে বাঁচাও বাঁচাও বলে। আমরা উদ্ধার সরঞ্জামের অভাবে তাদের 'রানাপ্লাজার কবর' থেকে তুলে আনতে পারছি না। আমাদের অনুৎপাদনশীল খাতে দেদার কেনাকাটা হয়, টর্চলাইট কেনা হয় না। প্রাগৈতিহাসিক কালের রুস্তম-হামজা দিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারের চেষ্টা হয়। আধুনিক উদ্ধারকারী জাহাজ কেনা হয় না।

''কেন?'' প্রশ্নবান আসছে। উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি থাকুন জনাব।

বিষয়: রাজনীতি

১০৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File